বিজ্ঞাপন

পুরুষের প্রোস্টেট সমস্যা ও ন্যাচারোপ্যাথি ব্যবস্থাপনা

December 19, 2020 | 2:55 pm

ডা. ঐন্দ্রিলা আক্তার

৭১ বছর বয়সী সোবহান সাহেব একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। আমার কাছে এনলার্জ প্রোস্টেটের সমস্যা নিয়ে আসেন। জানা গেল গত কয়েক মাস থেকে প্রতি এক থেকে আধাঘন্টা পর পর প্রসাবের বেগ চাপে ও বাথরুমে যেতে হয়। প্রসাবের বেগ আসলে ধরে রাখা যায় না। সাথে সাথে না করলে করতে হয় নইলে কাপড় ভিজে যায়। এছাড়াও প্রায়ই ফোঁটা ফোঁটা প্রসাব ঝরতে থাকে। এই সমস্যার জন্য সোবহান সাহেবের ঘর থেকে বের হতে বা কোথাও যেতে সমস্যা হচ্ছিল। জরুরি কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারছিলেন না। প্রসাবের স্বাভাবিক গতিও কমে যাওয়ার পাশাপাশি একবারে পুরোটা না হয়ে হয়ে থেমে থেমে হত। প্রসাব শেষ হওয়ার পর পুরোপুরি শেষ হয়নি বলে মনে হত।

বিজ্ঞাপন

এই অবস্থায়  ভুগছিলেন অনেকদিন। এর মধ্যে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একদিন ওনার প্রসাব এবং পায়খানা বন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে Retention of Urine. অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়েছিল যে, স্বাভাবিকভাবে প্রসাব না হওয়ায় সোবহান সাহেবকে ক্যাথেটার পরিয়ে প্রসাব করানো হয় এবং একদিন তাকে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়। হাসপাতাল ছাড়ার সময় ডাক্তার তাকে কয়েকটি ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন তার প্রসাবের ফ্লো ঠিকভাবে হওয়ার জন্য।

সোবহান সাহেবের স্ত্রী একজন ফার্মাসিস্ট। উনি ওষুধগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জানেন। তাই সোবহান সাহেব স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে একটি ওষুধ খাওয়া শুরু করেন। Prostacin নামের এই ওষুধটি মূলত ২৪ ঘন্টা কাজ করে। অর্থাৎ প্রতিদিন রাতে একটি ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয় পরের দিনের প্রসাবের গতি স্বাভাবিক রাখার জন্য। ওষুধ খাওয়ার পরও প্রসাব পুরোপুরি পরিস্কার হচ্ছিল না। এছাড়া ফোঁটা ফোঁটা প্রসাবও মাঝে মাঝে পড়ছিল। সোবহান সাহেব জানান যে, ওষুধ খাওয়ার পর থেকে ওনার সারাদিন ঝিমুনি থাকে, স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারেন না। কোন কাজ করা শুরু করলে কয়েক মিনিট পরে আর মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না। দিনের বেশির ভাগ সময় শুয়ে কাটাতে হয়। কোন কিছু মনে রাখতে পারেনন না। শরীরে মেদ জমে গেছে। বিশেষ করে পেটে মেদ জমে ভুড়ি হয়েছে।

সোবহান সাহেব এবং ওনার পরিবারের সাথে আমার পরিচয় ২০১১ সাল থেকে। এর আগেও ওনার কিছু অসুস্থতার জন্য উনি ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসা করে সুস্থ হয়েছেন। ওনার স্ত্রী ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসার একজন সুফলভোগী। তাই এবার যখন আমি দেশে, সেপ্টেম্বর মাসে সোবহান সাহেবের সমস্যার সমাধানের জন্য ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসা নেওয়ার জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

বিজ্ঞাপন

আমি সোবহান সাহেবের সব ল্যাব রিপোর্ট দেখি। ওনার প্রোস্টেট স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছে। উনি ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসার মাধ্যমে ওনার প্রসাব সমস্যার সমাধান চাইছেন। ওনার সঙ্গে কথা বলে বুঝিয়ে বলি যে, ওনার সমস্যার ভালো সমাধান রয়েছে তবে এর জন্য ওনাকে ধৈর্য ধরে থেরাপি চালিয়ে যেতে হবে। সোবহান সাহেব ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসা নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন এবং থেরাপি শুরু হবার চার দিনের মাথায় উনি নিজ সিদ্ধান্তে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন। অক্টোবর, নভেম্বর পুরো দুই মাস এবং ডিসেম্বরের পনের তারিখ পর্যন্ত টানা আড়াই মাস আমি ওনার হলিস্টিক থেরাপি চালিয়ে যাই।

ফলাফল
থেরাপি শুরুর পনের দিনের মধ্যেই সোবহান সাহেবের ঝিমুনি ভাব কেটে যায়। দিনে কাজ করতে শুরু করেন। এক মাস যাওয়ার পর একদিন উনি হাসতে হাসতে জানালেন যে, কাজ করার সময় এখন অনেকক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারছেন। এছাড়া প্রসাবের গতি প্রায় শতকরা বিশ ভাগ বেড়েছে। ফোঁটা ফোঁটা প্রসাব ঝরাও কমে গেছে প্রায় শতকরা পনের ভাগ। সোবহান বার বার আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন আর বলছিলেন যে, ‘আমি আশাবাদি, ন্যাচারোপ্যাথি থেরাপির মাধ্যমেই আমি ভালো হয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ’। নভেম্বর মাসে সোবহান সাহেবের প্রসাবের গতি শতকরা ষাট ভাগ বেড়ে যায় এবং ফোঁটা ফোঁটা প্রসাব ঝরাও প্রায় ঠিক হয়ে আসে। পাশাপাশি ওনার কাজের গতি ফিরে আসে আগের অবস্থায়। এখন উনি সকাল থেকে বিকাল অফিস করেন স্বাভাবিকভাবে।

যে হলিস্টিক থেরাপির মাধ্যমে সোবহান সাহেব জীবনযাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল। আসুন দেখে নেই কোন কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে সোবহান সাহেবের চিকিৎসা করি-

বিজ্ঞাপন

ফুড থেরাপি
শুরুতেই সোবহান সাহেবকে একটি দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা করে দেই। এই তালিকায় দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রোস্টেট এবং ইউরিনের সমস্যা ভালো হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার ওষুধগুলো লিখে দেই এবং কখন কোনটা খাবেন তার জন্য সময় নির্ধারণ করে দেই। এর সাথে ব্লাডার, ইউরেথ্রা, এবং কিডনি শক্তিশালী হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যগুলো লিখে দেই এবং কখন কোনটা খাবেন সেটাও সময় ধরে উল্লেখ করে দেই।

ইয়োগা
প্রতিদিন সকালে প্রোস্টেট, রিটেনশন অব ইউরিন এবং মূত্রগ্রন্থির জন্য উপকারি ইয়োগা এক্সারসাইজগুলো করানো শুরু করি। এবং টানা আড়াই মাস এই সেশন নিয়মিত চলে।

আকুপ্রেসার
প্রোস্টেট এবং ইউরিনারি ট্র্যাকের সুস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আকুপাংচার পয়েন্টগুলোতে আকুপ্রেসার থেরাপি করাই আড়াই মাস প্রতিদিন বিকেলে। এর পাশাপাশি ইমিউন সিস্টেমের উন্নতির জন্যও পয়েন্ট নির্বাচন করে থেরাপি করাই।

আমার পরিচালনায় চলা থেরাপির আড়াই মাস শেষ হলো এই ডিসেম্বরের পনের তারিখে। এখন সোবহান সাহেব একজন মেদহীন কর্মচঞ্চল মানুষ। প্রসাবের সমস্যা নিয়ে এখন আর বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় না। আড়াই মাস শেষ হলে ওনাকে নতুন একটি খাদ্যতালিকা করে দেই বর্তমান অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। এছাড়া ইয়োগার কয়েকটি আসন, প্রাণায়াম নির্ধারন করে দেই যেগুলো উনি সকালে নিজে নিজে করতে পারবেন সহজেই। আর আকুপ্রেসারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট শিখিয়ে দেই যেগুলো প্রতিদিন ত্রিশ মিনিট করলেই উনি খুব ভালো থাকবেন। আর প্রতি মাসে একবার ফলোআপ করার জন্য বলি।

বিজ্ঞাপন

সোবহান সাহেবের চিকিৎসা করাতে যেয়ে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। আমার চিকিৎসক জীবনের অনন্য প্রাপ্তির মধ্যে অন্যতম এটি। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের একদিন আকুপ্রেসার থেরাপি চলার সময় সোবহান সাহেব ওনার স্ত্রীকে বলেন, ‘তোমার মনে আছে যেবার আমার চিকুনগুনিয়া হলে আমি শয্যাশায়ী হয়ে গেলাম, সেবার ঐন্দ্রিলা আমার উপর ন্যাচারোপ্যাথি প্রয়োগ করায় আমি কত কষ্ট থেকে সুস্থ হয়ে উঠলাম! আরেকবার তোমার হিমোগ্লোবিন কমে গেলো সেবারও ঐন্দ্রিলার ফুড থেরাপি আর আকুপ্রেসারে হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক হলো। এবার আমার প্রোস্টেট আর প্রসাবের সমস্যায়ও ওনার ন্যাচারোপ্যাথী চিকিৎসা কত বড় আরাম দিলো! আমি রীতিমতো শয্যাশায়ী হয়ে গেছিলাম। ঐন্দ্রিলা আমাদের জন্য বার বার ঠিক সময়ে আল্লাহর আশীর্বাদ হয়ে আসে। ওনাকে আমাদের মনে রাখতে হবে।’ এই কথাগুলো সোবহান সাহেব আমার সামনেই ওনার স্ত্রীকে বলছিলেন আর ওনার স্ত্রী একমত হয়ে আমাকে বার বার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন। কতবার যে ওনারা আমাকে দাওয়াত করে খাইয়েছেন! আর আমার প্রতি এই দম্পতির ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এই লেখায় নয়, আমার বইয়েও জানাবো। ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসার মাধ্যমে যারা সুফল পেয়েছেন তাদের ভালোবাসায় আমি ধন্য এবং কৃতজ্ঞ। এই মানুষগুলোর অনুপ্রেরণা আর উৎসাহেই আমি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এই বিকল্প ধারার চিকিৎসাটি নিয়ে কাজ করার শক্তি এবং সাহস পাই।

এদিকে মিসেস সোবহান নতুন বছর ওনাদের সাথে উদযাপনের করার জন্য অগ্রীম দাওয়াত দিয়ে রেখেছেন। ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসার মাধ্যমে এমন আলোকিত মানুষদের কষ্ট দূর করে তাদের মুখে হাসি আনা আমার জন্য পরম পাওয়া এবং গর্বের।

সারাবাংলা/আরএফ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন