বিজ্ঞাপন

স্বপ্ন ছুঁয়েছে মিনার

March 15, 2018 | 4:45 pm

মিনা‌রের কথা ম‌নে অা‌ছে অাপনা‌দের? অামার মিনার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে মাস্টার্স করা মিনার। ভয়াবহ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে যার জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে বসেছিল। তিন মাস যা‌কে থাকতে হয়েছিল বার্ণ ইউনি‌টে। ১১ বার যার দেশে অস্ত্রোপচার হয়েছে। রক্ত লেগেছে ২৫ ব্যাগ। ডান হাতটি যার পুরোপুরি কাটা পড়েছে। এরপর বিদেশে গিয়ে আবার দফায় দফায় অস্ত্রোপচার। আমার সেই মিনারকে আজ সরকারের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করেছে পিএসসি। আজকে রাষ্ট্র্রীয় শোক দিবসে আমার কাছে খুব বড় খবর এটা।

বিজ্ঞাপন

মিনা‌রের গল্প অা‌মি য‌তোবার ভাবি ত‌তোবারই ম‌নে হয় এই দু‌নিয়ার সব মানুষ‌কে ওর গল্প ব‌লি, বিশেষ করে সব হতাশ মানুষকে। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে মিনার। স্কুলজীবন কেটেছে ছাত্র পড়িয়ে। সেই টাকায় চলে‌ছে প‌রিবার। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক দুটিতেই জিপিএ-৫ পেয়েছে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ‌র্তি হ‌য়ে নি‌জের খরচ নি‌জে যু‌গি‌য়ে‌ মার্কেটিং বিভাগ থেকে লেখাপড়া শেষ করেছে।

জীবন সংগ্রা‌মের এক অসাধারণ গল্প মিনার। জীবনযুদ্ধে প্রায় জিতে গি‌য়ে লেখাপড়া শেষ ক‌রে যখন চাকরির পরীক্ষা দিতে শুরু করেছিলেন, তখনই ঘট‌লো জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা।

বিজ্ঞাপন

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ৩৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ ক‌রে ঈদের ছুটিতে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বাড়িতে গিয়েছিলেন মিনার। ১২ সেপ্টেম্বর রাতে একটি ভবনের সঙ্গে ঝুলে থাকা বিদ্যুতের তারে আকস্মিকভাবে স্পৃষ্ট হন। রাতেই তাকে গুরুতর অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বার্ন ইউনিট নেই বলে জরুরিভাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকায়।

আমি মিনারকে চিনতাম না। অামার স্ত্রী আমাকে মিনা‌রের খবর দিয়ে বলে, এতো মানুষের পাশে থাকো। আমাদের বিজনেস ফ্যাকাল্টির এই ছেলেটাকেও দেখো। ঘটনা শুনে আমি ওকে বললাম অাল্লাহ যেন ছে‌লেটা‌কে বাঁ‌চি‌য়ে রেখে কষ্ট না দেয়। তবু আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতা‌লের বার্ন ইউনিটের আই‌সিইউতে গেলাম। যাওয়ার পর মিনার অামার নাম শু‌নেই বল‌লো অাপ‌নি শ‌রিফুুল হাসান ভাই। আর সব বিসিএস পরীক্ষার্থীর মতো অাপনাকেও আমি নামে চি‌নি। আপনার লেখা পড়ি। এরপর বললো ভাইয়া আমি বাঁচতে চাই।

মিনার আমার হাত ধরে বললো, ভাইয়া আমার স্বপ্নগুলো যেন শেষ না হয়। ভাইয়া বিশ্বাস ক‌রেন আমি বিসিএসের খুব ভা‌লো লি‌খিত পরীক্ষা দি‌য়ে‌ছি। অা‌মি পাস কর‌বোই‌। অামি বিসিএসের ভাইভা দিতে চাই। অাপনি অামার পা‌শে থা‌কেন। আমাকে ভাইভা দেওয়ার ব্যাবস্থা করে দেন।

বিজ্ঞাপন

একটা ছেলে যে বাঁচবে কী না সন্দেহ সে কী না বলে আমি আমার স্বপ্নে যেতে চাই। বিসিএসের ভাইভা দিতে চাই। মিনারের সেই আকুতি শুনে অামি হাসপাতাল থে‌কে বে‌রি‌য়ে অ‌ঝো‌রে কেঁ‌দে‌ছি। ঢাকা মেডিকেল থেকে অফিসে আসার পুরোটা পথ আমি কেঁদেছি। ওকে বাঁচাতে অনেক টাকা লাগবে। যে করেই হোক যোগাড় করতেই হবে। এরপর শুরু হ‌লো অামারও লড়াই। ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় ওকে নিয়ে একটা নিউজ করলাম ‘বিদ্যুৎ​স্পৃষ্টে পুড়েছে শরীর, পুড়বে স্বপ্নও?’

আমার সেই নিউজ অনেক মানুষ পড়লো। আমি অাপনা‌দের সবার কা‌ছে অা‌র্থিক সাহায্য চাইলাম। দেশ বি‌দেশ থে‌কে অাপনারা সাড়া দি‌লেন। কতো কতো মানুষ টাকা দিলেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে আমার এক বড় বোন তার মেয়ের ল্যাপটপ কেনার টাকা আমাকে পাঠিয়ে বললেন, তার মেয়েকে বলেছেন ল্যাপটপ না হলেও এখন তার জীবন চলবে। কিন্তু টাকা না হলে মিনার বাঁচবে না। আমি কথাটা শুনে কেঁদেছি। আমার আরও কতো কতো বন্ধু যে এগিয়ে এসেছে।

সবার সাহায্যে মিনারের চিবিৎসা চললো। বার্ন ইউনিটে টানা তিন মাস থেকে বাসায় এলো মিনার। কয়েকদিন পরপর অপারেশন। যে পা দি‌য়ে অসাধারণ ফুটবল খে‌লে মা‌র্কে‌টিং বিভাগ‌কে চ্যা‌ম্পিয়ন ক‌রে‌ছিল সেই দুই পায়ের কোনোটিতেই দাঁড়া‌তে পা‌রে না। একটা পা কাটা পড়লো। একটা হাতও। কিন্তু এত কিছুর পরও জীবনের কাছে হার মানেনি মিনার। বরং অাল্লাহর ইচ্ছা অার অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে বারবার হার মেনেছে মৃত্যু।

বিজ্ঞাপন

না বাসায় ফিরেই গল্পটা শেষ হয়‌নি। ‌ফেব্রুয়া‌রি মা‌সে বি‌সিএ‌সের লি‌খিত পরীক্ষার ফল দি‌লো। স‌ত্যিই স‌ত্যিই অামার মিনার লি‌খিত‌তে উত্তীর্ণ হ‌লো। অামি ওর বাসায় গেলাম। বললাম প্রস্তু‌তি নাও ভাইভার। আমি সব ব্যাবস্থা করবো।

পুরান ঢাকা‌র অন্ধকার এক গ‌লির একটা ভব‌নের ছয় তলায় শু‌য়ে সত্যি সত্যি প্রস্তুতি নেয় মিনার। কখ‌নো হুইল চেয়া‌রে কখ‌নো বিছানায় শু‌য়ে অাকাশ দে‌খে মিনার। অামা‌কে ব‌লে ভাই অা‌মি যখন আমি বিসিএস পরীক্ষা দিই, তখন তো সুস্থ ছিলাম। আমার প্রথম পছন্দ ছিল পুলিশ। কিন্তু এখন তো আমার ডান হাত নেই। দুই পায়ের অবস্থাও খারাপ। অারও অপরা‌শেন লাগবে। এমন শারীরিক অবস্থায় আমাকে কি পুলিশে নেবে কিংবা প্রশাসনে?

অা‌মি কিছুটা জড়তা নি‌য়ে ব‌লি আরও অনেক অপশন আছে। অামি মিনারকে অাশ্বস্ত ক‌রি। অাশ্বস্ত করি মিনা‌রের জীব‌নের না‌য়িকা‌কে অামি যাকে কখ‌নো ফ্লো‌রেন্স নাই‌টেঙ্গেল অাবার কখনো মাদার তেরেসা ব‌লি। মেয়েটা সেই হাসপাতাল থেকে মিনারের সাথে আছে। আমি মিনার আর মেয়েটাকে বলে আসি আমি আছি তোমাদের পাশে। চানখারপুল থেকে কারওয়ানবাজারে ফিরে মিনারকে নি‌য়ে অাবার নিউজ ক‌রি। লি‌খি ‘তবু স্বপ্ন ছুঁ‌তে চান মিনার’।

পিএসসির সাথে যোগাযোগ করি। পিএসসির মাননীয় চেয়ারম্যান স্যার বলেন, শরীফ ওকে ভাইভা বোর্ডে আনো। ও বেঁচে থাকলে আমরা ওর ভাইভা নেবো। সত্যি সত্যি মিনারকে ভাইভা দেওয়ানোর ব্যবস্থা করা হলো। হাত নেই। তবু শার্ট প্যান্ট পরিয়ে ওকে নেওয়া হলো।

ভাইভার কয়েকদিন পর আবার মিনারকে নেওয়া হলো ভারতে। চললো আবার দফায় দফায় অপারেশন। মাঝে মধ্যে মিনার আমাকে ভারত থেকে ফোন দেয়। কখনো কাঁদে। বলে ভাইয়া ইনফেকশন হয়ে গেছে। আরও অপারেশন লাগবে। আবার অপারেশন চলে। কয়েকদিন আগে মিনার দেশে এলো। বলেলো ভাইয়া আমি এখন ক্র্যাচ নিয়ে দাঁড়াতে পারি। আমি বললাম দাঁড়াও তোমাকে দেখতে আসবো।

আজ ৩৬তম বিসিএসের প্রথম শ্রেণির নন ক্যাডারের ফল দিয়েছে। আমার মিনার আজ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিসংখ্যান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। আমার কী-যে ভালো লাগছে। আপনাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা। সবাই অামার মিনা‌রের জন্য দোয়া কর‌বেন। অামি জানি, বিশ্বাস ক‌রি মৃত্যুকে যে পরাজিত ক‌রে‌ছে, যাকে অাল্লাহ আজ প্রথম শ্রেণির কর্মকতা করেছেন তিনি জীবনের বাকি সব লড়াই‌য়ে জিতা‌বেন। শুভ কামনা মিনার! শুভ কামনা মাই ব্রাদার! অনেক অনেক ভালোবাসা!

 

সারাবাংলা/এমআই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন