বিজ্ঞাপন

নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজের দাবি

November 10, 2020 | 12:18 am

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: করোনায় নারী উদ্যোক্তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের ঘুরে দাঁড়াতে হয়তো সবচেয়ে বেশি সময় লাগবে। সামগ্রিকভাবে এখন পর্যন্ত এসএমই খাতে প্রণোদনার মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ ছাড় হয়েছে। কিন্তু নারী উদ্যোক্তাদের সবাই ঋণ পাওয়ার যোগ্য। প্রয়োজনে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা যেতে পারে। এবং এই অর্থ পরিশোধে অন্তত পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় দেওয়া যেতে পারে। এতে করে নারী উদ্যোক্তারা আরও বেশি উৎসাহিত হয়ে উঠবে।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (৯ নভেম্বর) সারাবাংলা ডটনেটের বিশেষ আয়োজন সারাবাংলা ফোকাস অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। সারাবাংলা ফোকাসের এদিনের আলোচনার বিষয় ছিল ‘করোনাকাল নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসা পরিস্থিতি’।

সারাবাংলা ডটনেটের সিনিয়র নিউজরুম এডিটর রাজনীন ফারজানার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর, বাংলাদেশ হস্তশিল্প প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বাংলাক্রাফট) ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহিদ হোসেন শামিম এবং বৃন্তা জুট হ্যান্ডিক্রাফটসের প্রোপাইটর নারী উদ্যোক্তা স্মিতা চৌধুরী। অনুষ্ঠানটি একযোগে সারাবাংলা ডটনেটের ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল ও বেসরকারি টেলিভিশন জিটিভিতে প্রচারিত হয়।

আলোচনায় যুক্ত হয়ে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, বেশিরভাগ নারী উদ্যোক্তাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ে পড়ে। সামগ্রিকভাবেই এসএমই খাত খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তাদের ওপর খুব বাজেভাবে প্রভাব পড়েছে। এখনো সত্যিকার অর্থে ব্যাপকভাবে ঋণ সহায়তা খাতটিতে সেভাবে পৌঁছায়নি। এখানে প্রণোদনার মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ ছাড় হয়েছে। সামগ্রিকভাবেই এখানে বিশাল একটি ঘাটতি রয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই অতি ক্ষুদ্র পর্যায়ের। তারা কিন্তু ভ্যাট বা অন্যান্য অ্যাকটিভিটির সঙ্গে খুব বেশি যে সম্পৃক্ত, তা নয়। আমরা নারীদের দেখি সার্ভিস সেক্টর বা বিউটি পার্লারে। খাতটি ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মানুষ যায়ইনি। এখন একটু একটু করে হলেও কিছুটা যাচ্ছে। অনলাইনে যারা কেনাবেচা করেন, তারা এত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হননি। তবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার যে প্রভাব, তা তো পড়েছেই। ক্রেতাদের কেনার সক্ষমতা না থাকলে সেটার প্রভাব তো সব উদ্যোক্তার ওপরই পড়বে, নারী বা পুরুষ উদ্যোক্তাদের বেলায় এর কোনো পার্থক্য থাকবে না।

এই প্রভাব কাটিয়ে ওঠার উপায় নিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন প্রশ্ন হচ্ছে— ঋণ কি একমাত্র সমাধান? না, ঋণ একটি সমাধান মাত্র। আমাদের আসলে দেখতে হবে বিজনেস আউটপুট কী। নারী উদ্যোক্তারা যে খাতে আছেন, সেটির আউটলুক কিন্তু সবচেয়ে খারাপ। যেমন কারুপণ্য, বিভিন্ন উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব পণ্য কিংবা বিউটি পার্লার— এসব খাতে অভিঘাত বেশি পড়েছে। আমার মনে হয় এই খাতগুলো সবচেয়ে শেষে ঘুরে দাঁড়াবে।

বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজের উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকার যদি কোনো স্পেশাল প্যাকেজ করতে চায়, আমার মনে হয় খুব অল্প টাকাতেই সরকার সেটি করতে পারবে। কারণ নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা সেরকম বড় নয়। ঋণ পরিশোধের সময়কে লম্বা করা যেতে পারে, কারণ এক বা দুই বছরে তারা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারবে না। দুই বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করার সম্ভবনা সবার ক্ষেত্রেই ক্ষীণ। বেশিরভাগ বড় উদ্যোক্তারাও পারবেন না। তাদেরও পাঁচ বছর সময় দিতে হবে। বরং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আমরা এখন থেকে দিয়ে দিই, যেন তারা বেশি উৎসাহিত হয়।

বিজ্ঞাপন

নারী উদ্যোক্তারা প্রণোদনা না পাওয়ার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, সব ব্যাংক কিন্তু এসএমইদের ঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে পারে না। ব্যাংকের কাছে যখন সীমিত আকারে সম্পদ থাকে, তখন ব্যাংকগুলো যাদের চেনে বা ক্রেডিট হিস্ট্রি আছে, তাদেরই বিশ্বাস করে। আমি মনে করি, সব নারী উদ্যোক্তাই টাকা পেতে পারেন। অ্যাকাউন্ট যদি ঠিক থাকে, প্ল্যান যদি ঠিক থাকে, বিক্রিটা যদি মোটামুটিভাবে কিছুটা স্ট্যাবল থাকে, তাহলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। কিছু ক্ষেত্রে আমাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবেই। চাহিদা যেটা কমে গেছে, সেটা এখন বাড়ছে। আমার মনে হয় আমাদের ২০১৯ সালে অবস্থায় যেত হলে আগামী বছরের জুন-জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সবাইকে নিয়েই এই কষ্টের সময় পার করতে হবে। আস্তে আস্তে এই অবস্থার উত্তরণ ঘটবে। অন অ্যান্ড অফ সুইচ বা জাদুর চেরাগের মতো অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে না।

বাংলাক্রাফটের ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহিদ হোসেন শামিম বলেন, আমাদের নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে যারা ট্রেড লাইসেন্স, টিন ও ভ্যাট লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছেন এবং ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা ঋণ নিয়েছেন। কিছু নারী উদ্যোক্তা আছেন যারা বিভিন্ন হাউজে পণ্য সরবরাহ করতেন, কিন্তু ট্রেড লাইসেন্স বা ভ্যাট-টিন নেই। আবার কিছু উদ্যোক্তা একেবারেই নতুন। যখন করোনা সংক্রমণ শুরু হয়, তখন দু’টি বড় ইভেন্ট ছিল— বৈশাখ ও ঈদ। ঈদের জন্য প্রস্তুতি চলে গত বছরের নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত। নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে যারা অন্যান্য হাউজে পণ্য সরবরাহ করতেন, তারা একটি বড় ধাক্কার মধ্যে পড়েন। ফেব্রুয়ারি-মার্চে তারা একদম স্তব্ধ হয়ে যান। তারা কোনো পণ্য ডেলিভারি করতে পারেননি, আবার তাদের হাতে কোনো কাজ ছিল না। যারা দোকান শুরু করেছিলেন, তাদের দোকান বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।

তিনি বলেন, যখন প্রণোদনা ঘোষিত হয়, সেই প্রণোদনা ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ব্যাংকের যেসব নিয়ম-কানুন আছে, ব্যাংক ও গ্রাহকের সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রণোদনা দেওয়া হয়। প্রণোদনার টাকা ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তো আর টাকাটা আসেনি। কিন্তু ওই মুহূর্তে অনেকেই টাকা ছাড়া অবস্থায়। আবার কেউ কেউ ব্যাংক থেকে আগেই টাকা নিয়েছেন। ওই পরিস্থিতিতে তাদের কিস্তি দেওয়ার একটা বিষয় ছিল, তারা দিতে পারছিলেন না। পরে সরকারের নির্দেশনা ছিল সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কিস্তি না দিলেও ঋণ খেলাপি হবে না।

শাহিদ হোসেন শামিম আরও বলেন, বেশিরভাগ নারী উদ্যোক্তা ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তারা কিন্তু বড় ধরনের একটি ধাক্কার মধ্যে পড়েন। তারা তাদের পণ্য হাউজগুলোতে ডেলিভারি করতে পারেননি। নতুনরা একেবারেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। প্রণোদনার টাকা দেওয়া শুরু হলে অনেকেই টাকাটা নেননি। কারণ আগে তার ঋণ ছিল। আবার নতুন করে ঋণ নিয়ে কী করবেন, সেই ভীতিও ছিল। যাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না, তারা নতুন করে ঋণ নেওয়ার পরিস্থিতিতে ছিলেন না। প্রণোদনায় নারী উদ্যোক্তারা অগ্রাধিকার পাবেন— এমনটি উল্লেখ থাকলেও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনায় এত টাকা বরাদ্দ, এরকম কিছু উল্লেখ ছিল না। ফলে অনেক নারী উদ্যোক্তাই প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

বৃন্তা জুট হ্যান্ডিক্রাফটস’র প্রোপাইটর স্মিতা চৌধুরী বলেন, করোনার সময় আমার কিছু অর্ডার স্থগিত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে আমি একটু বিপদগ্রস্ত ছিলাম। স্থগিত হওয়া অর্ডারের মধ্যে সম্প্রতি একটি অর্ডার আবার ফেরত পেয়েছি। অর্ডার স্থগিত হওয়ায় ৭০ জন শ্রমিক নিয়ে প্রায় তিন মাস আমি বেকার ছিলাম। যে তিন মাস আমার কাজ ছিল না, এর মধ্যে একমাস আমরা শ্রমিকদের বেতন দিতে পেরেছিলাম। তারপর থেকে কাউকে অর্ধেক কিংবা কাউকে কিছুই দিতে পারিনি। কিন্তু যারা নিয়মিত শ্রমিক ছিল, তাদের পুরো বেতনই দিতে হয়েছে। তিন মাস পরে যখন কাজ এলো, তখন আমরা একটু শান্তি পেলাম।

এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, নারী উদ্যোক্তা হিসাবে প্রণোদনার অর্থ অবশ্যই আমাদের প্রয়োজন আছে। কোনো কিছুর কারণে হয়তো আমি ওই ক্যাটাগরিতে পড়িনি। প্রণোদনার টাকা আমি পাইনি। প্রণোদনা পেতে আমার প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র ছিল। কিন্তু আমার মনে হয় যোগাযোগে কোনো সমস্যা ছিল। নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ বা প্রণোদনার অর্থ পেতে ব্যাংকগুলোর আরও বিশেষ মনেযোগী হওয়া দরকার।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন