বিজ্ঞাপন

মহাখালীতে হোটেল ব্যবসাও আছে ড্রাইভার মালেকের!

September 23, 2020 | 11:36 am

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক মো. আবদুল মালেক ওরফে বাদলের অঢেল সম্পদের তথ্য এরই মধ্যে বেরিয়ে এসেছে। ফ্ল্যাট, বাড়ি, ডেইরি ফার্মের পর এবার জানা গেল, মহাখালীতে হোটেল ব্যবসাতেও যুক্ত ছিলেন তিনি। সম্প্রতি অবশ্য হোটেলটি বিক্রি করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় সেই প্রক্রিয়া আর শেষ করতে পারেননি।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর মহাখালী আমতলীতে ‘কাপাসিয়া হোটেল’ নামে পরিচিত হোটেলটি দীর্ঘদিন থেকে পরিচালনা করে আসছিলেন আবদুল মালেক। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই ভবনের মালিক সেলিম রেজাও একজন গাড়িচালক। তবে সেলিম রেজার পরিবারের সদস্যরা এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, এটা তার শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া বাড়ি। তাদের দাবি, ২০০৮ সালে ১৪ লাখ টাকা দিয়ে মালেক এই হোটেলের জায়গা কিনে নেন সেলিম রেজার কাছ থেকে।

সরেজমিনে হোটেল এলাকায় গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাপাসিয়া হোটেলের দেখাশোনা করতেন আবদুল মালেকের বড় মেয়ের স্বামী রতন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ক্যান্টিনও চালাতেন এই রতনই। ১৩ সেপ্টেম্বর এই হোটেল বিক্রি করার উদ্যোগ নেন আবদুল মালেক। ৩০ লাখ টাকা দিয়ে এই হোটেল বিক্রির বিষয়ে কথা হয় সেলিম রেজার সঙ্গেও। তবে আবদুল মালেক গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় হোটেলটি আর বিক্রি করতে পারেননি।

হোটেলের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা বুলবুল সারাবাংলাকে বলেন, ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে হোটেলটি চলছে। আমি আবদুল মালেকের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছিলাম। তার বড় মেয়ের জামাই রতন দেখাশোনা করেন। আগে দৈনিক এক হাজার ৫০০ টাকা দিতাম। তবে করোনাভাইরাসের কারণে এক হাজার ২০০ টাকা দিতাম। অর্থাৎ মাসে ৩৬ হাজার দিতাম।

বিজ্ঞাপন

বুলবুলও জানান, হোটেলটি বিক্রি করে দেওয়ার কথাবার্তা চলছিল। তিনি বলেন, আমরা শুনেছি, ৮ থেকে ১০ দিন আগে এটি বিক্রির কথা হয়েছিল, দরদামও ঠিক হয়ে গেছিল। ৩০ লাখ টাকা দিয়ে হোটেলটি এই বিল্ডিংয়ের মালিক সেলিম রেজার কিনে নেওয়ার কথা শুনেছিলাম। সেটা তো আর হয়নি।

আরও পড়ুন:

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, বিল্ডিংয়ে মালিক সেলিম রেজার সঙ্গে আবদুল মালেকের ভালো সম্পর্ক ছিল। সেলিম রেজাকে এলাকায় অনেকে গাড়িচালক হিসেবে চেনেন। অনেকে বলেন, তিনি গাড়ির ব্যবসা করেন।

ভবনটিতে টু-লেট সাইনবোর্ড দেখে সেখানে থাকা সেলিম রেজার মোবাইল নম্বরে ফোন দেন এই প্রতিবেদক। শুরুতে বাসা ভাড়া নেওয়ার কথা বলা হলে তিনি কথা বলেন। একপর্যায়ে আবদুল মালেকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন। আর রিসিভ করেননি।

পরে সেলিম রেজার স্ত্রী ফাতেমা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, আমরা এই বিল্ডিংয়ের মালিক। আমাদের বাবার বাসা এটা। উনি আমাদের ভাইবোনদের মাঝের বণ্টন করে দিয়েছেন। আমরা ১২-১৩ বছর আগে মালেক ভাইয়ের কাছে দোকানের পজেশন বিক্রি করছিলাম। কিছুদিন আগে তিনি জানিয়েছিলেন, পজেশন বিক্রি করে দেবেন। যেহেতু আমরা বিল্ডিংয়ের মালিক, তাই আমরাই এটা রেখে দিতে চাইছিলাম। কিন্তু উনারে নিয়ে গ্যাঞ্জাম লাগাতে আর বসা হয় নাই। আমার হাজবেন্ড এখানে কিছু না।

ফাতেমা আরও বলেন, আমরা পাঁচ বোন বাবার বাড়িতে থাকি। মালেক ভাই আমাদের বাসায় আসছিলেন। উনি ৩২ লাখ টাকা চাইছিলেন। পরে ৩০ লাখ টাকায় বিক্রির কথাবার্তা ঠিক হয়। এর মধ্যে তো উনিই ধরা খাইলেন।

বিজ্ঞাপন

ফাতেমা আরও জানান, হোটেলটি নিয়ে তাদের মধ্যে কথাবার্তা হলেও কোনো লেনদেন হয়নি। কোনো চুক্তিও হয়নি। তার স্বামী সেলিম রেজা গাড়ির ব্যবসায়ী বলে জানান তিনি। বলেন, ‘তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরে গাড়ি চালান না। তাই কেউ যদি এই ধরনের কিছু বলে থাকে, তবে ভুল বলেছে।’

এর আগে, ২০ সেপ্টেম্বর ভোরে রাজধানীর তুরাগ এলাকা থেকে অবৈধ অস্ত্র, জালনোটের ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে র‍্যাব-১-এর একটি দল স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের গাড়িচালক আবদুল মালেককে গ্রেফতার করে। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হলেও তার নামে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যায়। র‌্যাব জানায়, জাল টাকার ব্যবসা ছাড়াও তিনি এলাকায় চাঁদাবাজিতে জড়িত। শুধু তাই নয়, গ্রেফতারের পর বিভিন্ন ব্যাংকে তার নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে ঢাকায় তার সাতটি প্লটে চারটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে।

সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাবার নামে মাজার শরীফ বানিয়ে জায়গা দখল থেকে শুরু করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নানাভাবে সম্পদ গড়েছেন আবদুল মালেক। পেশায় গাড়িচালক আবদুল মালেক স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের (শিক্ষা) গাড়ি চালানোর দায়িত্বে ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি এই পদে আছেন। তবে অফিসের গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গাড়ি চালক আবদুল মালেক দীর্ঘদিন ধরে অধিদফতরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। বিশেষ করে অধিদফতরের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য তার প্রধান কাজ। কোনো কর্মকর্তা যদি আবদুল মালেকের সুপারিশ না শোনেন, তাহলে তাকে ঢাকার বাইরে বদলি করাসহ শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনাও ঘটিয়েছেন একাধিকবার।

কর্মকর্তারা লোকলজ্জার ভয়ে এসব বিষয় কখনো প্রকাশ করেননি। নিজে অধিদফতরের একজন গাড়িরচালক হয়েও ব্যবহার করতেন পাজেরো জিপ। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের ক্যান্টিনও পরিচালনা করতেন জামাইকে দিয়ে। তার রয়েছে গাড়ির তেল চুরির সিন্ডিকেট। স্বাস্থ্য অধিদফতরের যত গাড়ির চালক তেল চুরি করেন, তার একটি অংশ তাকে দিতে হয়। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি পুরো অধিদফতর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধুমাত্র একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালকই না, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমনকি সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও যদি রাজধানীতে একাধিক বাড়িসহ অঢেল সম্পদের মালিক হতে দেখা যায়, তবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। এই সম্পদ বৈধ কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায়, বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই এসব ক্ষেত্রে।’

তিনি বলেন, শুধু কান টানলে হবে না, মাথাও টানতে হবে। চুনোপুটিরা অবশ্যই প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। কিন্তু রুই-কাতলারা কী করেছেন, সেটিও দেখার বিষয়। সেটি করতে পারলেই সত্যিকার অর্থে একটি নিয়ন্ত্রণের জায়গায় যাওয়া যাবে। অন্যথায় এমন অন্যায়-দুর্নীতির বিকাশ আরও ঘটতে থাকবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের কিছু কিছু ব্যক্তি অনেক বছর ধরে এসব দুর্নীতি করছে। তাদের যারা প্রশ্রয় দিয়েছে, বড় হতে দিয়েছে, তাদের ধরা উচিত। ড্রাইভারকে ধরে আর কী লাভ! চার দিন রিমান্ডে যাবে, ১০ দিন রিমান্ডে যাবে, স্বীকারোক্তি দেবে— এর বেশি তো কিছু হবে না। কিন্তু যারা তাকে প্রশ্রয় দিয়ে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, তাদের খুঁজে বের করা উচিত।’

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন