বিজ্ঞাপন

তবে কি পৃথিবী থেকে মানবতা নির্বাসিত?

November 26, 2020 | 3:33 pm

মনিরা নাজমী জাহান

করোনাভাইরাস পৃথিবী জুড়ে চলতে থাকা এই মুহূর্তে ভয়াবহ এক মহামারির নাম। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই ভাইরাস। উঁচু থেকে নিচু ধনী থেকে গরীব কেউ রক্ষা পাচ্ছে না এই ভাইরাসের করাল গ্রাস থেকে। মানবজাতি কখনো ভাবতেই পারেনি তাদের জীবনে এমন ভয় এমন আতঙ্ক বিরাজ করবে। এমন অসহায় অবস্থায় পড়তে হবে তাদেরকে। অহংকার, প্রাচুর্য, দম্ভ প্রভৃতি শব্দগুলোকে যেন দুমড়েমুচড়ে একাকার করে দিয়েছে এই করোনা নামের ভাইরাস। মানবজাতি এমন এক যুদ্ধে নেমেছে, যেখানে শত্রুকে দেখা যায় না। কখন কোথায় থেকে শত্রু এসে তাকে আক্রমণ করবে, তাও সে জানে না। মানবজাতি আজ কত অসহায়। কত অগ্রসর বিজ্ঞান, কত উন্নত প্রযুক্তি, কোথায় আজ? একটি ভাইরাস লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে মানবজাতির সমস্ত অর্জন। ঠিক এমনই এক অসহায় মুহূর্তে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে  যুদ্ধের জন্য প্রয়োজন  মানবিকতার, প্রয়োজন সহমর্মিতার। প্রশ্ন তাই থেকেই যাচ্ছে— এমন ক্রান্তিলগ্নে কতটুকু মানবিক হতে পেরেছে মানবসমাজ ?

বিজ্ঞাপন

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের জানতে হবে করোনা পূর্ববর্তী পৃথিবী কেমন ছিল ? করোনা পূর্ব পৃথিবী ছিল হিংসা-বিদ্বেষপূর্ণ সাম্প্রদায়িক উন্মাদনায় ভরা যুদ্ধ বিগ্রহের চারণভূমি। করোনা পূর্ব পৃথিবীতে আমরা দেখেছি যুদ্ধের ডামাডোল। শক্তিশালী দেশগুলো কোনো নিয়মনীতি, আন্তর্জাতিক আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দুর্বল দেশগুলোর উপর আক্রমণ চালিয়েছে। বিভিন্ন অজুহাতে সেই সব দেশগুলোতে তাদের সাম্রাজ্যবাদী লিপ্সা কায়েম করেছে। গণতন্ত্র রক্ষার নামে গণতন্ত্র হরণ করেছে। তাদের ক্ষমতার দাপটের কাছে অসহায় ছিল বিশ্ব সমাজ। সাক্ষী গোপালের ভূমিকা পালন করেছে জাতিসংঘ। এই যুদ্ধগুলোকে কেন্দ্র করে সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, ইরাকে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাগুলোতে অভিবাসীদের ভয়াবহ দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। একজন নিষ্পাপ শিশু আইলান কুর্দির করুণ মৃত্যু নাড়া দিয়েছে বিশ্ববাসীকে। নির্মমভাবে সাগরের বেলাভূমিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে মানবতা। সবাই ব্যথিত হৃদয়ে প্রত্যক্ষ করেছে আইলান কুর্দির নিথর লাশ। কে জানে আরও কত বাবার আইলান যুদ্ধের ঝড়ো হাওয়ায় হারিয়ে গেছে চিরতরে না ফেরার দেশে। মানবতার এমন করুণ মৃত্যুতেও কথিত বিশ্বমোড়লদের হৃদয় টলেনি। এমন নির্দয় ঘটনায় বিবেকবান মানুষ স্তম্ভিত হলেও জাগ্রত হয়নি তথাকথিত বিশ্ববিবেক। বিশ্ববাসী দেখেছে দেহের বিনিময়ে ত্রাণ নিতে হয়েছে সিরিয় নারীদের। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল সিরিয়ার লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার একটি মূল্যায়ন করে। তাতে বলা হয়, সেখানে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বিনিময়ে ত্রাণসহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ‘ভয়েসেস ফ্রম সিরিয়া ২০১৮’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সেখানে কর্মকর্তারা খাবারের বিনিময়ে ‘যৌন সেবা’ নিতে অল্প সময়ের জন্য নারীদের বিয়ে করছেন। ত্রাণ পেতে অনেক নারীকে ওই কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাত কাটাতে হচ্ছে।

করোনা পূর্ব পৃথিবীতে দেখেছি ধর্মের অপব্যাখ্যা করে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটনা হয়েছে। কখনো আল কায়েদা, কখনো তালেবান বা কখনো আইএসআইএস নামে বিভিন্ন সময় নাম পরিবর্তন করে আরও শক্তিশালী হয়ে এই জঙ্গিবাদের বিষবাষ্প পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববাসী জঙ্গিবাদের ভয়াবহ শিকার হতে দেখেছে মালালা ইউসুফকে। ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর ১৩ বছর বয়সে তালেবান জঙ্গিরা গুলি করে মালালার মাথায়। মালালার অপরাধ একটাই, নারী হয়ে স্কুলে গিয়েছিলেন মালালা। এরপর পাকিস্তান ও যুক্তরাজ্যর হাসপাতালে টানা ৪৯ দিন যুদ্ধ করেছেন জীবনের সঙ্গে। মৃত্যুকে হারিয়ে জীবনের ছন্দে ফিরেছিলেন মালালা। হয়ত এক মালালার ঘটনা জেনে ছিল বিশ্ব, তবে আরও বহু মালালা ছিল যাদের অত্যাচারের কথা অন্ধকারের তিমিরেই হারিয়ে গেছে। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে বিশ্ববাসী দেখেছে ক্রাইস্টচার্চ মসজিদ হামলা , শ্রীলংকা বোমা হামলাসহ আরও অনেক জঙ্গি হামলা।

করোনা পূর্ব পৃথিবী ছিল নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের জন্য স্বর্গরাজ্য। সিরিয়ায় আমরা দেখেছি নারীদেরকে ধরে নিয়ে যৌনদাসী বানিয়ে তাদের উপর কী অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। দেশটিতে ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সিরিয়ার তিন বছরের এক যুদ্ধাহত শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে বলেছিল, ‘আমি আল্লাহকে বলে দিবো, তোমরা আমার প্রতি অন্যায় করেছো’। জাতিসংঘের মতে— ছয় বছরের যুদ্ধের পর সিরিয়া এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটের মুখে পড়েছে তবে এর সবচেয়ে বড় মূল্যটি দিতে হয়েছে শিশুদের।

বিজ্ঞাপন

এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, করোনা পূর্ববর্তী সময়ে পৃথিবী এক নরকে পরিণত হয়েছিল। মানুষ এমন কোনো কুকর্ম নেই করেনি, এমন কোনো বাজে পরিস্থিতি ছিল না যার উদ্ভব মানুষ ঘটায়নি। তারপরের ইতিহাস করোনার আগমনের ইতিহাস। করোনার আগমনের পর মানুষ চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে, বাড়তে থাকে লাশের মিছিল। এক প্রকার অসহায় আত্মসমর্পণ করে মানুষ করোনাভাইরাসের কাছে। এমন অসহায় অবস্থায় যখন তার সবচেয়ে মানবিক হবার কথা ছিল। যখন সুযোগ ছিল সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে নরকে পরিণত হওয়া পৃথিবীকে স্বর্গে পরিণত করার সেই সময় মানবজাতি কি তা করতে পেরেছে ? অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে— সেই সময়েও মানবজাতি সর্বোচ্চ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। করোনাকালেও আমরা দেখেছি পৃথিবীর পরাশক্তিরা করোনাকে কেন্দ্র করে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষেদগার করেছে, পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়েছে ঘৃণা। করোনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এক ভয়াবহ মাত্রা ধারণ করেছে। করোনা বিস্তারের কারণ হিসেবে এক ধর্ম অন্য ধর্মকে দোষারোপ এক গোত্র অন্য গোত্রকে দোষারোপের মাত্রা চরম আকার ধারণ করেছে। সুযোগ নিয়েছে জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়েদা। জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা কোভিড-১৯ নিয়ে ছয় পৃষ্ঠার একটি নির্দেশনা ও বিবৃতি প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়, ‘করোনা গোটা দুনিয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন, যন্ত্রণাদায়ক ছায়া ফেললেও মুসলিম বিশ্বে ভাইরাসটি প্রবেশ করার কারণ হলো মুসলিম দেশগুলোতে পাপ, অশ্লীলতা ও নৈতিক অবক্ষয় বেড়ে গেছে। তারা বলেছে, ‘সঠিক ধর্মবিশ্বাসকে ছড়িয়ে দিতে, মানুষকে আল্লাহর পথে জিহাদের আহ্বান জানাতে এবং দমন ও দমনকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে করোনা সংকটকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।করোনাকালে থেমে থাকেনি নারী ও শিশু নির্যাতন। ৯ বছরের শিশু,  প্রতিবন্ধী বালিকা কিশোরী, গৃহবধূ এমনকি ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধা কেউ রক্ষা পায়নি এই ধর্ষকের করাল থাবা থেকে। শুধু ঘরের বাইরে নয়, ভেতরেও পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে করোনাকে কেন্দ্র করে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা- ইউএনএফপিএ এবং এভেনার হেলথ, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশে গত তিন মাসের লকডাউনে পারিবারিক সহিংসতা ২০ শতাংশ বেড়েছে। এমনকি করোনা আক্রান্ত রুগীকে কেন্দ্র করে মানুষ চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। যে সময়ে মানুষের সহমর্মিতা সবচেয়ে বেশি দরকার সেই সময় মানুষ সব চেয়ে বেশি নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে সমাজ ছাড়া করা হয়েছে, ঘর ছাড়া করা হয়েছে, সন্তান তার পিতামাতাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়েছে, পিতামাতা তার সন্তানকে ত্যাগ করেছে। কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তাকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর বদলে তার জাত, ধর্ম,‌ বর্ণ, গোত্র বিশ্লেষণ করে কুৎসিত এক সাম্প্রদায়িক নোংরামিতে মেতে উঠেছে মানুষ। তার চেয়েও ভয়ংকর হচ্ছে এই করোনা পরীক্ষার রিপোর্টকে কেন্দ্র করে যে কুৎসিত নোংরামি ও চূড়ান্ত অমানবিকতা আমরা দেখেছি তা মানব ইতিহাসে বিরল। এহেন কোনো কুকর্ম নেই যে এই করোনার সময় ঘটেনি।

এ কথা পরিষ্কার যে মানুষের অস্তিত্ব সংকটও  তার মনে বিন্দু মাত্র মানবিকতা বোধ জাগাতে পারেনি। যে সমাজে মানবিকতা বোধ নির্বাসনে যায় সেই সমাজে সভ্যতা বিপন্ন হয়ে ওঠে। সেই সমাজ হয়ে ওঠে বসবাসের অযোগ্য এক অসভ্য বর্বর সমাজ।

পরিশেষে যে প্রশ্নটি থেকেই যায় তা হলো, পৃথিবীতে আদিম ও অসভ্য মানুষেরা এনেছিল সভ্যতা। কিন্তু এখনকার তথাকথিত সভ্য মানুষ এনেছে যুদ্ধ, ঘৃণা, হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি। সভ্যতার ফল এতো ভয়ংকর জানলে সেই আদিম  মানুষেরা কি আদৌ সভ্য হতে চাইতো?

বিজ্ঞাপন

লেখক: শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন