বিজ্ঞাপন

দমদমা বধ্যভূমিতে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন, নীরব প্রশাসন

December 15, 2020 | 9:24 am

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রংপুর: বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসেও অরক্ষিত, অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত রংপুরের দমদমা বধ্যভূমি। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ ও বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের জন্য এক দশক আগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব নিলেও কার্যত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় অস্তিত্ব সংকটে দেশের অন্যতম এই বধ্যভূমি। এখন পর্যন্ত বধ্যভূমির সীমা নির্ধারণ না করায় বেসরকারি একটি কোম্পানি আর স্থানীয় ভূমিখেকোদের থাবায় বিলীন হতে বসেছে রংপুরের এই ঐতিহাসিক স্থান।

বিজ্ঞাপন

শুধুমাত্র ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে বধ্যভূমিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ছাড়া সারা বছর অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এ বধ্যভূমি।

জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের দমদমা ব্রিজের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কারমাইকেল কলেজের ৪ শিক্ষক অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায় এবং অধ্যাপক কালাচাঁদ রায় এবং তার সহধর্মিণী মঞ্জুশ্রী রায়কে কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। এরপর ৭ জুন আবারও এই স্থানে গভীর রাতে শত শত সাধারণ মানুষকে এনে এই দমদমায় গুলি করে হত্যা করা হয়।

এরপর ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর কারমাইকেল কলেজের শিক্ষকদের সংগঠন ‘কারমাইকেল কলেজ শিক্ষক পরিষদ’ মহাসড়কের পাশে একটি স্মৃতিফলক ও কলেজ ক্যাম্পাসে একটি ছোট স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। সবশেষ ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ ও বধ্যভূমি সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে দায়িত্ব নেওয়ার এক দশক পার হলেও এটি সংরক্ষণে তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিন বধ্যভূমি ঘুরে দেখা গেছে, বধ্যভূমির সীমা নির্ধারণপূর্বক কোনো সীমানা প্রাচীরসহ স্থাপনা না থাকায় বেসরকারি দেশবন্ধু গ্রুপের হাউজিং করপোরেশনের জিএম প্রোপার্টিজ উদ্যোগে দু’দিকে টিনের সীমানা প্রাচীর দেওয়া হয়েছে। তোলা হচ্ছে বহুতল ভবন। মূল মহাসড়ক হতে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়েছে স্থানটি। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে বধ্যভূমির প্রকৃত মর্মার্থ।

অন্যদিকে, ঠিক স্তম্ভের পাশ দিয়েই তৈরি করা হয়েছে বহুতল ভবনের রাস্তা। বধ্যভূমির অনেকখানি জায়গা সেই রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। ফলে ক্রমান্বয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে স্থানটি।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বধ্যভূমির সংরক্ষণে বধ্যভূমির জন্য ছয় শতক জমি দেন স্থানীয় এক বাসিন্দা। তবে বর্তমানে সেখানে ছয় শতক জমির কোনো অস্তিত্ব নেই।

বধ্যভূমির পাশেই স্থানীয় বাসিন্দা ফজলুল হকের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিলো ১৫ বছর। তিনি কারমাইকেল কলেজের ৪ অধ্যাপকসহ আরও অনেককেই পাকিস্তানিদের হাতে খুন হতে দেখেছেন। তিনিসহ আরও কয়েকজন ছিলেন, যারা সেদিন ঠিক বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভের নিচে লাশগুলো দাফন করেছিলেন।

বুদ্ধিজীবী হত্যার এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর বর্তমানের দমদমা বধ্যভূমিতে এসে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিসহ রংপুরের জেলা প্রশাসক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কলেজের অধ্যক্ষ পরিদর্শন করে গেছেন। তাদের একাধিকবার জায়গাটি সীমানা বেষ্টনী দিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছি। সবাই বধ্যভূমির সীমানা বেষ্টনীসহ পরিচর্যার আশ্বাস দিলেও আজও বাস্তবায়ন হয়নি।’

জানা গেছে, সাবেক দুই উপাচার্যের আমলে বিভিন্ন সময়ে বধ্যভূমির সীমানা নির্ধারণে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আশ্বাস দিলেও শেষ অবধি তা সম্ভব হয়নি। বর্তমান উপাচার্য যোগদানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সম্বলিত সাইনবোর্ড টাঙানো হলেও সীমানা নির্ধারণ কিংবা গবেষণার জন্য সংরক্ষণের বিষয়ে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

বিজ্ঞাপন

বধ্যভূমিটি সংরক্ষরণ এবং গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন খুব দ্রুত কার্যকারী উদ্যোগ গ্রহণের দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ও অধিকার সুরক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মতিউর রহমান বলেন, ‘দমদমা বধ্যভূমি দেখভালের জন্য কারমাইকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার এক দশকেও কোনো সংরক্ষণ ও পরিচর্যা করতে না পারাটা সত্যিই দুঃখজনক। এমন নিস্ক্রিয় কর্মকাণ্ড শহীদদের অবমামনার শামিল।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ কে এম ফরিফ-উল ইসলাম শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণের বিষয়টিকে প্রশাসনের উদাসীনতা উল্লেখ করে বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসে যদি বুদ্ধিজীবী শহীদদের আত্মত্যাগ সম্পর্কে আমরা বিশদভাবে না জানি তাহলে বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের অজানাই থেকে যাবে। তাই প্রশাসনের কাছে অনুরোধ অতিদ্রুত যেন বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও পরিচর্যার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

তবে এ বিষয়ে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে দফায় দফায় একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সারাবাংলা/এমও

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন