বিজ্ঞাপন

শিল্পী-স্বজনের ভালোবাসার অশ্রুতে আব্দুল কাদেরের শেষ বিদায়

December 26, 2020 | 10:08 pm

আশীষ সেনগুপ্ত

আব্দুল কাদের। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের সুবাদে  ‘বদি’ নামে দেশের নাট্যাঙ্গনের জনপ্রিয় মুখ। অভিনয় দিয়েই সবার সবার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন এই মানুষটি। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে গেলেন জনপ্রিয় এই অভিনেতা। আজ (শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর) সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া শোবিজ অঙ্গনে। শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিজ্ঞাপন

ভারতের চেন্নাইয়ে চিকিৎসা চলছিল আব্দুল কাদেরের। সেখানে তার কেমোথেরাপি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রক্তের হিমোগ্লোবিন ক্রমেই কমতে থাকায় কেমোথেরাপি দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান সেখানকার চিকিৎসকরা। পরে তাকে সংকটাপন্ন অবস্থায় ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

রোববার (২০ ডিসেম্বর) দুপুরে দেশে ফেরার পর তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাকে। সেখানেই আজ (শনিবার) সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।

আব্দুল কাদেরের পুত্রবধূ জাহিদা ইসলাম জেমি ও নাতনী সিমরিন লুবাবা

অসংখ্য টিভি নাটক, মঞ্চ ও সিনেমায় অভিনয় করা এই গুণী শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাতে বিকেল ৩টায় তার মরদেহ আনা হয়েছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে। তার প্রাণহীন দেহটা ঘিরে রেখেছিলেন তারই স্বজনরা। কারও হাতে ফুল, কারও চোখে জল। ভালোবাসা যে কখনোই আনুষ্ঠানিকতা নয়, পুষ্পাঞ্জলিতে আপন আবেগের প্রকাশে সেটিই জানিয়ে গেলেন তারা।

বিজ্ঞাপন

শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে ভালোবাসা জানালেন সকলেই। আব্দুল কাদেরের দীর্ঘদিনের অগ্রজ-অনুজ সঙ্গীরা। সবাই নির্বাক। বেদনার্ত হৃদয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানালেন সতীর্থরা। এ কান্না যেন সবার। হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসছে।

‘আব্দুল কাদের’ যে সবার হৃদয়কে কতটা আলোড়িত করে রেখেছিল, তাই যেন প্রকাশ পেল তাদের শোকার্ত উচ্চারণে—

বিজ্ঞাপন
  • ফেরদৌসি মজুমদার

কাদের আমার খুব প্রিয় ছিল। আমার ভাইয়ের মতো। আমাদের থিয়েটারের অন্যতম সদস্য সে। অসম্ভব মেধাবী ও রসবোধসম্পন্ন একজন মানুষ সে। যখন যে অবস্থায় থাকুক না কেন, আসর জমিয়ে রাখতে খুব পছন্দ করত। যে নাটকেই অভিনয় করত, পুরো নাটকটাই তার মুখস্থ থাকত। আব্দুল্লাহ আল মামুনের প্রিয় শিল্পীদের একজন এই কাদের। বেশ কয়েকটা নাটকে সে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছে। কখনোই আমরা তার বিকল্প চিন্তা করতে পারিনি। খুব ভোজনরসিক ছিল। আমার বাসায় এলে নিজের মতো করেই থাকত। যেন এটাও তার নিজের বাড়ি। কাদের আর কখনোই আসবে না। যে চলে যায়, সে কী আর ফিরে আসে! প্রার্থনা করি— যাদের সে রেখে গেছে, তার সবাই যেন ভালো থাকে, শান্তিতে থাকে।

  • লিয়াকত আলী লাকি

বাংলাদেশের প্রথিতযশা একজন নাট্যব্যক্তিত্বকে আজ আমরা হারালাম। এভাবে আর কত প্রয়াণ! আর কত বিদায়! যে মানুষটি যায়, তিনি কতজনের কত উপকার করে দিয়ে চলে যান। এমনই একজন অভিনেতা আব্দুল কাদের। যিনি সারাজীবন নাট্যদল ও নাট্যকর্মীদের একের পর এক সাহায্য-সহযোগিতা করে গেছেন। মঞ্চে তার অভিনয় শুধু অ্যাকটিং নয় রি-অ্যাকটিংও ছিল। এতটাই ক্ষমতা ছিল তার। প্রবাদ আছে— কোনো সমাজ থেকে যদি একজন প্রবীণ লোক প্রয়াত হয়, তাহলে সেই সমাজের যেন একটি লাইব্রেরিই পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আমি জানি না, কাদের ভাইকে কি শুধু কি একটা লাইব্রেরিই বলব, নাকি তার থেকেও অনেক বেশি কিছু ছিলেন তিনি।

বিজ্ঞাপন
  • নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু

কাদের আর আমি একসঙ্গে ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমাদের মঞ্চযাত্রা শুরু করেছিলাম। সেটা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতা। কাদের ছিল মহসিন হলের নাট্য সম্পাদক। আর এই প্রতিযোগিতায় আমি মহসিন হলের ছাত্র হিসেবে সেলিম-আল-দ্বীনের ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ নাটকটির নির্দেশনার দায়ত্ব পেয়েছিলাম। সে সময়টায় আমি কিছুটা চঞ্চল প্রকৃতির ছিলাম। বলা যায় আমাকে ধরে রাখাটা কঠিন। এক সময় এক এক জায়গায় আমার আড্ডা। সেই সব আড্ডা থেকে আমাকে ধরে নিয়ে মহড়া কক্ষে ঢোকানো হতো। আর এই কাজটি করত কাদের। এবং সেটা সে খুবই মজা নিয়েই করত। কখনো দেখিনি রেগে যেতে। আমার দেখা অসাধারণ একজন ভালো মানুষ সে। মানুষ হিসেবে যে উচ্চতা সে অর্জন করেছিল, অভিনেতা হিসেবেও সে একইরকম উচ্চতায় তার আসন।

  • ত্রপা মজুমদার

আমি বিটিভিতে আব্দুল্লাহ আল মামুনের একটা নাটকে অভিনয় করছিলাম। ওখানে আমার একটা মৃত্যু দৃশ্য ছিল। আমি এরকম খাটিয়ার ওপরে শোয়া। একইসঙ্গে অভিনয় করছিলেন কাদের কাকা (আব্দুল কাদের) ও আমার মা (ফেরদৌসি মজুমদার)। কাদের হঠাৎ বলে উঠলেন, আমি এই দৃশ্য করতে পারব না। মামুন কাকা (আব্দুল্লাহ আল মামুন) ধমক দিয়ে বললেন, ‘কাদের, এটা তো নাটক। আমি করছি, তুমিও পারবে।’ কাদের কাকা বললেন, ‘না আমি পারব না। আমি ত্রপাকে এরকম খাটিয়ার মধ্যে দেখতে পারব না।’ কিন্তু আজ আমাদেরই দেখতে হচ্ছে, উনি শুয়ে আছেন খাটিয়াতে। তারপরও শুধু এটাই মনে করতে চাই, কাদের কাকা তার শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এমন মেধাবী অভিনেতাকে দেশের অভিনয় জগত সারাজীবন মনে রাখবে। উনি শান্তিতে থাকুক।

  • আফজাল শরিফ

এ বছরটা আমার জন্য খুবই খারাপ একটা বছর। ক’দিন আগেই হারালাম আলী যাকের মামাকে। আর আজকে…! গত দুই দশক ধরে আমি উনার সঙ্গে কাজ করছি, যাকে আমি মামা ডেকে আসছি এতদিন। আজ এই মামাও চলে গেলেন। আমি আমার দুই মামাকেই হারালাম। আর কিছুই বলার নাই আমার। সবার কাছে উনার জন্য দোয়া চাই। মহান আল্লাহ্‌ যেন উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আরেকটা কথা বলতে চাই— আমার জানামতে উনি কখোনোই কাউকে কোনো দুঃখ দেননি। তারপরও যদি কেউ কোনো কষ্ট পেয়ে থাকেন, আমি একজন শিল্পী হিসেবে আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি— উনাকে মাফ করে দেবেন।

আব্দুল কাদেরের স্ত্রী খাইরুননেছা কাদের

  • এস এ হক অলিক

একের পর এক গুণীজনদের আমরা হারাচ্ছি। কয়েকদিন আগে আলী যাকের, এরপর মান্নান হীরা, আর আজ আব্দুল কাদের– এই শূন্যতাগুলো পূরণ হওয়ার নয়। এই সৃষ্টিশীল মানুষদের হারিয়ে আমরা অভিবাবকশূন্য হয়ে পড়ছি।

  • রামেন্দু মজুমদার

কাদেরের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল সে যখন চেন্নাইয়ের হাসপাতালে। সম্ভবত গত ১৬ ডিসেম্বর। ওর পুত্রবধূ আমাকে ভিডিও কলে কাদেরের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলো। তার একটাই কথা— ঢাকা যেতে চাই, কিন্তু টিকেট পাচ্ছি না। যাই হোক, গত ২০ তারিখ সে এলো। আসলে সে আপন মানুষগুলোর সঙ্গেই থাকতে চাচ্ছিল। একজন মানুষ যখন জানে তার জীবন শেষ হয়ে আসছে, তখন যে কী যন্ত্রণা এবং বাঁচার যে কী আকুতি, সেটা বলে বোঝানো যায় না। কাদেরকে দেখে আমার সেটা মনে হয়েছে।

১৯৭৪ সাল থেকে কাদের থিয়েটারের একজন সদস্য। একদিকে যেমন একজন অভিনেতা হিসেবে, তেমনি আবার একজন সংগঠক হিসেবেও থিয়েটারে একেবারেই অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদকও হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছিল। আমার একটা নির্ভরতার মানুষ ছিল এই কাদের। পুরো একটা নাটকের সব সংলাপ তার মুখস্থ থাকত। ওর মতো এতো প্রতিভাবান একজন মানুষ আমি কমই দেখেছি। সবসময় আনন্দে থাকতে চাইত, অন্যকেও আনন্দ দিত। শেষ দিকে বছর দশেক নিজের ব্যস্ততার কারণে মঞ্চে সময় দিতে পারেনি। কিন্তু সে টেলিভিশনের মাধ্যমে যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, সেটা খুব কম অভিনেতার ভাগ্যেই ঘটে। আমরা কাদেরকে মনে রাখব। আমরা আমাদের ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় এবং যতদিন কাজ করব, কাদের আমাদের সঙ্গে থাকবে। কাদের তুমি তোমার মায়ের কোলে ঘুমাও শান্তিতে, এর চেয়ে আনন্দের আর শান্তির আর কী হতে পারে।

ছবি: সুমিত আহমেদ

সারাবাংলা/এএসজি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন