বিজ্ঞাপন

‘১২ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ইলেকশন কমিশন উড়িয়ে দিয়েছিলাম’

December 5, 2020 | 11:21 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: নানা ঝক্কি-ঝামেলা আর বিপদ মাথায় নিয়ে মেলাগড় থেকে পৌঁছালাম ডেমরা। দেশে তখন পুরোদমে যুদ্ধ চলছে। সত্তরের নির্বাচনে বড় ধরনের কারচুপির খবর পাই আমরা। সিদ্ধান্ত নেই প্রাদেশিক ইলেকশন অফিসটি উড়িয়ে দেওয়ার। প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে গেরিলা টিম গঠিত হলো। রাজারবাগের উল্টোদিকে মোমিনবাগে দু’টি ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হতো ইলেকশন কমিশনের কাজ। নভেম্বর, তখন রোজা চলছে। ১২ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ইলেকশন কমিশনের সবকিছু উড়িয়ে দিয়েছিলাম।

বিজ্ঞাপন

একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকার গেরিলা বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক নান্টু। শনিবার (৫ ডিসেম্বর) সারাবাংলা ডটনেটের নিয়মিত আয়োজন ‘সারাবাংলা ফোকাস’ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে তিনি এই স্মৃতিচারণ করেন।

সারাবাংলা ফোকাস অনুষ্ঠানের এ পর্বের বিষয় ছিল ‘একাত্তর: রাজারবাগে প্রাদেশিক ইলেকশন কমিশন উড়িয়ে দেওয়ার গল্প’। গেরিলা যোদ্ধা রফিকুল হক নান্টু ছাড়াও এ পর্বে আলোচনায় যুক্ত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা গবেষক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক ও গবেষক সালেক খোকন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সারাবাংলা ডটনেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এমএকে জিলানী।

বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক নান্টু রাজারবাগের প্রাদেশিক ইলেকশন কমিশন উড়িয়ে দেওয়ার সেই অপারেশনের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন আলোচনায়। তিনি বলেন, মেলাগড় থেকে তৎকালীন ঢাকার কাছে ডেমরায় একটি অস্থায়ী ক্যাম্প করে ফেললাম। প্রায় ২৫ জন গেরিলা সদ্যস্যের ক্যাম্পের কমান্ডে ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা (ঢাকার প্রয়াত মেয়র)। খোকা গ্রুপের গেরিলা হিসেবেই পরিচিত ছিলাম। প্রাদেশিক ইলেকশন কমিশন অফিস ছিল তখন রাজারবাগের উল্টোদিকে মোমিনবাগে। দু’টি ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হতো ইলেকশন কমিশনের সব কাজ। প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে ওই অপারেশনে অংশ নেই আমি, লস্কর, সুফি আর হেদায়েতুল্লাহ। একদিন আগে জায়গাটা রেকি করে আসি। নভেম্বর মাস ১৯৭১ সাল। রোজার মাস। ঢাকায় প্রবেশ যখন করি, তখন রাত ৮টা বা সাড়ে ৮টা বাজে। তারাবির নামাজ চলছিল। দেখছিলাম ৭/৮ জন রাজাকার বসেছিল। আমরা ভবনে ঢুকে তাদের একটা রুমে নিয়ে গিয়ে তাদের পোশাক দিয়েই বেঁধে ফেলি। তারপর ১২ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ ফিট করে বেরিয়ে পরি। এরপর ঘটে বিস্ফোরণ। বিকট শব্দে যেন গোটা ঢাকা শহর কেঁপে উঠেছিল। মুহূর্তেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় পুরো ইলেকশন অফিসের সবকিছু। ওখানে থাকা এক দারোয়ান মারা যায় সে বিস্ফোরণে।

বিজ্ঞাপন

গেরিলা যোদ্ধা নান্টু বলেন, সেই অপারেশন শেষ করতে মধ্যরাত হয়ে যায়। আর্মিরা তখন টহলে নেমে গেছে। ক্যাম্পে ফেরার উপায় না দেখে মালিবাগের একটা গলি পথ দিয়ে হাঁটতে শুরু করি। একটি বেড়া দেওয়া ঘরে আশ্রয় নেই। তাদের বলি, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। তারা আমাদের আশ্রয় দিয়ে সারারাত বাইরে পাহারা দিয়েছে। সকাল হওয়ার আগেই আমরা ক্যাম্পে ফিরে যাই। আমি তো বলি, যারা এভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছেন, তারাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন ওই ঘরটিতে আশ্রয় না পেলে আমরা পাকিস্তানি আর্মিদের হাতে ধরা পড়ে যেতাম।

অনুষ্ঠানে আলোচনায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক ও গবেষক সালেক খোকন বলেন, গেরিলা যুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তারা মূলত জীবনে বেঁচে ফিরবেন না— সেই চিন্তা করেই অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন। গেরিলাদের প্রতিটি অপারেশন মুক্তিযোদ্ধাদের মনে অনেক সাহস জুগিয়েছিল। অন্যদিকে, রাজাকাররা মানসিকভাবে দুর্বল ছিলেন। অন্যান্য স্থানের গেরিলা যোদ্ধারা যেমন অপারেশন শেষ করে স্থান ত্যাগ করে ফিরে যেতে পারতেন, ঢাকার গেরিলাদের সে সুযোগ ছিল না। অপারেশন শেষে তারা যেখানে আশ্রয় নিতেন, সেটাও নিরাপদ ছিল না।

মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক নান্টুর সহযোদ্ধা ছিলেন পপ সম্রাট আযম খান। তার সঙ্গেকার নানা স্মৃতি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, যুদ্ধ প্রশিক্ষণের সময় আযম খান সারারাত ধরে ঘটি-বাটি-কলস ব্যবহার করে মিউজিক বাজিয়ে গান করতেন। তার গাওয়া অনেক জনপ্রিয় গান যুদ্ধ ময়দানে গেয়ে শোনাতেন। ঢাকায় অয়েল ট্যাংকার বিস্ফোরণ অপারেশনে অংশ নিয়ে নিজেই ওই গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন। আলোচনায় তুলে ধরেছেন তিতাস গ্যাস পাইপ বিস্ফোরণের স্মৃতি।

বিজ্ঞাপন

তৎকালীন ঢাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক নান্টু ৯ ভাই-বোনের সবার ছোট। তিনি জানান, তিন বোনের স্বামী ছিলেন পাকিস্তান আর্মির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাই ১৭ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যাওয়া বা পরিবার থেকে অনুমতি পাওয়া তার জন্য সহজ ছিল না।

বীর মুক্তিযোদ্ধা নান্টু বলেন, দেশ মাতৃকার ঝোঁক এতটাই চেপে বসেছিল যে পরিবার কিংবা মা-বাবা কোনোকিছুর চিন্তা মাথায় আসেনি। নেমে পড়েছিলাম যুদ্ধে। তবে যে স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম, তা আর পূরণ হলো কই! যখন দেখি কোনো মুক্তিযোদ্ধা বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন, কেউ রিকশা চালাচ্ছেন, তখন ভীষণ খারাপ লাগে। এই দৃশ্য দেখার জন্য যুদ্ধ করিনি আমরা। দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থেকে সৎভাবে দেশকে সবাইকে এগিয়ে নিতে হবে। এটাই একমাত্র প্রত্যাশা।

সালেক খোকন বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনও সব গেরিলা যোদ্ধাদের ভাষ্য সংরক্ষণ করতে পারিনি। এটা জরুরি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে। যারা জীবিত আছেন তাদের ভাষ্য সংরক্ষণ করা উচিত নতুন প্রজন্মকে জানানোর স্বার্থে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এখনো পূর্ণাঙ্গ হয়নি, হয়নি রাজাকারদের তালিকাও। সব মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্য সংরক্ষণের তাগিদ দেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদ প্রকাশ করে সালেক খোকন বলেন, একাত্তরে যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের মনের ভেতরে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তার ভাষণ যোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। দেশে যখন মুজিবশতবর্ষ উদযাপন চলছে, তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা ফেলে, তাহলে আমরা কি সেই বঙ্গবন্ধুকে অপমান করতে শিখেছি? কোন উন্নয়নের দিকে যাচ্ছি তবে আমরা?

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/জেআর/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন