বিজ্ঞাপন

চুক্তি করেও শ্রমিকদের পাওনা দিচ্ছেনা ড্রাগন সোয়েটারের মালিক

November 12, 2020 | 8:34 am

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: শ্রমিক, মালিক ও সরকারের সমন্বয়ে তৃপক্ষীয় চুক্তির পরও শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করেনি ড্রাগন সোয়েটারের মালিক। পাওনার প্রায় ৭০ শতাংশ ছাড় দিয়ে শ্রমিকরা যে শর্তে চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন, সেই অর্থের মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ দিতে চান বিতর্কিত এই কারখানাটির মালিক। শুধু তাই নয়, বকেয়া পাওনার দাবিতে যে ৫০০ শ্রমিক দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন, সেই পাওনাদারের তালিকা থেকে ৩০০ শ্রমিককে বাদ দেওয়া হয়েছে!

বিজ্ঞাপন

এদিকে, করপোরেট শাখার ১০ জন শ্রমিকের কোনো পাওনা নেই বলেও দাবি ড্রাগন সোয়েটারের মালিকের। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠান কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী সব শ্রমিকেরই পাওনা রয়েছে মালিবাগের ওই কারখানাটিতে। আর পাওনা বঞ্চিত শ্রমিকরা আবারও রাজধানীর শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন। প্রয়োজনে কাফনের কাপড় পড়ে আন্দোলনে নামার হুমকিও দিয়েছেন তারা।

আইন মানে না ড্রাগন সোয়েটার, পাওনা চাইলে চাকরি যায় শ্রমিকের

রাজধানীর মালিবাগে অবস্থতি ওই কারখানাটির মালিক মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস। তিনি তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি। ওসি কুদ্দুস নামেও তিনি পরিচিত। শ্রমিকদের অভিযোগ, ফের আগের মতোই মামলার ভয় দেখাচ্ছেন তিনি। পুরো অর্থ পরিশোধ না করে শ্রমিকদের বঞ্চিত করতে এখনও নানাভাবে শক্তি প্রদর্শন করছেন।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারিকে পুঁজি করে রাজধানীর মালিবাগের ড্রাগন সোয়েটারের প্রায় ৫০০ শ্রমিককে চাকরিচুত্য করা হয়েছিল। লকডাউন শুরু হলে ২৬ মার্চ থেকে কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর আর এই শ্রমিকরা আর কারখানাটিতে প্রবেশ করতে পারেননি। তবে শ্রমিকরা ওই সময় থেকেই আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। সার্ভিস বেনিফিট ও প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ ন্যায্য পাওনার দাবিতে মানববন্ধন, সমাবেশ, দেনদরবার— এমন কিছু নেই, যা তারা করেনি। পাওনা বঞ্চিত শ্রমিকরা বিজয়নগরের শ্রম ভবনের সামনে অনশন ও ঝাড়ু মিছিল করেছেন। সরকারের বিভিন্ন দফতরে স্মারকলিপি পর্যন্ত দিয়েছেন। তবু শ্রমিকদের দাবি মানেননি কারখানাটির চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস।

দীর্ঘ আন্দোলনের পর গেল ১২ অক্টোবর কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরির্দশন অধিদফতরের মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায়ের সভাপতিত্বে অধিদফতরের সভাকক্ষে মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের একটি সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ওই কারখানার চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুছসহ শ্রমিক ও বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সবার সম্মতিতে যেসব সিদ্ধান্ত হয়, তার মধ্যে রয়েছে— প্রত্যেক শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে চাকরির ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতিবছর চাকরির জন্য ১৫ দিনের মূল মজুরি মালিক কতৃপক্ষ পরিশোধ করবে; জমা থাকা সাপেক্ষে ২০১৮ সালের পরবর্তী সময়ের জন্য প্রত্যেক শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে বাৎসরিক ছুটির (অর্জিত ছুটি) পাওনা শ্রম আইন অনুযায়ী মালিক কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করবে; মালিকের কাছে সঞ্চিত শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তার সব অর্থ মালিকের কাছে থাকা হিসাব অনুযায়ী মালিক কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করবে। ৭ নভেম্বর, ২২ নভেম্বর, ৭ ডিসেম্বর ও ২২ ডিসেম্বর— এই চার তারিখে চার কিস্তিতে অর্থ পরিশোধ করার বিষয়ে চুক্তি হয় বৈঠকে।

বিজ্ঞাপন

তবে মালিক ওসি কুদ্দুস চুক্তি করেও তা মেনে নেননি। পাওনার প্রথম কিস্তি তুলতে গেলে ৭ অক্টোবর অনেক শ্রমিক বাধার মুখে পড়েন। করপোরেট শাখার দুজন সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার তরিকুল হক ও আসাদুল হক সজলকে কারখানাটি প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। প্রোডাকশন শাখার (নিটিং ও লিংকিং) ৩০০ শ্রমিকের কোন পাওনা নেই বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। কোনো কোনো শ্রমিককে সার্ভিস বেনিফিট বা অর্জিত ছুটির টাকা দিতে অসম্মতি জানানো হয়। এতে শ্রমিকরা পাওনার প্রথম কিস্তি গ্রহণ করেননি।

জানতে চাইলে কারখানাটির শ্রমিক আব্দুল কুদ্দুস সারাবাংলাকে বলেন, পাওনার ৭০ শতাংশ ছাড় দিয়ে আমরা চুক্তিতে সম্মত হয়েছি। পাওনা প্রায় ৭ লাখ টাকার মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী ৩ লাখ টাকার কিছু বেশি পাব। কিন্তু ৭ তারিখ কারখানাটিতে গেলে জানানো হয়— আমার পাওনা ১ লাখ ৩১ হাজার ৩১৪ টাকা। সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে সেখানে সাইন করে প্রথম কিস্তি নিতে বলে। আমরা তা মেনে নেইনি। চুক্তি অনুযায়ী প্রথম কিস্তি পরিশোধ না করায় আমরা তা গ্রহণ করিনি। সেখানে কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরির্দশন অধিদফতরের পরিদর্শকরা ছিলেন। তারাও দেখেছেন চুক্তি মানা হয়নি। আমরা জেনেছি, তারা সেভাবেই প্রতিবেদন দিয়েছে।

শ্রমিক কুদ্দুস আরও জানান, ৭ নভেম্বর করপোরেট শাখার দু’জন সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার তরিকুল হক ও আসাদুল হক সজলেকে কারখানাটি প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। প্রোডাকশনে যারা কাজ করতেন, প্রায় ৩০০ জন শ্রমিককে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে— তাদের কোনো পাওনা নেই। অথচ সরকারের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রায় ৫০০ শ্রমিকেরই পাওনা রয়েছে। এছাড়া যে তালিকা দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা গেছে— ৮৭ জন শ্রমিকের সার্ভিস বেনিফিট ও অর্জিত ছুটির টাকা পাওনার তালিকায় ওঠানো হয়নি, তাদের শুধু প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেওয়া হবে বলে মালিকপক্ষ জানিয়েছে। ৮৯ জনের শুধু সার্ভিস বেনিফিট ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে, তাদের অর্জিত ছুটির টাকা দেওয়া হবে না। আমরা তা মেনে নেইনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক শ্রমিক জানান, এখনও হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। আমাদের নামে নাকি আবার মামলা দেওয়া হবে। আগের মামলায় আমরা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছি। এই মালিক সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলকেও পাত্তা দিচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

ড্রাগন সোয়েটারে ১০ মাসের বেতন পাওনা কর্মচারীদের

জানতে চাইলে ৭ নভেম্বর ড্রাগন সোয়েটারে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকা পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, শ্রমিকদের পাওনা দিতে একটি চুক্তি হয়েছিল। সেদিন আমরা সেখানে উপস্থিত ছিলাম। মালিকপক্ষ যে টাকা দিতে চেয়েছে, শ্রমিকরা বলেছেন তারা আরও বেশি পান। তাই শ্রমিকরা প্রথম কিস্তির টাকা নিতে অসম্মতি জানান।

শ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা গার্মেন্টস ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘মালিকপক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করেছে। পাওনা না দিয়ে শ্রমিকদের বকাঝকা করেছে, উল্টাপাল্টা বলেছে। আমরা শ্রম ভবনের সামনে আবারও অবস্থান নিয়েছি। বিভিন্ন দফতরে জানানো হয়েছে। আমাদের শ্রমিকদের একটি প্রতিনিধি শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতেও গিয়েছিল। বুধবার (১১ নভেম্বর) দেখা হয়নি। বৃহস্পতিবার (১২ নভেম্বর) তারা আবারও দেখা করতে যাবে।’

একই সংগঠনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মঞ্জুর মঈন সারাবাংলাকে বলেন, ‘শ্রমিকরা ৭ অক্টোর পাওনার প্রথম কিস্তি তুলতে গেলে চুক্তির চেয়ে কম অর্থ দেওয়ার কথা জানায় কারখানা কর্তৃপক্ষ। তিনি শ্রমিকদের নানাভাবে হয়রানি করে আসছেন। পাওনাও কম দিচ্ছেন। হয়তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে তার ভবন ঘেরাও করলেই তিনি শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করবেন।’

জানা গেছে, গত ২৬ মার্চ ড্রাগন সোয়েটার কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারখানাটিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা ৫০০ শ্রমিককে কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই চাকরিচুত্য করা হয় ওই সময়। মালিবাগের এই কারখানাটি কুমিল্লায় সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। পরে অবশ্য সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে মালিকপক্ষ। বর্তমানে দৈনিক ভিত্তিতে লোক নিয়োগ দিয়ে কারখানাটি পরিচালনা করা হচ্ছে।

শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা না দিতে দীর্ঘদিন এই কারখানাটি অন্য নামে চালানো হচ্ছিল বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে সার্ভিস বেনিফিট ও প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ ন্যায্য পাওনা আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন। দফায় দফায় তারা মানববন্ধন করেছেন মালিবাগে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনেও দাবি আদায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। শ্রম ভবনের সামনে অনশন, মানববন্ধন ও ঝাড়ু মিছিল করেছেন। মালিকের বাড়ি ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও দিয়েছিলেন শ্রমিকরা।

এর ধারাবাহিকতায় গত ৪ অক্টোবর মালিবাগে মানববন্ধন করেন শ্রমিকরা। তাদের অভিযোগ, সেখানে মালিকপক্ষ ও তাদের ভাড়াটে গুণ্ডারা তাদের ওপর হামলা চালায়। ব্যানার ও ফেস্টুন কেড়ে নেয়। পরে দীর্ঘদিন ধরে এই আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, সেসব শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে মালিকপক্ষ।

গত ৫ অক্টোবর ড্রাগন সোয়েটারের অ্যাডিমন অফিসার মাহবুবুর রহমান বাদী হয়ে ১৬ জন শ্রমিকের নাম উল্লেখ করে হাতিরঝিল থানায় মামলাটি দায়ের করছেন। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ৩০ জন শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে ওই মামালাতে। মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন— মো. আব্দুল কুদ্দুস, শুক্কুর চৌধুরী, ফারুক ভূঁইয়া, মিন্টু মিয়া, হাসানুর রহমান, আল আমিন, শাহ আলম, মনির হোসেন, রশিদ মিয়া, আ. রাজ্জাক, মফিজুল ইসলাম, সোহেল রানা, উজ্জল সিকদার, শাহিন কবির, মো. নান্নু ফকরি ও মঞ্জুর মইন।

সামগ্রিক বিষয়ে মন্তব্য জানতে  ড্রাগনের মালিক মোস্তাফা গোলাম কুদ্দুসের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

আরও পড়ুন:  পাওনা আদায়ে আন্দোলন, ড্রাগন সোয়েটারের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা!

 

 

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন