বিজ্ঞাপন

পরীক্ষার্থীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া, শিক্ষাবিদেরা বলছেন ‘সময়োপযোগী’

October 7, 2020 | 9:57 pm

তুহিন সাইফুল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা বাতিল হওয়ার খবরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দীর্ঘ দিন ধরে অপেক্ষায় থাকা পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। পরীক্ষার্থীদের কেউ কেউ এরকম একটি বড় পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারার আক্ষেপেও ভুগছে। তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, সময়ের প্রয়োজনে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত স্বস্তিদায়ক হলেও এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের পরবর্তী মূল্যায়ন পদ্ধতিটি যেন ভালোভাবে হয়, সেদিকে মনোযোগী হতে বলছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (৭ অক্টোবর) ‍দুপুরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সংবাদ সম্মেলন থেকে জানা যায়, এ বছর আর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। এ বড় একটি পাবলিক পরীক্ষা আয়োজনের যে ব্যাপকতা, করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) চলমান সংক্রমণ পরিস্থিতিতে সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় বলেই এই সিদ্ধান্ত। পরীক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাবিদসহ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে— জানান শিক্ষামন্ত্রী।

এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের খবর প্রকাশ হলে যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে শর্মিষ্ঠা নমো। কারণ করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে ঘরবন্দি অবস্থায় শত চেষ্টাতেও মনোযোগ ধরে রাখতে পারছিল না এই শিক্ষার্থী। উল্টো অনেক পড়া এতদিনে ভুলেও গেছে! আজিমপুর গার্লসের এই শিক্ষার্থীর বক্তব্য— ‘এখন পরীক্ষা হলে ভালো ফল করা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ত। কারণ কয়েক মাসের পাঠ বিরতির প্রভাব তো থাকবেই।’ তবে জেএসসি ও এসএসসিতে ভালো ফল থাকায় কিছুটা স্বস্তিও কাজ করছে শর্মিষ্ঠার মধ্যে। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ পর্যন্ত না হওয়ায় কিছুটা ঘাটতি থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে এই ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে অভিমত তার।

এইচএসসি নিয়ে আরও খবর-

এইচএসসির ‘ফল’ ডিসেম্বরে, অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে মূল্যায়ন কমিটি

বিজ্ঞাপন

এদিকে, পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী এ-ও জানান, পরীক্ষা না হলেও আগের দুই পাবলিক পরীক্ষা— এসএসসি ও জেএসসি কিংবা এর সমমান পরীক্ষাগুলোর ফলের ওপর ভিত্তি করে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। ফলে আগের দুই পরীক্ষায় ভালো ফলধারীদের মধ্যে স্বস্তি থাকলেও ওেই দুই পরীক্ষায় যাদের ফল খারাপ ছিল, তারা এইচএসসির জন্য ভালো প্রস্তুতি নেওয়ায় কিছুটা হতাশ বটে।

ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি কলেজের তুহিন যেমন পুরোপুরি খুশি হতে পারছে না পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণায়। এর কারণ অবশ্য তার আগের দুই পাবলিক পরীক্ষার ফল। জেএসসিতে অসুস্থতার কারণে ভালো ফল হয়নি, এসএসসিতেও মন্দের ভালো— সিজিপিএ সাড়ে ৪। অথচ এইচএসসি’র জন্য খুব ভালো প্রস্তুতি ছিল তার। তুহিনের ভাষ্য, ‘ইন্টারমিডিয়েটের ইনকোর্স পরীক্ষাগুলো বিবেচনায় নিলেও ভালো হতো। ফল বাড়ত। আমার প্রস্তুতি ভালো। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থেকেছি লকডাউনের সময়। অন্য কোনো কাজ না থাকায় প্রস্তুতিও ভালো হয়েছে। কিন্তু এখন তো পরীক্ষাই হচ্ছে না!’

তবে দেরি করে পরীক্ষা নেওয়ার তুলনায় বাতিলের এই সিদ্ধান্তকে ‘তুলনামূলকভাবে ভালো’ বলে মনে করছে তুহিন। বাণিজ্যের এই শিক্ষার্থীর বক্তব্য, এতে করে অন্তত একবছর পিছিয়ে পড়তে হবে না।

বিজ্ঞাপন

তুহিনের বন্ধু উদয়নের শিক্ষার্থী রাসেল কষ্ট পাচ্ছে একটি ভিন্ন কারণে। পরীক্ষা না হওয়ায় একটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা বঞ্চিত হতে হচ্ছে তাকে। এই আক্ষেপ তুলে ধরে রাসেল বলছে, ‘এইচএসসি দেবো, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবো— এরকম চিন্তা সবসময় আমার মাথায় ঘুরপাক খায়। কিন্তু করোনার কারণে  এইচএসসি পরীক্ষাটাই দেওয়া হলো না। এখন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতেও যদি কোনো কারণে পরীক্ষা না হয়, তাহলে মুশকিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি তো জীবনের অনেক বড় একটি বিষয়। জানি না কী হবে! তবে আশা করছি ফল ভালো হবে।’

শিক্ষার্থীদের মতো অভিভাবকেরা অবশ্য এতটা মিশ্র মত দেননি সারাবাংলাকে। তাদের মোট দু’টি পক্ষ— এসএসসি-জেএসসিতে যাদের সন্তানদের ফল ভালো, তারা খুশি; ‍মুখ বেজার তাদের, যাদের সন্তানদের আগের দুই পাবলিক পরীক্ষার ফল আশানুরূপ নয়। তবে প্রায় অভিভাবকরাই বলছেন, এইচএসসি’র মূল্যায়নের জন্য যেন নিখুঁত কোনো পদ্ধতি বের করা হয়। এসএসসি-জেএসসি’র পাশাপাশি কেউ কেউ এইচএসসি’র নির্বাচনি পরীক্ষা, এমনকি প্রথম বর্ষের মূল্যায়ন পরীক্ষার ফল বিবেচনায় নেওয়ার পক্ষ মত দিচ্ছেন তারা। কেউ কেউ এসএসসি বা জেএসসি নয়, উচ্চ মাধ্যমিকের নির্বাচনি বা প্রথম বর্ষের মূল্যায়ন পরীক্ষা কিংবা উভয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে মূল্যায়নের পক্ষে মত দিচ্ছেন।

পরীক্ষার্থী বা অভিভাবকরা তো সরাসরি এইচএসসি পরীক্ষার সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বার্থে সম্পর্কযুক্ত। এর বাইরে শিক্ষাবিদরা কী মনে করছেন এইচএসসি বাতিলের সিদ্ধান্তকে? মোটা দাগে তারা সন্তোষ জানিয়েছেন এই সিদ্ধান্তে।

জানতে চাইলে রাশেদা কে. চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, এইচএসসি বাতিলের সিদ্ধান্তটি সময়ের প্রয়োজনে নিতে হয়েছে। এই ঘোষণাটি আসা জরুরি ছিল। এখন অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। এই অনিশ্চয়তার কারণে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে কষ্টে ছিল। এখন আর সেটি থাকবে না। এটি সরকারের পক্ষ থেকে একটি ভালো সিদ্ধান্ত।

বিজ্ঞাপন

ফলপ্রকাশ বা মূল্যায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসএসসি ও জেএসসি ফল বিবেচনায় নেওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক। এর পাশাপাশি কলেজের মূল্যায়ন পরীক্ষার ফলও বিবেচনায় নিলে কোনো সমস্যা থাকার কথা না। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পরীক্ষা তো লাগবেই। সেই পরীক্ষাটি বিশদভাবে নিতে পারলে পরীক্ষা না নেওয়ার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে। তাদের মূল্যায়নও যথার্থ হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ তাহমিনা হক সারাবাংলাকে বলেন, পরীক্ষা বাতিলের এই সিদ্ধান্তটি সঠিক। কারণ পরীক্ষার্থীদের নিশ্চয় প্রস্তুতি ছিল, তারা নিয়মিত পড়ালেখার মধ্যেও ছিল। ফলে পরীক্ষা না হলেও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কারণ তাদের শিক্ষণ প্রক্রিয়াটি আসলে শেষ।

ঢাবি’র এই অধ্যাপকও পরবর্তী মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সতর্ক থাকার দিকে নজর রাখতে বলছেন— ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন অবশ্যই গুণগত মান বজায় রেখে তৈরি করতে হবে। তাহলে তাদের মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন থাকবে না। আরেকটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে— বিদেশে যারা পড়তে যেতে চায়, তাদের যেন কোনো ঝামেলায় না পড়তে হয়।’

এর আগে, এ বছরের ১ এপ্রিল থেকে সারাদেশে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরুর দিনক্ষণ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ২৩ দিন আগে ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরে পরীক্ষা শুরুর দিন দশেক আগে ঘোষণা দেওয়া হয়, এইচএসসি পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত।

এরপর দেশে করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় দফায় দফায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়কাল বাড়তে থাকে। সবশেষ ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে বারবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এইচএসসি আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। পরীক্ষা শুরুর পূর্বনির্ধারিত তারিখের ছয় মাস পর এসে শেষ পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানালো, এ বছর আর পাবলিক এই পরীক্ষাটি আলোর মুখ দেখবে না। এর ফলে ১৩ লাখ ৭৮৯ জন পরীক্ষার্থীকে আর এইচইসসি, আলিম বা সমমান পরীক্ষার টেবিলে বসতে হচ্ছে না।

সারাবাংলা/টিএস/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন