বিজ্ঞাপন

নারী হয়রানি রোধে বাঙালি বিজ্ঞানীর দারুণ অবদান

September 25, 2020 | 6:46 pm

রাজনীন ফারজানা

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানির শিকার হননি— এমন নারী খুঁজেই পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থায় নারীকে নানারকম অবমাননার শিকার হতে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট কিংবা কমেন্টে অশ্রাব্য ভাষার মাধ্যমেও প্রায়ই নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকে। বিশেষ করে তারকাসহ জনপ্রিয় ফেসবুক পেজ বা টুইটার হ্যান্ডেলগুলোতেও নারীর প্রতি অবমাননাকর ভাষার আকছার ব্যবহার দেখা যায়। আর এর জন্য মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয় নারীদের।

বিজ্ঞাপন

এরকম হয়রানি থেকে নিষ্কৃতি পেতে পোস্ট বা কমেন্ট ডিলিট ও রিপোর্টের অপশন আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। কিন্তু সেখানে প্রতিটি কমেন্ট বা পোস্ট ধরে ধরে ডিলিট বা রিপোর্টের কাজটি যথেষ্টই সময়সাপেক্ষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের এমন অবমাননার শিকার হওয়ার বিষয়টি বিশ্বজুড়েই আলোচিত হলেও তা থেকে মুক্তির সহজ কোনো পথ ছিল না।

অনলাইন আর ডিজিটাল এই যুগে এসে এরকম পরিস্থিতির একটি সহজ সমাধান বের করতে এগিয়ে আসেন অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির তিন গবেষক। প্রযুক্তি ব্যবহার করে যখন নারীদের ডিজিটাল মাধ্যমেই হয়রানির শিকার করা হচ্ছে, তখন সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী নিরাপত্তার কৌশল খুঁজেছেন তারা। আর এর জন্য দ্বারস্থ হন মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা এমন একটি অ্যালগরিদম উদ্ভাবন করেছেন যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নারীবিদ্বেষী পোস্ট বা কমেন্ট খুঁজে বের করবে এবং রিপোর্টও করবে। গর্বের বিষয়, এই গবেষণায় অংশ নিয়েছেন আবুল বাশার, যিনি কি না বাংলাদেশের সন্তান।

আবুল বাশার কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। বর্তমানে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে পোস্ট ডক করছেন। গবেষণায় তার সুপারভাইজার ছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের অধ্যাপক রিচি নায়েক। তাদের সঙ্গে ছিলেন আইনের অধ্যাপক নিকোলাস সুজর।

বিজ্ঞাপন

রিচি নায়েক, আবুল বাশার ও নিকোলাস সুজর

কীভাবে এই গবেষণার অংশ হলেন— জানতে চাইলে আবুল বাশার বলেন, দুই মেয়ের বাবা হিসেবে তিনি সবসময়ই মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চান। একজন নারী হিসেবে তার সুপারভাইজার রিচিও এই বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। অন্যদিকে নিকোলাস সুজর আগে থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছিলেন। তবে তিনি হ্যান্ড কোডিং ব্যবহার করতেন। তাই নিকোলাসের পক্ষ থেকে যখন অটোমেটেড মেশিন লার্নিং অ্যালগারিদম তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়, তারা রাজি হয়ে যান।

বাশার জানান, ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয় এই গবেষণার কাজ। চলতি বছরের জুনে তাদের গবেষণা প্রবন্ধটি স্প্রিংগার ডটকমে প্রকাশিত হয়। ‘রেগুলারাইজিং এলএসটিএম ক্লাসিফায়ার বাই ট্রান্সফার লার্নিং ফর ডিটেক্টিং মিসোজিনিস্ট টুইটস উইথ স্মল ট্রেনিং সেট’ শিরোনামের গবেষণাটি প্রকাশের পর থেকেই বিভিন্ন পত্রিকায় এটি নিয়ে সংবাদ হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে তাদের গবেষণার খবর। পরে এই অ্যালগরিদম নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকারসহ অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান। বাশার জানান, অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি একটি ডিজিটাল মনিটরিং প্যাটার্ন চালুর উদ্যোগ নিয়েছে, সেটার জন্য তারা নতুন এই প্রযুক্তি কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। তার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি কর্তৃপক্ষও ছাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে এটি কিনতে চাইছে।

আবুল বাশার সারাবাংলাকে বলেন, আমরা মূলত টুইটারকে ঘিরে এই গবেষণাটি চালিয়েছি। তবে যেকোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই অ্যালগরিদম প্রয়োগ করা যাবে। বাংলাদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান এটি ব্যাবহার করতে চাইলে আমি সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব।

বিজ্ঞাপন

দেশি পত্র-পত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পেজগুলোতে যেভাবে নারীদের অবমাননা করা হয়, তা দেখে বিচলিত বোধ করেন বাশার। তিনি বলছেন, এই অ্যালগরিদম কেউ চাইলে ব্যক্তিগত টুইটার হ্যান্ডেল, ফেসবুক আইডি বা পেজের জন্যও ব্যবহার করে নিরাপদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিচরণ করতে পারবেন।

ফেসবুক, টুইটার বা ইনস্টাগ্রামের মতো জনপ্রিয় ও বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের হয়রানি হতে হয় প্রতিনিয়তই। এসব প্রতিষ্ঠান তাদের এই অ্যালগরিদমের বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে কি না— জানতে চাইলে বাশার বলেন, ‘এখনো কেউ দেখায়নি। তারা নিজেরা হয়তো নিজেদের মতো করে কোনো কৌশল ব্যবহার করে থাকে। তবে তারা নিতে চাইলে আমরা খুবই খুশি হব। যেকোনোভাবেই হোক, নারীর প্রতি বিদ্বেষের এমন নগ্ন প্রকাশ যেন না ঘটে, সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।’

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদায়লয়ের শিক্ষার্থী আবুল বাশার নিজেকে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। সেখানে পড়ালেখা শেষে যোগ দেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই আট বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যান পিএইচডি করতে। পিএইচডি শেষ করে এখন পোস্ট ডক্টরেট পর্যায়ে গবেষণা করছেন।

বাশার জানান, ছোট ছোট কিছু গবেষণার পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ায় এখন পর্যন্ত বড় বড় পাঁচটি গবেষণার অংশ ছিলেন তিনি। বর্তমানে কাজ করছেন করোনাভাইরাস তথা কোভিড-১৯ নিয়ে। বৈশ্বিক এই মহামারির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আবেগীয় পরিবর্তন এসেছে, তা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। নেতিবাচক আবেগ যেমন— ভয়, বর্ণবিদ্বেষ, রাগ, হতাশা এসবের প্রকাশ বেড়েছে। এসব চিহ্নিত করা ও সমাধান নিয়ে কাজ করছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন