বিজ্ঞাপন

বিক্ষোভের ডাক, ‘পিঠ দেওয়ালে’ বললেন রানা দাশগুপ্ত

November 3, 2020 | 6:02 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ধর্ম অবমাননার কল্পিত অভিযোগ তুলে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলাসহ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার-হয়রানি বন্ধের দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত বলেছেন, ‘আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। এখন সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।’

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রানা দাশগুপ্ত আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, ৭ নভেম্বর সকাল ১০টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত সারাদেশে জেলা-উপজেলা, মহানগর ও বিভাগীয় শহরের মূল সড়কের সংযোগস্থলে গণঅবস্থান এবং বিক্ষোভ মিছিল করা হবে। ঢাকায় শাহবাগ চত্বরে এবং চট্টগ্রামে নিউমার্কেট চত্বরে এই কর্মসূচি পালন করা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতাকে পেছনে ফেলে এগোনোর প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। কিন্তু এরপরও ২০১১ সাল থেকে আমরা এদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্প্রদায়িতকতার শিকার হচ্ছি। ফেসবুক হ্যাক করে, ভুয়া স্ক্রিনশট তৈরি করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা গুজব রটিয়ে কক্সবাজার-রামু-উখিয়া-টেকনাফ থেকে পাবনার সাঁথিয়া, দিনাজপুরের চিরিবন্দর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, ভোলার বোরহানউদ্দিনে ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে। এসব দুষ্কর্মের জন্য যারা দায়ী, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে।’

বিজ্ঞাপন

ফেসবুকে ধর্মীয় বিদ্বেষপূর্ণ গুজব ছড়ানোর অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দুদের সাইবার আইনে ফাঁসাতে একটি অ্যাপস ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও আমরা জেনেছি। এই অ্যাপসের মাধ্যমে সংখ্যালঘু বিশেষত হিন্দুদের ছবি দিয়ে ধর্মীয় উসকানিমূলক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সম্প্রতিকালে রাকেশ চক্রবর্তী ও রণী সত্যার্থী নামে দু’জনকে এই অ্যাপসের মাধ্যমে ফাঁসানো হয়েছে, তারা এখন ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। কথিত ধর্ম অবমাননার জিকির তুলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব সাময়িক বাতিল করে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।’

সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শাস্তির সম্মুখীন হওয়া এই ছয় শিক্ষার্থী হলেন- নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক মজুমদার ও দীপ্ত পাল, যমোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিথুন মণ্ডল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিথি সরকার, পার্বতীপুর আদর্শ ডিগ্রি কলেজের দিপ্তী রাণী রবিদাশ, ফেনীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মিথুন দে। এদের মধ্যে মিথুন মণ্ডল, মিথুন দে ও দীপ্তি রবিদাশকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। তিথি সরকার গত ২৮ অক্টোবর থেকে নিখোঁজ। তার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।’

রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হচ্ছে, আমার নাম ব্যবহার করে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অথচ আমার বাড়িঘরে হামলা হচ্ছে, আগুন দিচ্ছে। আমি নিজেই ভিকটিম। অথচ আমাকেই আবার গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে।’

বিজ্ঞাপন

সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়েছে, মাওলানা যুবায়ের আহমেদ, মাওলানা খান মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক, জনৈক ইসমাইল আবির বিভিন্ন ধর্মীয় সভা, কথিত অনলাইন প্রশিক্ষণ কোর্স, কথিত ইনস্টিটিউশন স্থাপন বা কথিত নওমুসলিমদের পুর্নবাসন বা যাকাতদানের উদ্যোগের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ভূয়া ফেসবুক আইডি সৃজন করে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায়ে তারা এই কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা ইসলামভিন্ন অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগ সৃষ্টি করে চলেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কুশল চক্রবর্তীকে হুমকি দেওয়ার বিষয় তুলে ধরে বলা হয়, ‘হুমকিদাতারা বলেছে- এই বাংলাদেশ হবে পাকিস্তান। তোদের (সংখ্যালঘু) লাস্ট হায়াৎ হল ২০২৫ সাল, না হলে ২০২৬ সাল। এরপর পুরো বাংলাদেশের মাটিতে একটাও হিন্দু পাবি না, মূর্তিপূজারী পাবি না, একটাও মুশরিক পাবি না।’

রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘২০২৪ সালে জাতীয় সংদ নির্বাচন। সম্ভবত নির্বাচন পূর্বাপর সময়কে বিবেচনায় নিয়েই এই হুমকিটা দেওয়া হয়েছে।’

সংবাদ সম্মেলনে করোনাকালে গত সাত মাসে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার চিত্র তুলে ধরে বলা হয়- খুন হয়েছে ১৭ জন, ১০ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, হত্যার হুমকি পেয়েছেন ১১ জন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩০ জন, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৬ জনকে, শ্লীলতাহানির কারণে আত্মহননে বাধ্য হয়েছেন ৩ জন, অপহরণের শিকার ২৩ জন, অপহরণের চেষ্টা ২ জন, নিখোঁজ ৩ জন, প্রতিমা ভাংচুর হয়েছে ২৭টি, মন্দিরে হামলা-ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ২৩টি, ধর্মীয় সম্পত্তি-শ্মশান দখল হয়েছে ৫টি, বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে ২৬টি পরিবারকে, উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়েছে এমন ঘটনা ৭৩টি।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া ৩৪ জনকে দেশত্যাগের হুমকি দেওয়া হয়েছে, গ্রামছাড়া করা হয়েছে ৬০টি পরিবারকে, ধর্মান্তরিত হওয়ার হুমকি এসেছে চারজনের বিরুদ্ধে, ৭ জনকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়েছে, বসতভিটা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ৮৮টি, শারীরিকভাবে জখম হয়েছেন ২৪৭ জন, ত্রাণ বিতরণের সময় ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে ২০টি পরিবারকে এবং মহানবীকে কটুক্তির মিথ্যা অভিযোগে আটক হয়েছেন ৪ জন।

রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘এ চিত্র সম্পূর্ণ নয়। আশিংক মাত্র। এসব সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িতরা সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বাংলাদেশে এখন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মূল লক্ষ্য হল- ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদের মাধ্যমে দেশত্যাগে বাধ্য করা যাতে এদেশ সংখ্যালঘুশূন্য হয়। পাকিস্তান আমলের এই ঘৃণ্য চক্রান্ত স্বাধীন দেশে আবারও বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। কিন্তু সরকার-প্রশাসন রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে।’

সড়কে গণঅবস্থান মানে সড়ক অবরোধ কি না জানতে চাইলে মানবাধিকার সংগঠক রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘আমি একজন আইনজীবী। আমি আইন ভালো বুঝি। সড়কে গণঅবস্থান বলেছি, অবরোধ বলিনি। অবস্থান নেওয়ার পর বোঝা যাবে কি করব। এত ঘটনা ঘটছে, সরকারের টনক নড়তে দেখি না। কোনো রাজনৈতিক দলেরও টনক নড়তে দেখি না। একটা কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। আমরা এবার সামনের দিকে এগোতে চাই। এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।’

সংবাদ সম্মেলনে অ্যাডভোকেট নিতাই প্রসাদ ঘোষ, তাপস হোড় ও চন্দন বিশ্বাসসহ ঐক্য পরিষদের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

সারাবাংলা/আরডি/এমআই

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন