বিজ্ঞাপন

ওয়েলকাম ব্যাক সাকিব ‘দ্য সুপারম্যান’

October 28, 2020 | 11:58 pm

মহিবুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

গেলো বছরের ২৯ অক্টোবরের সূর্যটি সাকিবের জন্য কী দুঃসহ এক বারতাই না বয়ে এনেছিল। সকাল হতেই দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে বড় বড় হরফে শিরোনাম— ‘৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হচ্ছেন সাকিব’। কেউ বলেছিলেন— দুই বছরের জন্য আবার কেউবা লিখেছিলেন তিন বছর। আসলে কত বছরের জন্য? সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে  দিনের প্রথম প্রহরেই শত শত ক্রীড়া সংবাদকর্মীরা গিয়ে জড়ো হলেন হোম অব ক্রিকেট মিরপুর শের-ই-বাংলায়। অধীর আগ্রহে আইসিসি’র সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করতে লাগলেন, যাতে মিশ্রিত ছিল উৎকণ্ঠা ও ভয়। দেশের ক্রিকেটের সবেধন নীলমণিকে না জানি কত দিনের জন্য হারাতে হয়।

বিজ্ঞাপন

এভাবে সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, এরপর সন্ধ্যা। এর ঠিক কিছু পরেই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি জানিয়ে দিল— জুয়াড়ির প্রস্তাব গোপন করায় দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ সাকিব আল হাসান। এর মধ্যে একবছর স্থগিত নিষেধাজ্ঞা। মুহূর্তেই দেশ ও বিদেশের সংবাদমাধ্যমে তা চাউর হয়। মর্মাহত হন লাল-সবুজের কোটি ভক্ত। ঠিক যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত।

এদিকে দেশ সেরা ক্রিকেটারকে এক বছরের জন্য হারানোর শোকে হতবিহবল হয় পড়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-বিসিবি। খবর পেয়ে আগেভাগেই সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ক্রিকেট বোর্ডে এসেছিলেন। সভাপতির কক্ষ থেকে সভা শেষে ওই বিষণ্ণ সন্ধ্যায়  একে একে  বেরিয়ে আসছিলেন ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান আকরাম খান, প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নুসহ ক্রিকেটে সংশ্লিষ্ট আরও অনেকেই। সবার মুখে যেন রাজ্যের অন্ধকার। ঠিক মহামূল্যবান কিছু হারালে অবয়ব যে রূপ ধারণ করে তেমন।

আধা ঘণ্টা বাদে কর্মক্ষেত্র বিসিবিতে এলেন সাকিব। বিসিবির অভ্যর্থনা কক্ষে তার ডান পাশে এসে দাঁড়ালেন সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন, মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস ও পরিচালক এনায়েত হোসেন সিরাজ। তাদের উপস্থিতিতে আইসিসির প্রটোকল অনুযায়ী সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে পাঠ করলেন লিখিত বক্তব্য।

বিজ্ঞাপন

তাতে লেখা ছিল, “খেলাকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। সেই খেলা থেকেই আমি নিষেধাজ্ঞা পেয়েছি। তবে অনৈতিক প্রস্তাবটি আকসু’কে না জানানোয় যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তা আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। ক্রিকেটকে দুর্নীতিমুক্ত করতে আইসিসি’র আকসু সবচেয়ে বেশি ভরসা করে ক্রিকেটারদের সহযোগিতার ওপরে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি আমার দায়িত্বটি পুরোপুরি পালন করতে পারিনি। শতকোটি ভক্ত ও খেলোয়াড়দের মতো আমিও চাই ক্রিকেট থাকুক দুর্নীতিমুক্ত। তাছাড়া আগামীর তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়রা যেন আমার মতো ভুল না করে সেজন্য আমি আইসিসির দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষামুলক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাব। আশা করব আপনারা আগে যেমন আমার পাশে ছিলেন আগামীতেও থাকবেন”।

বক্তব্য পাঠ শেষে চলে যান সাকিব। সেই যাওয়া এক-দুই দিনের জন্য নয়, পুরো ৩৬৫ দিনের জন্য। এর পরে নভেম্বরে ভারত সিরিজ গেলো, ডিসেম্বরে বিপিএল, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান সিরিজ, মার্চে জিম্বাবুয়ে এলো, কিন্তু তাতে অনুপস্থিত থাকলেন লাল সবুজের রাজপুত্র। খেলা দূরে থাক, নিষেধাজ্ঞার খড়গে পড়ে প্রিয়-প্রাঙ্গণ মিরপুর শের-ই বাংলার ত্রি-সীমানায়ও আসার উপায় ছিল না বিশ্বকাপে দেশের জন্য একাই লড়াই করে যাওয়া এই সুপারম্যানের।

নব উদ্যোমে ‘একুশ’ রাঙাবেন সাকিব

মার্চে দেশব্যাপী সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করল প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। সাকিব চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের কাছে। দেশ তখন আর্থিক মন্দায় জর্জরিত। তা দেখে ব্যথিত হলো তার হৃদয়। সেই ব্যথা নিয়ে অবশ্য চুপচাপ বসে থাকেননি নন্দিত এই অলরাউন্ডার। আর্তের পাশে দাঁড়াতে প্রতিষ্ঠা করলেন কল্যানমুলক প্রতিষ্ঠান-‘সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশন’।

বিজ্ঞাপন

শুধু কি তাই? ২০১৯ বিশ্বকাপে যে ব্যাট তাকে সুপারম্যানের তকমা এনে দিয়েছিল (৯ ম্যাচে ৬০৬ রান) তা নিলামে তুললেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক বাংলাদেশি তা ২০ লাখ টাক দামে কিনে নিলেন। সেই অর্থের পুরোটাই করোনায় দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দিলেন।

পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন দুর্নীতি-বিরোধী প্রচারণাও। এই একটি বছর ভীষণ সাবধানে কাটাতে হয়েছে সাকিবকে। কেননা এক বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারটিও তাকে মাথায় রাখতে হয়েছে। একটু পান থেকে চুন খসলেই আবার আরও একটি বছর হারিয়ে যাবে। না, সেটা মোটেও হতে দেননি লাল সবুজের ক্রিকেটের এই পোস্টার বয়। বরং নিজেকে নিরাপদে রেখেছেন সর্বোচ্চ সতর্কতায়। আইসিসি নির্দেশ দিয়েছিল যেন এই নিষেধাজ্ঞার সময়ে মিডিয়ার সঙ্গে তিনি যত্রতত্র কথা না বলেন বেড়ান। এই নির্দেশনাও অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।

নিষেধাজ্ঞার সময়ে সাকিব কতটা সতর্ক ছিলেন তা একটি উদাহরণ থেকে স্পষ্ট হবে। অক্টোবরে শ্রীলংকা সিরিজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে ২ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরেন সাকিব। এসেই সোজা বিকেএসপিতে চলে যান। দেশের একমাত্র ক্রীড়া শিক্ষা একাডেমীতে প্রিয় দুই মেন্টর নাজমুল আবেদীন ফাহিম ও মোহাম্মদ সালাউদ্দিন এর অধীনে চলে তার রুদ্ধদ্বার অনুশীলন।

মিডিয়া তো নয়ই, বিকেএসপির কোনো শিক্ষার্থী ও তার সেই অনুশীলনের চৌহদ্দি ঘেঁষতে পারেননি। প্রায় একমাস নিবিড় অনুশীলন চালিয়ে যাওয়ার পর যখন জানতে পারলেন কোয়ারেনটাইন ইস্যুতে শ্রীলংকা সরকারের অনড় অবস্থানের কারণে তিন ম্যাচ সিরিজের টেস্ট আপাতত স্থগিত করা হয়েছে, তখন আবার ফিরে গেছেন প্রিয় পরিবারের কাছে। ইতিমধ্যে তার পরিবারের নতুন আরেক সদস্য এসেছে। বড় মেয়ে আলাইনা হাসানের সঙ্গে কিছুটা সাযুজ্য রেখে নতুন অতিথির নাম রাখা হয়েছে ইররাম হাসান।

বিজ্ঞাপন

পরিবারে নতুন অতিথির আগমনে সাকিবের পরিবার আরও আনন্দঘন হয়ে উঠল। ঠিক যেন সাক্ষাৎ চাঁদের হাট। সুখের সীমা নেই, কষ্টের লেশমাত্রও নেই। তবে কষ্ট বলতে ছিল শুধু প্রিয় ক্রিকেট থেকে দূরে থাকা।

সময়ের পরিক্রমায় সেই কষ্টও শেষ। আজ রাত ঠিক ১২ টায় আবার ক্রিকেটে ফিরলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক প্রথম-এর নায়ক সাকিব আল হাসান।

ওয়েলকাম ব্যাক, সুপারম্যান।

তার ফেরায় স্বস্তি ফিরেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, জাতীয় দলের নির্বাচকমণ্ডলী, সাবেক ও বর্তমান ক্রিকেটারদের মাঝে। সাকিবের প্রত্যাবর্তনে স্বস্তি প্রকাশ করে বিসিবির সিইও নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সুজন সারাবাংলা কে জানালেন, “অবশ্যই এটা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের জন্য একটা বড় স্বস্তি। তবে শুধু ক্রিকেট বোর্ডই নয়, আমি মনে করি এটা পুরো দেশের ক্রিকেট অনুরাগীদের জন্য অনেক বড় সুখবর ও স্বস্তির খবর”।

এদিকে জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, “খুবই ভালো খবর সাকিব ফিরছে। ফিরে সে ঘরোয়া ক্রিকেট (মধ্য নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় ৫ দলের টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট) খেলবে।  এক বছর সে কোনো খেলার মধ্যে ছিল না। এখন ফিরেও ঘরোয়া ক্রিকেট দিয়ে আবার শুরু করবে। একটি দলের সেরা ক্রিকেটার ফিরছে এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে?”

স্বস্তি ঝরলো লাল সবুজের সাবেক অধিনায়ক ও নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য হাবিবুল বাশার সুমনের কণ্ঠেও। “সত্যি বলতে কী, এটা অনেক বড় স্বস্তি। সাকিব দলে থাকা মানে একের মধ্যে তিন তো অবশ্যই, সে আমাদের সেরা পারফরমার। ও দলে থাকলে কন্ডিশন অনুযায়ী আমাদের টিম কম্বিনেশন যেকোনো দিকে শক্তিশালী করা যায়। বোলিং পিচে ব্যাটসম্যান বেশি নেওয়া যায়। আবার ব্যাটিং পিচে বোলার বেশি নেওয়া যায়। ও দলে আছে মানেই একটা বাড়তি সুবিধা। ও দলে আসা মানে দলের আত্মবিশ্বাসটা অনেক বেড়ে যাওয়া”।

হাবিবুল বাশারের মতোই ভাবছেন টাইগার টেস্ট দলপতি মমিনুল হকও। সুপারম্যানের ফেরা মানেই যেন দলে স্বস্তি ও আত্মবিশ্বাস দুই-ই ফিরে আসা।

“এটা শুধু আমি একা নয়, পুরো বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য সুখবর। এমনকি আপনাদের জন্যও। সাকিব ভাই ফিরছে মানে এটা দলের জন্য স্বস্তির তো অবশ্যই, অনেক বড় আত্মবিশ্বাসের খবরও। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা পাওয়া”— বলেন মমিনুল হক।

মধ্য নভেম্বরে ৫ দলের অংশগ্রহণে শুরু হতে যাচ্ছে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। সেখানে তার অংশ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। এই লক্ষ্যে নভেম্বরের ১০ তারিখে সাকিবের দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

সারাবাংলা/এমআরএফ/আইই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন