বিজ্ঞাপন

করোনা মহামারি— অবহেলার পরিণাম শুভ নয়

November 19, 2020 | 1:35 am

মোহাম্মদ রুবায়েত হাসান

করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহ রূপ দেখছে পৃথিবী। সংক্রমণের হার ও তার সাথে সাথে মৃত্যুর হার লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে প্রথম ওয়েভের জের শেষ হতে না হতে সরকারি হিসেবেই গত একদিনে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে অনেক। দৈনন্দিন মৃত্যুর হার বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। সীমিত সংখ্যক টেস্টের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্যের বিচারেও শনাক্তের দিক দিয়ে এশিয়ায় পঞ্চম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। গত এক সপ্তাহ ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার খবর আসছে। হাসপাতালগুলোতে গুরুতর রোগীর ভিড়ও বাড়ছে। করোনাক্রান্ত রোগীর প্রকৃত সংখ্যার সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও সহজেই ধারণা করা যায় যে, প্রকৃত সংখ্যা সরকারি হিসেবের চাইতে অনেক অনেক গুণ বেশি।

বিজ্ঞাপন

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যান যাচাই করে এ বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে, কোনো দেশে সংক্রমণের মাত্রা কেমন তা সেসব দেশের মহামারি নিয়ন্ত্রণ উদ্যোগ ও সেসব দেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার হারের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। ইউরোপে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, ইতালি , জার্মানি, স্পেন ও ফ্রান্সে গেলো মার্চ-এপ্রিল মাসে প্রথম ওয়েভ-এর সময় লকডাউন দিয়ে, কারফিউ দিয়ে, ব্যাপক হারে সার্ভেইলেন্স ও সে অনুযায়ী কোয়ারেনটাইন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা দিয়ে সংক্রমণ অনেকটাই কমিয়ে আনা গিয়েছিলো। সংক্রমণের হার কমে আসাতে নিয়ন্ত্রণের মাত্রাও কমিয়ে নিয়ে আসা হয়। শীত আসার আগেই শুরু হতে পারে দ্বিতীয় ওয়েভ সেই আশঙ্কা সত্ত্বেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই দ্বিতীয় ওয়েভে সংক্রমণের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে প্রথম ওয়েভের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। তাই আবারো লকডাউনে গেছে এসব দেশ, যার প্রভাব ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে।সংক্রমণের হার কিছুটা হলেও কমে আসছে ইউরোপের এসব দেশগুলোতে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারিভাবে এবং নাগরিক পর্যায়ে মহামারি নিয়ন্ত্রণে শিথিলতা ও অবহেলার খেসারত দিচ্ছে সেদেশের মানুষ। সেই সাথে ব্যাপক হারে টেস্টিংয়ের কল্যাণে জানা তথ্য অনুযায়ী সংক্রমণের হার ও তার সাথে সাথে মৃত্যুর হারে ছাড়িয়ে গেছে পৃথিবীর সব দেশ।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসার কোনো লক্ষণ না দেখা গেলেও গত ক’মাসে জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে এসেছে। মাস্ক পরা বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো বালাই নেই। দৈনন্দিন নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে মানুষের ভিড় ছাড়াও চলেছে সভা, সমাবেশ, মিছিল, ওয়াজ মাহফিল। চলছে বিনোদনমূলক ও ধর্মীয় উৎসবের উদযাপন ও জলসা। বলা হচ্ছে মানুষের মনে ভয় কেটে গেছে। ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এলাকায় ও গ্রামেগঞ্জে মানুষের ধারণা সেখানে করোনা নেই। একথা ঠিক, সংক্রমণের তুলনায় আমাদের দেশে মৃত্যুহার বা গুরুতর রোগের হার কম। একথাও ঠিক, বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও গ্রামবাসীদের মধ্যে উপস্থিত পুরো-বিদ্যমান ইমিউনিটির বলে হয়তো অনেকটা সুরক্ষা পাচ্ছে এইসব জনগোষ্ঠী। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয় যে, করোনাভাইরাস সেখানে নেই। মৃত্যুহার কম হলেও তা শূন্য নয়। গুরুতর রোগী যাদের হাসপাতালে বা আইসিইউতে চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন তাদের সংখ্যা শূন্য নয়। সংক্রমণ যত বাড়বে মৃত্যুর সংখ্যাও তত বাড়বে। সংক্রমণ যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে ততই চাপ পড়বে হাসপাতালগুলোতে। হাসপাতালগুলোতে যত চাপ পড়বে তত বেশি আক্রান্ত হবে চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। সংকট দেখা দেবে আইসিইউ, ভেন্টিলেটর সহ অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রীর। বিপদে পড়বে অন্যান্য রোগে মৃত্যু পথযাত্রী রোগীরা। স্বাস্থ্যবিধির এমন অবহেলায় দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার চরম বিপর্যয় ও প্রত্যাশিত নয়।

স্বাস্থ্যবিধির এই চরম অবহেলার বিপরীতে সরকারি কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি। প্রতিদিন নির্দিষ্ট ও সীমিত সংখ্যক টেস্ট করে তাতে কতজন পজিটিভ আর কতজনের মৃত্যু হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে এসব তথ্য প্রকাশ করা ছাড়া আর তেমন কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়ছে না। এসব তথ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার দুঃসহ অভিজ্ঞতার গল্প নেই। নেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর কাহিনী। অথচ অর্থনীতির চাকা সচল রেখেও অনেক ধরণের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যেত। যেত বাধ্যতামূলক মাস্ক পরার নিয়ম আরোপ করা। যেত সব ধরণের সভা সমাবেশ ও জমায়েতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দৌড়ে দু’দুটো ভ্যাকসিন নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার বিচারে আশার আলো দেখাচ্ছে। এসব ভ্যাকসিনের বদৌলতে হয়তো মানুষ একদিন রুখে দিবে এই ভয়াল মহামারিকে। কিন্তু সে পর্যন্ত পৌঁছার আগে কতটুকু ক্ষতি মেনে নেবো আমরা— এ হিসেবে নিকেশ করার সময় এসেছে।

বিজ্ঞাপন

লেখক: পি.এইচ.ডি., ডি (এ.বি.এম.এম.), এফ.সি.সি.এম.
ক্লিনিকাল মলিকুলার মাইক্রোবায়োলোজিস্ট, সিদরা মেডিসিন
সহকারী অধ্যাপক, ওয়েল কর্নেল মেডিকেল কলেজ, দোহা

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন