বিজ্ঞাপন

‘যুব সমাজের অবক্ষয় রোধে নৈতিক শিক্ষা-উন্নত সংস্কৃতি চর্চা জরুরি’

October 3, 2020 | 2:52 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দেশকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে এবং একটি মানিবক-আদর্শিক-উন্নত সমাজ গঠনের জন্য যুব সমাজের অবক্ষয় রোধ অত্যন্ত জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংসদ সদস্যরা। এ জন্য সবার আগে যুবকদেরকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং  উন্নত সংস্কৃতিক চর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার তাগিদ দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি ধর্মান্ধতা ও স্বার্থপরতা থেকে যুবকদেরকে যত দূরসম্ভব দূরে রাখার উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

শনিবার (৩ অক্টোবর) দুপুরে ‘ধ্রুবতারা ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন’ এবং ‘অ্যাকশন এইড বাংলাদেশে’র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘ডায়ালগ উইথ পলিসিমেকার’ শীর্ষক ওয়েবনিয়ারে তারা এসব প্রস্তাব দেন।

ধ্রুবতারা ইয়ুথ ডেভেলপমেন্টে ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অর্ক চক্রবর্তীর পরিচালনায় ও অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের ব্যাবস্থাপক নাজমুল আহসানের সঞ্চালনায় ওয়েবনিয়ারে অংশ নেন সাবেক সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আক্তার, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য জাকিয়া তাবাসসুম জুই, বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ, জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য অ্যারোমা দত্ত, যুব অধিদফতরের মহাপরিচালক আখতারুজ্জামান খান কবির, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. শাহ আজমসহ অন্যরা।

আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৯০ ভাগই ছিল যুবক এবং তাদের বেশিরভাগই ছিল লেখাপড়া না জানা গ্রামের সাধারণ মানুষ। আমরা যারা লেখাপড়া জানা মানুষ, তারা সাধারণত দেশপ্রেম, মানবতাবোধ নিয়ে বেশি আলোচনা শুনি, কথা বলি, দীক্ষা গ্রহণ করি। কিন্তু গ্রামের সাধারণ একজন লেখাপড়া না জানা যুবকের পক্ষে এটা বোঝার কথা না। রণাঙ্গনে আমরা তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করতাম, দেশপ্রেমের এই দীক্ষা কোথায় পেলে? তখন তারা একটা কথাই বলতেন, ‘শেখ সাহেবের (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) কাছ থেকে পেয়েছি।’ অর্থাৎ সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে একজন ‘মহামানব’ শেখ মুজিব যে উদ্দীপনা তৈরি করতে পেরেছিলেন, সেটিই বড় কথা।”

বিজ্ঞাপন

‘কিন্তু আজ আমরা সেটা পারছি না কেন? আমরা দেখছি— একটা কলেজে এক দম্পত্তি বেড়াতে যাচ্ছে, সেখানে স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। এই যে একটা নৈতিক অধঃপতন হয়েছে, সেটি কেন? সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই কঠোর ব্যবস্থার পাশাপাশি যেটি দরকার, সেটি হলো নৈতিক শিক্ষা, উন্নত সংস্কৃতি চর্চা, ধর্মান্ধতা ও স্বার্থপরতা থেকে যুবকদের দূরে রাখা। সত্যিকার মানুষ তৈরির কাজটা কীভাবে হবে, সেটি নিয়ে চিন্তা করা,’— বলেন আসাদুজ্জামান নূর।

তিনি বলেন, ‘শুধু জয়বাংলা স্লোগান দিলে হবে না। এই স্লোগানের মর্মবাণী হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। এর গভীরে ঢুকতে হবে। যুবকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিন, একটু লেখাপড়া করছ, প্যান্ট পরতে শিখেছ, তাই বলে বাবার সঙ্গে হাল ধরতে লজ্জা কোরো না, বাবাকে সাহায্য করতে দ্বিধা কোরো না, বাড়ির পাশে পতিত জমিতে ক’টা বেগুন গাছ লাগাও, লাউ গাছ লাগাও, পঞ্চাশটা মরিচ গাছ লাগাও। তাতে তোমাদের দুই/তিনশ টাকা আয় হবে। ওটা দিয়ে বই কিনতে পারবে। নিজের খরচ চালাতে পারবে। আর স্বাধীনতার শত্রুদের সম্পর্কে সচেতন থাকবে। ওরা সুযোগ পেলেই ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।’

‘আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ আজও প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে তার যোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। বলতে গেলে একাই লড়ছেন। তাকে হত্যা করার জন্য বার বার চেষ্টা কর হয়েছে,’— বলেন আসাদুজ্জামান নূর।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘আমদের দেখতে হবে, যুব শ্রেণির জন্য সমান প্ল্যাটফর্ম দিতে পারছি কি না। গ্রামের একটা ছেলে সাধারণ স্কুলে পড়বে, শহরের একটা ছেলে ইংরেজি মিডিয়ামের পড়বে। এরা যখন চাকরিতে প্রবেশ করবে, তখন সমান সুযোগ পাবে না।’

আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘লেখাপড়া যেভাবে শেখানো হচ্ছে— মা-বাবা থেকে শুরু করে শিক্ষরাও চান ছেলে-মেয়েরা শুধু ভালো রেজাল্ট করুক। নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মানবতার বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। ফলে আজকে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে গেছে, শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। শিক্ষকরাই বলে দেন, গত বছর এই প্রশ্নগুলো আসছে, এবার আসবে না। এই চ্যাপ্টার বাদ দিয়ে পড়ো। অর্থাৎ অসম্পূর্ন্নণ শিক্ষা, তার সঙ্গে সংস্কৃতি চর্চার অভাব।

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা বাঙালি, দ্বিতীয় পরিচয় আমরা একেকজন একেক ধর্মের মানুষ। হলি আর্টিজানে যারা ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা শিক্ষিত নয়? ময়মনসিংহে যারা ঘটনা ঘটালো, তারা শিক্ষিত নয়? সুতরাং একাডেমিক শিক্ষা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা আর উন্ন সংস্কৃতি চর্চা।’

জাসদের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সসদ্য শিরিন আক্তার বলেন, ‘যুবরা লড়বে, নতুন পৃথিবী গড়বে। কিন্তু সেই যুবকদের অবস্থা এখন কী? যুব সমাজকে একটা আদর্শিক জায়গায় যদি আমরা না নিতে পারি, যদি একটি দর্শনের জায়গায় আমরা নিতে না পারি, তাহলে এগোতে পারব না।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘যুবকদের মনন জগৎটা তৈরি করা, নীতি আদর্শ ও মূলবোধের দিকে ধাবিত করা, সব ধরনের ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তাদেরকে দাঁড়াতে শেখানো, সর্বোপরি তাদের দৈহিক, মানসিক জগৎটা যেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে না পড়ে, সেদিকটা লক্ষ রাখতে হবে।’

শিরিন আক্তার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার মধ্য দিয়ে কিছু লক্ষ্যমাত্রা তৈরি করে সেদিকে এগোচ্ছেন। এমন একজন নেতা আমরা পেয়েছি, সমগ্র পৃথিবী যাকে সবচেয়ে যোগ্য, সাহসী, পরিশ্রমী, সৎ নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু আমরা কী করছি? এমন যোগ্য নেতা সামনে থাকার পরও একটা সৎ, সাহসী, নীতিবান, আদর্শ যুব সমাজ গড়ে উঠছে না। আজ যুবকদের দ্বারা নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।’

যুবনীতি কার্যকর বা বাস্তবায়ন কীভাবে হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘যারা এটা বাস্তবায়ন করছে, তারা বিষয়টি কীভাবে দেখেন সেটিও ভেবে দেখার বিষয়। তারা কি শুধু রেজাল্টের পেছনে ছুটছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে ছুটছেন? নাকি যুবকদের ভেতরে নৈতিক, আদর্শকি দিকটির বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করছেন? শুধু দক্ষ জনশক্তি নয়, আদর্শ জনশক্তি, আদর্শ যুবশক্তি প্রয়োজন।’

সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, যুব সমাজই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আমরা একসময় যুবক ছিলাম, এখন বৃদ্ধ। আজ যারা যুবক, আগামীতে তারা বৃদ্ধ হবে। তাদের হাতে দায়িত্ব পড়বে দেশ চালানোর। সুতরাং তাদের এমনভাবে গড়তে হবে, যাতে আমরা তাদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারি।’

‘সেই জন্য যুব সম্প্রদায়কে সেই আদর্শিক জায়গায় নিতে হবে। নৈতিকতাবোধ, মানববতাবোধে তাদেরকে জাগ্রত হতে হবে। আমি মনে করি, বেশিরভাগ যুবকই ভালো চিন্তা করে, ভালো কাজ করে। আর কিছু কিছু যুবক খারাপ কাজ করছে। সমাজকে, দেশকে রাষ্ট্রকে অত্যন্ত কলঙ্কিত করছে। এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে আমাদের কী করতে হবে, সেটা ভাবা দরকার,’— বলেন সাবেক এই মন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় তো লেখাপড়া শিখে মানুষ আদর্শবান হয়েছে। কিন্তু এখন হচ্ছে না, কারণটা কী? আমরা ডিজিটালে যুক্ত হয়ে অনেক কিছুই শিখেছি। আবার খারাপ অনেক জিনিসও শিখছে। এমনটা কেন হচ্ছে, সেটা নিয়ে ভাববে হবে। অনেকে বলছেন নৈতিকতার অভাব, অনেকে বলছে ধর্মীয় চেতনাবোধের অভাব।  আমিও মনে করি যুবসমাজকে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের সামনে যে প্রধান বাধা, সেটা নৈতিকতার অবক্ষয়। এই অবক্ষয়কে দূর করতে পারলে যুব সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তাদের আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রত্যয় বাড়াতে হবে।’

জাতীয় পার্টির সংসদ সসদ্য ফখরুল ইমামম বলেন, ‘সাধারণত ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মানুষগুলোকেই যুবক হিসেবে ধরা হয়। এই যুবকরাই সব সময় ভালো কাজে এগিয়ে আসে। কারণ, এই সময়টাতে তারা আদর্শের বাইরে যেতে চায় না। যেটা তারা বোঝেন, সেটাই করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যুবকরাই নেতৃত্ব দিয়েছে। তারপর আর কোনো সময় যুবকদের এক জায়গায় করে আর কোনো কাজ হয়েছে কি না, তারা আমার  জানা নাই।’

তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে যুবনীতি করা হয়েছে। তার মিশনটা কী ছিল? অনেক সুন্দর কথা বলা হয়েছে এই যুবনীতিতে। কিন্তু আমরা কী করছি? এই যুবনীতি বাস্তবায়ন করতে পারলে যুবকদের নিয়ে আমাদের যে স্বপ্ন, সেটা বাস্তবায়ন হবে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে এই যুবনীতিটা বাস্তবায়ন করার।’

সারাবাংলা/এজেড/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন