বিজ্ঞাপন

ভুরুঙ্গামারীর অজস্র গলিত লাশদের গল্প

November 26, 2020 | 2:21 pm

রা'আদ রহমান

একাত্তরের নভেম্বর। মুক্তিযোদ্ধা আর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ মুহুর্মুহু আক্রমণে ক্রমেই ভেঙে পড়ছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিগুলো। একদিকে বিপুল বিক্রমে মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ সংগ্রামের যবনিকায় একের পর এক এলাকা শত্রুসৈন্যের দখল থেকে মুক্ত করছেন, অন্যদিকে তারা আবিষ্কার করছেন বিধ্বস্ত পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোর ভেতরে নৃশংসতম পৈশাচিকতার নিদর্শন। মুক্তিযোদ্ধা মো. আখতারুজ্জামান মণ্ডল ভুরুঙ্গামারী অভিযানের অন্যতম সদস্য ছিলেন, নিজের চোখেই দেখেছেন স্বজাতির উপর চালানো পাকিস্তানি সেনাদের সেই ভয়াবহ বীভৎসতার নমুনা।

বিজ্ঞাপন

কুড়িগ্রামের সর্বউত্তর-পূর্বের উপজেলা ভুরুঙ্গামারীর কাছাকাছি পটেশ্বরীতে ১১ নভেম্বর থেকেই পাকিস্তানিদের উপর সর্বাত্মক হামলা চলছিল, বিশেষ করে সকাল ৮টায় পটেশ্বরী রেলস্টেশনে পাকিস্তানিদের অবস্থানের উপর ভারতীয় বাহিনীর বিমান থেকে প্রচণ্ড হামলা চালানোয় পাকিস্তানিরা পিছু হটতে থাকে। আকাশপথে এবং দুধকুমার নদ পার হয়ে স্থলপথে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর ভয়াবহ হামলায় পটেশ্বরীতে বিপুলসংখ্যক নিহত সৈন্য পেছনে ফেলে পাকিস্তানিরা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা পটেশ্বরী দখল নিয়ে ভূরুঙ্গামারীর পূর্বে এসে পাকিস্তানিদের অবস্থানের উপর প্রবল হামলা চালাতে থাকে। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কামান, মর্টার, এইচএমজি, আরআর ইত্যাদির হামলা এবং বিমান থেকে একটানা গোলাবর্ষণের সহায়তা পেয়ে অদম্য মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের জন্য বয়ে নিয়ে আসে এক ভয়াবহ বিভীষিকা। তিন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং মিত্রবাহিনীর অবিশ্রান্ত আক্রমণে মধ্যরাতের পর থেকেই পাকিস্তানিদের দিক থেকে গুলিবর্ষণ কমে এলো। ভোরের আগেই পাকিস্তানিদের গুলির শব্দ বন্ধ হয়ে গেল, মুক্তিযোদ্ধারা টের পেলেন ভুরুঙ্গামারীর পাকিস্তানি ঘাঁটির পতন হয়েছে।

ভোর হওয়ার সাথে সাথেই “জয় বাংলা” স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে মুক্তিযোদ্ধারা ভুরুঙ্গামারীতে প্রবেশ করেন। মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান তার সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন—  জনমানবশূন্য ভুরুঙ্গামারীকে নিথর নিস্তব্ধ ও প্রাণহীন মনে হচ্ছিল। এমনকি কুকুর বেড়াল বা কোনো পাখির ডাকের শব্দও শোনা যাচ্ছিল না। চারিদিকে শুধু পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত জনপদ। যেহেতু ঘাঁটির চারদিকে পাকিস্তানি সেনারা ল্যান্ড মাইন পুঁতে রেখেছে, সুতরাং জয়োউল্লাসরত মুক্তিযোদ্ধাদের মূল রাস্তা ছাড়া জঙ্গল বা মাঠ পরিহার করতে বলা হলো। ভুরুঙ্গামারী হাইস্কুল এবং সি.এ অফিস থেকে ৬০ জন ইপিক্যাফ এবং ৩০-৪০ জন লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি সেনাকে ঘেরাও করে ধরা হলো। মুক্তিযোদ্ধারা হয়তো তাদের তখনই নিশ্চিহ্ন করে ফেলত, কিন্তু ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানি সেনাদের বন্দী হিসেবে ভারতে নিয়ে গেলো। ভুরুঙ্গামারী শত্রুমুক্ত করার এই অপারেশনে কমপক্ষে ৪০-৫০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছিল।

একেকটা এলাকা শত্রুর দখল থেকে মুক্ত করতে পারা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল পরম গর্বের অর্জন। আখতারুজ্জামান সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান, “মাতৃভূমি-জন্মভূমি উদ্ধার করে আনন্দে চোখের জল বের হয়ে এলো। স্বাধীন বাংলার পবিত্র জন্মভূমির মাটি হাতের মুঠোয় নিয়ে কপালে আর বুকে ঘষলাম। রক্ত ঝরানো সবুজ ক্ষেত্রবিশিষ্ট লাল বৃত্তের মাঝে সোনালী রঙ দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা স্বাধীন বাংলার পতাকা সি.ও অফিসের সম্মুখে তুলে দিলাম। বিজয়োল্লাসে পতাকা পত পত করে উড়তে থাকলো। এই আনন্দ আর অনুভূতি শুধু অনুভবই করা যায়, কখনো প্রকাশ করা সম্ভব নয়।“

বিজ্ঞাপন

কিন্তু তারা তখনো জানতেন না বিজয়ের আনন্দ কী এক ভয়াবহ বিভীষিকায় ম্লান হয়ে যাবে কিছুক্ষণ পরেই। সি.ও অফিসের পাশেই এক বাংকারে তারা আবিষ্কার করলেন ভুরুঙ্গামারীর পাকিস্তানি ঘাঁটির কমান্ডার ক্যাপ্টেন আতাউল্ল্যা খানের ক্ষতবিক্ষত লাশ। মুক্তিযোদ্ধাদের বোমার আঘাতে মরেছে সে, কিন্তু একা মরেনি। পিশাচটার পাশে এক নির্যাতিতা বাঙ্গালী নারীকে পাওয়া গেল। যতটুকু বোঝা গেল তিনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিংবা শিক্ষিতা কোনো  গৃহবধূ হবেন।  বোঝাই যাচ্ছিল এই হতভাগ্য নারী ছিল বাংকারে ক্যাপ্টেনের ভোগের জন্য। তাকে আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন করত এই পাকি ক্যাপ্টেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের সময় তিনিও এই লোলুপ পিশাচের কাছে বন্দী থাকা অবস্থায় চরম দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিহত হন। তার দিকে তাকাতে পারছিলেন না মুক্তিযোদ্ধারা, সারা শরীরে চরম পাশবিক নির্যাতনের চিহ্ন যে কোনো পাষাণেরও হৃদয় দ্রবীভূত করবে। কিন্তু এই বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাকে দাফনের ব্যবস্থা করে সামনে এগোনোর সময় আখতারুজ্জামানরা কল্পনাও করতে পারেননি, সামনে যা দেখতে হবে, তার তুলনায় এটা কিছুই না।

চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে আগের অবস্থানে ফেরার সময় সকাল ৯টার সময়ে হঠাৎ আখতারুজ্জামান ওয়ারলেসে সংবাদ পেলেন তাকে আবার সি.ও অফিসের কাছে যেতে হবে। আখতারুজ্জামান আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে সি.ও’র অফিসের পাশে বাসভবনের দোতলায় জানালায় ফাকে কয়েকজন নারীকে দেখতে পেলেন। দোতলায় উঠে তারা আবিষ্কার করলেন দরজায় তালা আটকানো, রাইফেলের বাঁট দিয়ে তালা ভেঙ্গে দরজা খুললেন। ভেতরে ঢুকে যে দৃশ্য দেখলেন আখতারুজ্জামান, তাতে লজ্জায় দ্রুত অন্যদিকে চোখ ফেরালেন তিনি। ভেতরে চারজন নারী, বোঝাই যাচ্ছে প্রচণ্ড পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারা, দুজন সম্পূর্ণ নগ্ন, আর দুজনের নিম্নাঙ্গে শুধুমাত্র অন্তর্বাস ছাড়া আর কিছু নেই।

দ্রুত আখতারুজ্জামান তাদের চারটা লুঙ্গি ও চারটা শতরঞ্জি দরজার বাইরে থেকে ঘরে ছুঁড়ে দিলেন যেন নারীরা নিজেদের আবৃত করতে পারেন। দরজার বাইরে থেকে কথা বলতে চেষ্টা করলেন আখতারুজ্জামান, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মাসের পর মাস চলমান দীর্ঘ অত্যাচার আর নির্যাতনে তারা কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, পুরো শরীর রক্তাক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত চারটা স্থির জড়পদার্থ পড়েছিল যেন।

বিজ্ঞাপন

এদের মধ্যে একজন ইতিমধ্যে গর্ভবতী হয়ে গেছে। পেটের আকার দেখে বোঝা গেল ৬-৭ মাস হয়ে গেছে গর্ভের বয়স। আরেকজনের সামান্য পরিচয় পাওয়া গেল, ময়মনসিংহ কলেজের ছাত্রী, মা-বাবাকে চোখের সামনে জবাই করে তাকে ধরে এনে নির্যাতন করা হয়েছে দিনের পর দিন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের গাড়িতে তাদের চিকিৎসার জন্য দ্রুত ভারতে নিয়ে যাওয়া হলো। আখতারুজ্জামান মুক্তিযোদ্ধাদের চারপাশ তন্নতন্ন করে খোঁজার নির্দেশ দিলেন।

বেশিদূর যেতে হলো না, রাস্তার পাশে ভরে ওঠা জঙ্গল ও বাঁশ ঝোপের ভেতরেই অনেকগুলো কংকাল পাওয়া গেল। কয়েকটা কংকালের হাতের হাড়ে তখনো চুড়ি রয়েছে, কয়েকটা কংকালের খুলিতে নারীদের লম্বা মাথার চুল এবং পাশে ছেঁড়া শাড়ী-ব্লাউজ পড়ে রয়েছে। জঙ্গল ও রাস্তার পাশের খাদ থেকে সদ্য পচা মানুষের লাশের দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। অর্থাৎ এই নারীরা পাকিস্তানি হায়েনাদের ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও পাশবিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মারা গেছেন। মৃতদের লাশগুলো স্রেফ রাস্তার পাশের ঝোপে ছুঁড়ে ফেলেছে পাকিস্তানি সেনারা, যেমন ব্যবহার শেষে দলামোচড়া পাকানো টিস্যু পেপার ছুঁড়ে ফেলি আমরা।

সি.ও অফিসের দোতলায় দক্ষিণ সিঁড়ির পাশের ঘরে দেখা গেলো সারা ঘরের মেঝেতে চাপচাপ জমাট বাঁধা কালচে রক্তের স্রোত। ছেঁড়া শাড়ী-ব্লাউজ, পেটিকোট, ব্রেসিয়ার, মেয়েদের ছেঁড়া চুল ঘরের মেঝেতে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। পূর্বপাশের জানালার লোহার রডের সুতার রশি বাঁধা এবং কাউকে বেঁধে রাখার চিহ্ন স্পষ্ট দেখা গেলো। বোঝা গেলো এই রশি দিয়ে মেয়েদের বেঁধে রেখে পাকিস্তানি সেনারা উপর্যুপরি গণধর্ষণ ও পাশবিক লোলুপতা চরিতার্থ করতো। আরো ১৬ জন নির্যাতনের শিকার নারীকে উদ্ধার করা হলো ভুরুঙ্গামারী হাইস্কুলের তালাবদ্ধ একটা কক্ষ থেকে , বিভিন্ন দূরবর্তী গ্রাম থেকে ধরে আনা এই নারীদেরও ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সি.ও অফিসের দোতলার সেই ঘরের উত্তর দেওয়ালে রক্ত দিয়ে মোটা করে ৭/৮ ইঞ্চি দূরত্ব রেখে লাল কালো রঙ-এ লেখা একটা শব্দ। শব্দটার বেশিরভাগ অংশই মুছে গেছে, শুধু “জ-বা” এই দুটো অক্ষর বোঝা যায়। কাছে গিয়ে আঙ্গুলে স্পর্শ করে আখতারুজ্জামান টের পেলেন, এটা আসলে রঙ না, রক্ত। কোনো হতভাগ্য নারী তার মুর্মুষু দশায় নিজের রক্ত দিয়ে শেষ চেষ্টায় সর্বশক্তি দিয়ে শব্দটা লিখতে পেরেছিল। হয়তো সে “জবা” আদ্যক্ষরের নিজের নাম লিখেছিল, অথবা লিখেছিল “জয় বাংলা”! জানবার আর কোন উপায় নেই।

দুধকুমার নদের পুলের পশ্চিম পাশের পরিত্যক্ত রেললাইন আর জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য অজস্র নির্যাতিত নারী-পুরুষের গলিত পচা লাশ আর কংকাল দেখতে দেখতে আখতারুজ্জামান সেদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেবেছিলেন, “এই লাশগুলো যেন বলছে অত্যাচার আর নির্যাতনে ধুঁকে ধুঁকে মরে গিয়ে আমাদের পচে-গলে যাওয়া নিয়তির বিনিময়ে তোমরা পেলে একটা শত্রুমুক্ত স্বাধীন দেশ, আদৌ কি মনে রাখবে আমাদের?” এতো বছর পর মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামানের সেই বুকভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাসের সামনে লজ্জায় মাথানত হয়ে ভাবি, ঠিক কতটা নির্লজ্জ অকৃতজ্ঞ জাতি হলে মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই ভুলে যাওয়া যায় সব? আমাদের জন্য মুক্ত বাতাস, মুক্ত স্বাধীন পরিচয় কিনতে যারা অকাতরে নিজেদের প্রাণ বিলিয়ে দিল, কি অবলীলায় তাদের ভুলে যেতে পারলাম আমরা?

বিজ্ঞাপন

কৃতজ্ঞতা: মুক্তিযোদ্ধা মো. আখতারুজ্জামান মণ্ডল
সাবেক কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, ঢাকা

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন