বিজ্ঞাপন

স্বামীদের কাজে ফেরানোর কথা দিয়ে নারীভোট হারাবেন ট্রাম্প!

October 29, 2020 | 10:34 pm

কারা অ্যালামিও

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার (২৭ অক্টোবর) মিশিগানে নির্বাচনি জনসভায় নারী ভোটারদের কাছে ভোট চান। এসময় তিনি তাদের করোনার কারণে চাকরি হারানো স্বামীদের কাজে ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট প্রার্থনা করেন। নারীদের প্রতি অবমাননাকর এই বক্তব্য নিয়ে আমেরিকাজুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল সমালোচনা। এদিকে এক ভিডিও বার্তায় ফার্স্টলেডি মেলানিয়া ট্রাম্প তার স্বামীর পক্ষ নিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নারী কর্মসংস্থানের জন্য অনেক কাজ করেছে। কিন্তু এতে কি ফিরবে আমেরিকান নারী ভোটারদের মন? তারা কী আর বিশ্বাস করতে পারবেন বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে যেখানে করোনা মহারমারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তারাই। শুধুমাত্র চাকরি হারিয়েছেন তা না, ঘরে আটকা পড়ে পরিবারের সবার দেখাশনাসহ গৃহস্থালি কাজের চাপও তাদেরই সামলাতে হচ্ছে যা তাদের ভবিষ্যত কর্মজীবনের জন্য পিছিয়ে দিচ্ছে অনেকটাই। 

বিজ্ঞাপন

হফস্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক রিলেশন অধ্যাপক কারা অ্যালামিও সিএনএন– এ এক মতামত প্রতিবেদনে এ বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি ওবামা সরকারের সময় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

সারাবাংলার পাঠকদের জন্য লেখাটি ভাষান্তর করেছেন সারাবাংলার সিনিয়র নিউজরুম এডিটর রাজনীন ফারাজানা।

মঙ্গলবার মিশিগানে নির্বাচনি প্রচারণার সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শহরতলীর নারী ভোটারদের কাছে তাদের স্বামীদের কাজে ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যেখানে করোনাকালে প্রচুর নারী কর্মহীন হয়েছেন। স্বামীদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার ফলে সব নারীদের ভোট তার প্রাপ্য বলে মনে করেন তিনি। এই কথার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজের বিশ্বাস তুলে ধরেছেন। কী সেই বিশ্বাস! ট্রাম্পের ধারণা প্রতিটি নারীর স্বামী আছে বা থাকা উচিৎ এবং প্রতিটি কর্মস্থলে শুধু পুরুষরাই কাজ করেন। তার কথাটি যে কতটা ‘সেক্সিস্ট’ এবং সেকেলে তা তিনি নিজেও জানেন বলে মনে হয় না। বর্তমানে আমেরিকান নারীরা আসলে কতটা এগিয়ে এসেছেন তার কোন ধারণাই রাষ্ট্রপ্রধানের নাই। আজকের যুগের আমেরিকান নারীদের তাই সতর্ক হতে হবে পরবর্তী রাষ্ট্রক্ষমতা কার কাছে যাবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে। কারণ, একজন রাষ্ট্রপতি তাদের অবস্থানের স্বীকৃতি দেবে ও তাদের অবস্থান সঠিকভাবে তুলে ধরবেন, এটিই তাদের চাওয়া হওয়া উচিত।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- তোমাদের স্বামীদের কাজে ফেরাব, নারীদের উদ্দেশে ট্রাম্প

এই সমাবেশের আগ থেকেই আমেরিকান নারীরা ট্রাম্পের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন অনেকটা। সিএনএনের নির্বাচন-পূর্ববর্তী জরিপে এমনটাই উঠে এসেছে। এমনকি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের প্রতি সাদা আমেরিকান নারীদের সমর্থন গতবারের ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের চেয়েও ১৮ শতাংশ বেশি।  আর ট্রাম্পের তুলনায় তো অনেকটাই বেশি। ট্রাম্পের এই সর্বশেষ মন্তব্যে তিনি নারী ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়তাহীনতার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছেন বলেই মনে হচ্ছে।

ট্রাম্প আসলে এতদিন নারী ভোটারদের কতভাবে চটিয়েছেন, গত মঙ্গলবারের আগে তার স্পষ্ট ধারণা ছিল না আমাদের। এর আগে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে দুই ডজনের বেশি নারী যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেছে যা তিনি অস্বীকার করেন। এমনকি শারীরিকভাবে আক্রমণের রেকর্ড থাকার ও তা ছড়িয়ে পড়ার পরেও তিনি সেসব অভিযোগ থেকে সহজেই পার পেয়েছেন। নিয়মিতভাবেই তিনি নারীদের নানাভাবে অবজ্ঞা ও ছোট করেছেন। এর থেকে বাদ যায়নি তার নিজের মেয়েও। প্রায়ই তিনি মেয়ে ও স্ত্রীর ব্যক্তিগত প্রাপ্তিকে অবজ্ঞা করে তাদের চেহারা ও সৌন্দর্য নিয়েই কথা বলেছেন বেশি। এমনকি তাদের ডেকেছেন নানা অবজ্ঞাসূচক উপমায়। কিন্তু এর আগে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদের নারীদের ‘ন্যাস্টি’ অর্থাৎ নোংরা বলার পরেও আমি তার পক্ষেই বলেছিলাম। তাকে উগ্র পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার (মিসোজিনিস্ট) বললেও লিঙ্গ বৈষম্যকারী (সেক্সিস্ট) হিসেবে ভাবিনি তখন। কিন্তু মঙ্গলবারের ঘটনায় ট্রাম্প প্রমাণ করলেন তিনি আসলে দুটোই।

বিজ্ঞাপন

কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক কেইট মেইনের মতে একজন মিসোজিনিস্ট তার কথামত না চলা নারীদের শাস্তি দিয়ে থাকেন। আর সেক্সিস্ট ব্যক্তি মনে করেন তিনি নারীদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ তা ব্যবসা হোক কি খেলাধুলা। ট্রাম্পের আচরণ আসলে অনেক আগেই এসব কথার সত্যতা প্রমাণ করেছে।

মিশিগানে নারী ভোটারদের উদ্দেশ্যে করা মন্তব্যের আগে ট্রাম্পের সেক্সিস্ট আচরণের প্রমাণ সেভাবে পাওয়া যায়নি। তার উপর তিনি প্রশাসন এবং ট্রাম্প অর্গ্যানাইজেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু শহরতলীর নারীদের কাছে ভোট চাওয়ার কারণ হিসেবে তাদের স্বামীদের কর্মস্থলে ফেরানোর প্রতিজ্ঞা প্রমাণ করে ট্রাম্প আসলে মনে করেন কর্মস্থল পুরুষদেরই জায়গা, নারীর নয়। এটি সেক্সিস্ট আচরণের একদম খাটি উদাহরণ।

শুধু তাই নয়, প্রতিটি নারীর স্বামী আছে বা থাকতেই হবে- ট্রাম্পের এই ধারণাও ভীষণভাবে আপত্তিকর ও পশ্চাৎগামী যেখানে অনেক নারীই অবিবাহিত বা বিয়ে করতে ইচ্ছুক নন। এদেশে অবিবাহিত নারীর সংখ্যাও কিন্তু কম না। ‘উওমেন’স ভয়েসেজ উওমেন ভোট অকশন ফান্ডে’র জরিপ অনুযায়ী আমেরিকার মোট জনসংখ্যার পঁচিশ শতাংশই অবিবাহিত নারী।

ট্রাম্পের এই সেক্সিস্ট মন্তব্যই আসলে অবাক হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, বরং সমগ্র আমেরিকাজুড়েই নারীদের কতটা বিপন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তা বোঝা যায় এর মাধ্যমে। ট্রাম্প ‘স্বামীদের’ কাজ দিতে চান। এদিকে বাস্তবতা হল বিপুল সংখ্যক নারী কর্মচ্যুত। ‘ন্যাশনাল ল সেন্টারে’র মতে, শুধুমাত্র আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই এগারো লাখ ব্যক্তি কর্মচ্যুত হন বা কাজ ছাড়েন যাদের মধ্যে আট লাখই নারী।

বিজ্ঞাপন

আইএমএফের এক হিসেব অনুযায়ী নারীরা শুধু কর্মচ্যুতই হননি, বরং ঘরে আটকা পড়ায় তাদের কাজের চাপ বেড়েছে অনেক গুন। এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধু বন্ধই না, চলছে হোমস্কুলিং। তাই অতিমারির সময় সন্তানদের লেখাপড়ার দিকটা দেখা ছাড়াও ঘরের সব কাজ, সবার পরিচর্যা নারীকেই করতে হচ্ছে। এইযে কর্মচ্যুত হওয়া বা চাকরি ছেড়ে দেওয়া- উভয়ের ফলেই পরবর্তীতে কাজ পাওয়া নারীর জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
এর ফলে শুধু নারীরাই যে ক্ষতগ্রস্ত হচ্ছেন বা হবেন তা না, দেশ হিসেবে আমেরিকাই বিপদের মুখে পড়তে যাচ্ছে। কারণ, এর ফলে নারীদের দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান বা গুরুত্বপূর্ণ পদের নারীর সংখ্যা হ্রাস পাবে। অথচ বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে নারীদের দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান বেশি লাভজনক। এমনকি যেসব প্রতিষ্ঠানে নারী ও বিভিন্ন জাতির কর্মী বেশি, তারাও অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে বেশি। ম্যাককিনসি অ্যান্ড কোম্পানি নামের এক কনসাল্টিং ফার্মের জরিপে এমনটাই দেখা গেছে। কিন্তু এর জন্য প্রতিষ্ঠানপ্রতি এক বা দুজন নয়, গবেষণায় দেখা গেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ নারী থাকলেই সেই প্রতিষ্ঠান ভালো করে। তাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মী কমে গেলে তা সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলবে। ব্যবসায়ী হিসেবে সফল একজন রাষ্ট্রপতির এই স্বাভাবিক সত্য অনুধাবন করতে না পারা হতাশাজনক।

যাই হোক, ট্রাম্প হয়ত এটা বুঝতে পারছেননা যে নারীদের উদ্দেশ্যে তাদের স্বামীদের কাজ ফিরিয়ে দেওয়ার মন্তব্য কতখানি অপমানজনক, কিন্তু নারীরা অন্তত তাদের প্রেসিডেন্টের চিন্তা-ধারা বুঝতে সক্ষম হবেন এর মাধ্যমে। তিনি যে চান নারীরা সব বিয়ে করুক আর বাইরের কাজে থাক শুধু পুরুষ, এই কথার অপমানটা উপলব্ধি করুক নারীরা। আমার আশংকা নারীরা না এটি অনুধাবন করে তিন তারিখ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে তাকে হোয়াইট হাউস থেকেই বের করে দেয়!

সারাবাংলা/আরএফ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন