বিজ্ঞাপন

সুস্থ সন্তান জন্ম দিচ্ছেন এইডস আক্রান্ত মায়েরা!

December 2, 2020 | 11:10 am

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: টাঙ্গাইল থেকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে গর্ভবতী অবস্থায় চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন সোনিয়া ইসলাম (ছদ্মনাম)। সেখানে আসার পর জানতে পারেন তিনি এইচআইভি এইডস সংক্রমিত। একদিকে মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে মৃত্যুভয় আর অন্যদিকে গর্ভে থাকা সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তিনি। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে গিয়ে শুনলেন, দেশেই এখন পর্যন্ত অনেক এইডস আক্রান্ত গর্ভবতী নারী সুস্থ সন্তান জন্ম দিয়েছেন, যাদের মাঝে এইচআইভি সংক্রমণ শনাক্ত হয়নি। এর পর তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবা নেওয়া শুরু করলেন। সন্তান জন্মগ্রহণ করার একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা পরে সংক্রমণ শনাক্তকরণ পরীক্ষা শেষে সোনিয়া ইসলাম জানতে পারেন তার সন্তান এইচআইভিমুক্ত।

বিজ্ঞাপন

সোনিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমে যখন আমার এইডস পজিটিভ হওয়ার কথা শুনি তখন বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ আমি কখনও বাইরে কারও সঙ্গে তেমনভাবে মেলামেশা করিনি। তবে চিকিৎসকদের জানিয়েছি, আমার স্বামী দেশের বাইরে থাকতো আগে। আমার সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পরে স্বামীর নমুনা পরীক্ষায়ও এইডস পজিটিভ পাওয়া যায়। তবে আমরা শুধু কষ্ট পাচ্ছিলাম আমাদের অনাগত সন্তানের কথা ভেবে। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানালেন, আমার আগেও অনেক এইডস আক্রান্ত গর্ভবতী নারী সুস্থ সন্তান জন্ম দিয়েছেন আমাদের দেশেই।’

তিনি বলেন, ‘তারপরও আমরা একটা অজানা আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। চিকিৎসকের পরামর্শ শুনে চেষ্টা করছিলাম নিজের গর্ভকালীন সবকিছু ঠিকঠাকভাবে পালন করতে। এক পর্যায়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর জানতে পারি তার মাঝে এইচআইভি এইডস সংক্রমিত হয়নি। তবে এই তথ্য জানার জন্য আমাদের প্রায় দেড় মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই সময়টা আমাদের সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে কাটে। কিন্তু এখন নিশ্চিন্ত যে, অন্তত আমাদের সন্তান সুস্থভাবে বেঁচে থাকবে।’

শুধুমাত্র একজন সোনিয়া ইসলামই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে এইডস আক্রান্ত গর্ভবতী নারীরা জন্ম দিচ্ছেন সুস্থ সন্তান। যাদের মাঝে পাওয়া যায়নি এইচআইভি এইডস ভাইরাসের সংক্রমণ। দেশে ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এইডস আক্রান্ত ১৭৬ জন গর্ভবতী মা সন্তান জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু কারও সন্তানের মাঝে এইডস সংক্রমণ শনাক্ত হয়নি। দেশে এখন পর্যন্ত ১৯১ জন এইডস আক্রান্ত নারী সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এদের মধ্যে ১৮১ শিশুকে এইচআইভি নমুনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার আওতায় আনা হয়। এর মধ্যে ১৭৬ জনের মাঝে কোনোরকমের সংক্রমণ শনাক্ত হয়নি।

বিজ্ঞাপন

শুধুমাত্র রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েই (বিএসএমএমইউ) ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এইডস আক্রান্ত ৮৮ জন মা সুস্থ সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এদের মধ্যে ৮০টি বাচ্চার নমুনা পরীক্ষা করে সবাইকে সুস্থ পাওয়া গেছে। বাকিদের ক্ষেত্রে এখনও নমুনা পরীক্ষা বাকি রয়েছে।

বিএসএমএমইউ’র স্ট্রেনদেনিং অব এইচআইভি সার্ভিসেস প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মেরিনা আখতার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এইচআইভি সংক্রমিত ১০২ জন মা ঢাকায় প্রিভেনশন অব মাদার টু চাইল্ড ট্রান্সমিশন (পিএমটিসিটি) নামে একটি কার্যক্রমের আওতায় ছিল। এর মধ্যে বিএসএমএমইউতে ৮৮ জন মা সুস্থ সন্তান প্রসব করেছে। এর মধ্যে ৮০ জন বাচ্চার আমরা পিসিআর নমুনা পরীক্ষা করাতে পেরেছি। তারা সবাই নেগেটিভ ছিল। বাকি বাচ্চাদের এখনও টেস্টের সময় হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে আমরা ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নারীদের মাঝে এইডস পাচ্ছি। গত বছরের রিপোর্টিং অনুযায়ী, আমাদের এখানে ১০ জন গর্ভবতী মা এনলিস্টেড হয়েছেন। যে কয়জনের ডেলিভারি হয়েছে তাদের বাচ্চাদের মধ্যে যাদের সময় হয়েছে তাদের টেস্ট করেছি। বাচ্চা হলেই কিন্তু টেস্ট করা যায় না। মিনিমাম ছয় সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। তখন পর্যন্ত আমরা তাদের নেগেটিভ পেয়েছি।’

বিজ্ঞাপন

বাচ্চাদের উপরে এইডসের প্রভাব পড়ছে কি-না?— এমন প্রশ্নের জবাবে মেরিনা বলেন, ‘আমরা ১৮ মাস বা ২ বছর পর্যন্ত ফলোআপ করি। এরপরেও বিভিন্ন বয়সে করা হয়ে থাকে। আমাদের এই সার্ভিস চলছে ২০১৩ থেকে। এখনও অনেকে আসে টেস্ট করাতে। আমরা ভালো ফলাফল পেয়েছি। এখন পর্যন্ত কোনো বাচ্চার সমস্যা আমরা দেখিনি। কিন্তু ভালো হতো যদি এইচআইভি এক্সপোজড বাচ্চা যারা সংক্রমিত নয়, তাদের নিয়ে আরও গবেষণা করা যেত। তাদের শরীরে ভবিষ্যতে কী ধরণের প্রভাব পড়তে পারে তাও বোঝা যেত।’

ডা. মেরিনা আখতার বলেন, ‘নবজাতকদের মাঝে এইচআইভি সংক্রমণের মাত্রা খুবই কম এটা বলা যেতে পারে। কিন্তু ছড়াচ্ছে না এটা বলা যাবে না। কারণ অনেক বাচ্চারাই দেখা যায় ইন্টারভেনশন পায়নি। তাদের শরীরে যে এইচআইভি জীবাণু আছে স্ক্রিনিংয়ের আগে তারা জানতোই না। অনেকের বাচ্চার পরীক্ষার জন্য নিয়ে এসে বিএসএমএমইউতে ধরা পড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সচরাচর আমরা বলে থাকি সেক্স ওয়ার্কারসহ মাদকাসক্তদের মাঝে এইচআইভি ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি শনাক্ত হয়। কিন্তু তারা বাদেও অনেকের মাঝে এইচআইভি ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। এটা একটা ভয়াবহ বিষয়। সেই টার্গেট পপুলেশনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় যারা আয়ত্বের মাঝে থাকে। কিন্তু দেখা গেলো সাধারণ জনগণের একটা অংশ যারা আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসছে কিন্তু শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানে না। সেটা কিন্তু ভয়ের ব্যাপার। যেমন: আমাদের এখানে যে মায়েরা আসছে তাদের আমরা স্ক্রিনিং করার পরে সংক্রমণ দেখতে পাচ্ছি। সব জায়গায় কিন্তু তেমন সুযোগ নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ১৩টি জায়গাতে আমরা স্ক্রিনিং করছি। স্ক্রিনিং করে যাদের পজিটিভ পাচ্ছি তাদের আমরা সার্ভিসের আওতায় আনতে পারছি। তারা কিন্তু স্ক্রিনিংয়ের আগে সাধারণ জনসাধারণেরই অংশ। একজন গর্ভবতী নারী যখন সেবা নিতে আসেন তখন তাকেও কিন্তু সাধারণ জনগণ হিসেবে কাউন্ট করা হয়; যিনি কোনো সেক্স ওয়ার্কার বা মাদকসেবী নন। দেখা গেলো তার মাঝে কোনো লক্ষণও নেই; কিন্তু তার স্পাউস থেকে ছড়িয়েছে। আবার দেখা যায়, যারা বিদেশ থেকে আসছে তারাও কিন্তু সাধারণ জনগণের মাঝেই পড়ছে। তাদের মাঝে যদি সচেতনতা বাড়ানো যায় তবে আশা করি এইডসের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে আসবে।’

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় এইডস/এইচআইভি কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক সামিউল ইসলাম সাদী সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রিভেনশন অব মাদার টু চাইল্ড ট্রান্সমিশন (পিএমটিসিটি)নামে আমাদের একটি প্রকল্প চালু আছে। এর মাধ্যমে এইডস আক্রান্ত প্রসূতি মায়েদের বিশেষ সেবা দেওয়া হয় কিছু ওষুধ ও পদ্ধতির মাধ্যমে। ২০১৩ সাল থেকে এই কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে মোট ১৯১ জন এইচআইভি পজিটিভ মায়ের সন্তান হয়। তাদের মধ্যে ১৮১ শিশুকে আমরা ওই ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে সক্ষম হই। ছয় সপ্তাহ পর পরীক্ষা করে দেখতে পাই, ১৭৬ জন শিশু এইচআইভিমুক্ত। আশা করছি, আমরা এ বিষয়ে খুব দ্রুত আরও বিস্তারিতভাবে জানাতে পারব।’

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের আওতায় জানানো হয়, বর্তমানে দেশের আট বিভাগের মধ্যে ঢাকা বিভাগে এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা বেশি, রংপুর বিভাগে কম। ঢাকায় এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৫২২ জন। চট্টগ্রামে ২ হাজার ৮ জন, সিলেটে এক হাজার ২১৯ জন, খুলনায় ৬৬০ জন, রাজশাহীতে ১৯২ জন, বরিশালে ১৭৯ জন, ময়মনসিংহে ৮৬ জন, এবং রংপুর বিভাগে ৬৮ জন এইচআইভি আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল (এনএএসসি) প্রোগ্রামের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১৩ লাখ ৩২ হাজার ৫৮৯ জনের এইচআইভি এইডস শনাক্তকরণ পরীক্ষা হয়েছে, যা ২০১৯ সালে ছিল প্রায় ২১ লাখ ৩৩ হাজার। ২০২০ সালে সর্বমোট ৬৫৮ জনের মাঝে এইচআইভি এইডস শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ১২৪ জনের শরীরে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। নতুনভাবে সংক্রমিতদের মধ্যে পুরুষ ৩৪১ জন (৭৬ শতাংশ), নারী ১০৬ জন (২১ শতাংশ) ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ১৩ জন (তিন শতাংশ)। এছাড়াও ১২৪ জন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪০ জন পুরুষ ও ৮০ জন নারী।

এনএএসসি প্রোগ্রামের তথ্য দেখা গেছে, দেশে চলতি বছর এইডস আক্রান্তদের ১৪১ জন মারা গেছে। নতুনভাবে শনাক্তকৃতদের মাঝে ৫৭ শতাংশ তাদের শরীরের সংক্রমণের বিষয়ে জানে। এর মধ্যে ৭৬ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় এসেছে। যারা চিকিৎসার আওতায় এসেছে তাদের মধ্যে ৮৮ শতাংশের ভাইরাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হয়েছে।

নতুন আক্রান্তদের বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে ১২ দশমিক ২৪ শতাংশ, ২৫ থেকে ৪৯ বছররের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৪ দশমিক ২০ শতাংশ, ১৯ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ১০ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে দুই দশমিক শূন্য সাত শতাংশ। ছয় থেকে ৯ বছরের মধ্যে শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং শূন্য থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে এক দশমিক ৮৮ শতাংশ।

দেশে চলতি বছরে শনাক্ত হওয়া ৬৫৮ জন পজিটিভ রোগীর মধ্যে বিবাহিতরাই সবচেয়ে বেশি। এদের সংখ্যা ৭০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। অবিবাহিতদের সংখ্যা ২৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী যেমন শিরায় মাদক গ্রহণকারী, যৌনকর্মী, সমকামী ও হিজড়াদের মধ্যে সংক্রমণের হার বর্তমানে ২ দশমিক ২৬ শতাংশ, যা আগে ২৫ শতাংশের বেশি ছিল।

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন