বিজ্ঞাপন

‘হুকুমত বলেছে, ভাসানচরে গেলে নিরাপত্তা দেবে’

December 29, 2020 | 3:34 pm

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ‘ওখানে (কক্সবাজার) মারামারি-কাটাকাটি বেশি। সারাদিন কাজকাম নাই, শুধু মারামারি করে। আমাদের কোনো নিরাপত্তা নাই। এত অশান্তি ভালো লাগে না। হুকুমত (সরকার) বলেছে, ভাসানচরে গেলে নিরাপত্তা দেবে। সেজন্য ওখানে চলে যাচ্ছি।’

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (২৯ ডিসেম্বর) সকালে ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা দেওয়া রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় দলের মো. সলিমুল্লাহ সারাবাংলার কাছে এমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

মিয়ানমারের বুচিদং থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে পালিয়ে এসে তিনবছর আগে কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া সলিমুল্লাহ’র মতো অধিকাংশ রোহিঙ্গাই ভাসানচরে যাচ্ছেন শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা, ভালো থাকা এবং নিরাপদ জীবনের আশায়।

মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে তাদের ঠাঁই হয়েছিল সাগরতীরের জনপদ উখিয়া-টেকনাফের পাহাড়ে। সেই পাহাড় ছেড়ে সাগরদ্বীপে গিয়ে উদ্বাস্তূর জীবনে কিছুটা স্বস্তি মেলার বার্তা তারা পেয়েছেন প্রথম দফায় ভাসানচরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে। দ্বিতীয় দফায় যাওয়া প্রায় সবারই আত্মীয়স্বজন আছেন এখন সেখানে। সেজন্য রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাবার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় থাকা নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রত্যাশার চেয়েও দ্বিতীয় দফায় বেশি রোহিঙ্গা গেছেন নোয়াখালীর ভাসানচরে।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন:

ভাসানচরে গিয়ে দোকান খুলবেন, মুরগি-কবুতর পুষবেন কিংবা ছাগল-ভেড়া-মহিষের চাষ করে আয়-উপার্জনের পথ তৈরি করে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দ্বিতীয় দলে থাকা অনেকের চোখেমুখে। যাদের বয়স কম, তাদের স্বপ্ন ভাসানচরে গিয়ে সরকারিভাবে গড়ে তোলা স্কুল-মাদরাসায় ভর্তি হবেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় আসা অনেকের প্রত্যাশা শুধু মাথার ওপর একটি শক্ত ছাদ, যা ভাসানচরে আছে বলে নিশ্চিত হয়েই সাগরে ভেসেছেন তারা।

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের উন্নত জীবনযাপনের সব সুযোগ-সুবিধা আছে বলে জানিয়েছেন নৌবাহিনীর চট্টগ্রাম নৌ অঞ্চলের কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল মোজাম্মেল হক। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বারবার বলছি যে, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত প্রায় ১১ লাখের ওপরে নাগরিক, তাদের যতদিন পর্যন্ত এখান থেকে ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না, ততদিন পর্যন্ত যাতে তারা একটা নিরাপদ জীবন পায়, সেজন্য ভাসানচরে নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাসানচরে সবধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা আছে। এখানে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, খেলার মাঠ, হাসপাতালসহ নিরাপদে থাকার সব ব্যবস্থা আছে। তিন হাজার কোটি টাকা সরকার খরচ করেছে। নৌবাহিনী এটা বাস্তবায়ন করেছে। বিশ্বের ইতিহাসে কোনো দেশের কোনো সরকার বাস্তুচ্যুত, উদ্বাস্তূ মানুষের জন্য এমন কোনো ব্যবস্থা করেছে বলে আমাদের জানা নেই। এটা মানবিকতার বিরল উদাহরণ।’

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় দফায় এক হাজার ৮০৪ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে নৌবাহিনীর এই কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রথম গ্রুপে ১ হাজার ৬৪২ জনকে আমরা পাঠিয়েছিলাম। তারা নিশ্চয় সেখানকার নিরাপদ পরিবেশ দেখে স্বস্তিবোধ করেছেন। সেজন্য তারা আত্মীয়স্বজনকে খবর দিয়েছেন সেখানে চলে যাবার জন্য। আজ এখানে যারা গেছেন তাদের অনেকেই ভাসানচরে থাকা রোহিঙ্গাদের আত্মীয়স্বজন। ১ হাজার ৮০৪ জন রোহিঙ্গা গেছেন, যেটা আমরা প্রত্যাশাও করিনি।’

সোমবার রাতে কক্সবাজারের উখিয়া থেকে ৩০টি বাসে করে রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় দলকে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গায় বিএফ শাহীন কলেজের মাঠে আনা হয়। সেখানে রাতযাপনের পর মঙ্গলবার সকালে তাদের পতেঙ্গায় নৌবাহিনীর বোটক্লাবসংলগ্ন জেটিতে নিয়ে জাহাজে তোলা হয়। ছয়টি জাহাজে করে তারা রওনা দেয় ভাসানচরের উদ্দেশে। দুপুর ২টার দিকে তারা গম্তব্যে পৌঁছে।

বোটক্লাবে গিয়ে দেখা যায়, কাপড়চোপড়-নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী এমনকি ঘটিবাটি-হাড়িপাতিলও সঙ্গে নিয়েছেন রোহিঙ্গা সদস্যরা। কারও হাতে একটি মুরগি। কেউ নিয়েছেন তারও বেশি। কেউ বহন করছেন ৫-৬টি পোষা কবুতর। জাহাজের ডেকে বসার পর শিশুরা মেতে উঠেছেন স্বভাবসুলভ খেলা আর ‍দুষ্টুমিতে। দ্বীন ইসলাম নামে এক রোহিঙ্গা যুবককে দেখা গেছে জাহাজের ডেকে বসে মনের আনন্দে গান করছেন।

বিজ্ঞাপন

ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে বিভিন্ন বয়সী বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলা’র। মিয়ানমারের মংডুর মেরুলা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে কুতপালংয়ে আশ্রয় নেওয়া হুমেরা বেগম স্বামী ও চার সন্তানের সঙ্গে যাচ্ছেন ভাসানচরে। তিনি বলেন, ‘সবাই বলছে, সেখানে অনেক ভালো হবে। হুকুমত ঘর দিচ্ছে, ভাত দিচ্ছে, কাপড়-চোপড় দিচ্ছে। আবার প্রত্যেক পরিবারকে মাথাপিছু পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়েছে। আমরা পেয়েছি ৩০ হাজার টাকা।’

মিয়ানমারের বুচিদং থেকে বিতাড়িত হয়ে উখিয়ায় কুতপালংয়ে আশ্রয় নেওয়া নুরুল ইসলামের পরিবার পেয়েছে ২৫ হাজার টাকা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘কক্সবাজার থেকে অনেক ভালো থাকব। সেখানে মারামারি বেশি হচ্ছে এখন। তিনবেলা ভাত খেতে পারলে হবে।’

নুরুল ইসলামের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মারামারি-কাটাকাটি অশান্তি লাগে। যেখানে শান্তি পাব, নিরাপত্তা আছে সেখানে যাব। ভাসানচরে নিরাপত্তা আছে, সেজন্য চলে যাচ্ছি।’

ওমর হামজা নামে এক যুবক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আত্মীয়স্বজন আগে ভাসানচরে গেছে। তারা বলেছে, সেখানে নিরাপত্তা আছে, খাবারের ব্যবস্থা আছে। সেজন্য যাচ্ছি।’

কক্সবাজারে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণ সহযোগিতার কারণে খুব একটা অভাবে ছিলেন না রোহিঙ্গারা। এরপরও ভাসানচরে যেতে আগ্রহী হওয়া নিয়ে আব্দুস সালাম নামে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি সারাবাংলাকে বলেন, ‘তিনবছর আগে যখন আসছিলাম তখন বেশি রিলিফ পেতাম। এখন কমে গেছে। এরপরও যা পাচ্ছিলাম, তিনবেলা খেতে পারতাম। কিন্তু থাকার জায়গা না থাকলে, রাতে ভালো করে ঘুমাতে না পারলে শুধু ভাত খেয়ে কি থাকা যায়? বাঁশের বেড়া দিয়ে ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া ঘর ছিল। বর্ষার দিনে বৃষ্টি পড়ে, শীতকালে কুয়াশা। রাতে ঘুমাতে পারি না। ভাসানচরে নাকি পাকা ঘর, সেখানে বেশি গম (ভালো) শুনেছি, সেজন্য যাচ্ছি।’

আব্দুস সালাম শুধু স্ত্রী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক তিন ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়েছেন; দুই যুবক ছেলে রয়ে গেছেন কক্সবাজারে। তিনি জানিয়েছেন, ভাসানচরে গিয়ে তাদের খবর পাঠাবেন। যদি সত্যিই পরিবেশ ভালো হয়, তাহলে পরবর্তী দফায় তাদেরও চলে যেতে বলবেন।

আবদুল্লাহ নামে এক যুবক সারাবাংলাকে বলেন, ‘কক্সবাজারে এখনও আত্মীয়স্বজন রয়ে গেছে। তাদের জন্য খারাপ লাগছে। কক্সবাজারের জন্য খারাপ লাগছে না। আল্লাহ দিলে আমরা ভাসানচরে অনেক ভালো থাকব।’

রোহিঙ্গাদের প্রায় সবাই প্রথম দফায় গিয়ে ভাসানচরে অবস্থানরত স্বজনদের কাছ থেকে বার্তা নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। প্রায় ৩১ বছর বয়সী যুবক মো. কবিরের সঙ্গে যাচ্ছে স্ত্রী ও চার ছেলে। কবির সারাবাংলাকে জানান, প্রথম দফায় তার বোনের পরিবার ভাসানচরে গেছে। তারা বলেছে, সেখানে স্কুল-মাদরাসা আছে। সেখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েদের স্কুলে-মাদরাসায় ভর্তি করা হয়েছে। কবিরও ভাসানচর গিয়েই তার ছেলেদের মাদরাসায় ভর্তি করে দেবেন।

ইয়াসিন নামে ২৪ বছরের এক যুবক জানালেন, ভাসানচরে প্রথম দফায় তার কয়েকজন বন্ধু পরিবার নিয়ে গেছেন। তারা জানিয়েছেন, সেখানে কক্সবাজারের চেয়ে ভালো আছেন। সেজন্য ইয়াছিনও ভাসানচরে যাচ্ছেন স্বেচ্ছায়।

একই বয়সী মো. ইউসুফ নামে আরেক যুবক যাচ্ছেন স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমার আব্বা-আম্মা আগেই চলে গেছেন। উনারা ভালো আছেন। এখন আমরা যাচ্ছি।’

দুলাভাইয়ের কাছ থেকে অভয় পেয়ে দুই সন্তান নিয়ে স্বামী পরিত্যক্তা রাশেদাও ভাসানচরে যাচ্ছেন নতুন বসতি গড়তে। খালার পরিবারের টানে কক্সবাজার ছেড়ে সেখানে থিতু হতে গেছেন বালুখালী ক্যাম্পের বাসিন্দা হামিদ হোসেনও। প্রতিবেশির কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে চলে যাচ্ছেন কুতপালং ক্যাম্পের মো. ইউনুস।

কারও কারও চোখে আবার ভাসানচরে তৈরি স্কুল-মাদরাসায় পড়ার ইচ্ছা প্রবল। উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প থেকে মা-বাবার সঙ্গে ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা দেওয়া আসমা (১৫) জানালেন, তিনি বালুখালী এলাকার একটি মাদরাসায় ষষ্ঠ শ্রেণি সম্পন্ন করেছেন। ভাসানচরে গিয়ে আবারও মাদরাসায় ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শেষ করার ইচ্ছা আছে তার।

কুতপালং ক্যাম্প ছেড়ে আসা মো. ইসমাইলের ইচ্ছা ভাসানচরে গিয়ে একটা মুদির দোকান দেবেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্যাম্পে আমার একটা দোকান ছিল। গত কয়েকমাসে বেচা একদম বন্ধ। আয়-রোজগার নাই। ভাসানচর যেতে রাজি হওয়ার পর সরকার আমার পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা দিয়েছে। সেই টাকা দিয়ে ভাসানচরে আবার দোকান খুলব।

শহীদুল (২৩) রওনা দিয়েছেন খাঁচায় চারটি কবুতর নিয়ে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘কবুতর পুষব। বড় হলে বিক্রি করব। কিছু না কিছু তো করে খেতে হবে। হুকুমত এত সাহায্য করছে, আমরা কতদিন বসে বসে খাব?’

২০১৭ সালের আগস্টে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা রোহিঙ্গারাই শুধু ভাসানচরগামী দলে নেই, যাচ্ছেন অনেক পুরনো আশ্রিতরাও। মিয়ানমারের মংডু থেকে কমপক্ষে ৩০ বছর আগে আসা করিমুল্লাহও যাচ্ছেন স্ত্রী, চার ছেলে নিয়ে। তিন বছর আগে তারা থাকতেন টেকনাফের শামলাপুরে ঝুপড়িঘরে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢল শুরুর সুযোগেও তারাও উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে ঢুকে পড়েন বলে জানান।

কুতপালং ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়া মো. ইসমাইলও কক্সবাজারে ঢুকেছেন প্রায় ১৮ বছর আগে। ২০১২ সালে টেকনাফ সীমান্ত নিয়ে প্রবেশ করে শামলপুরে থাকতেন জোহরা বেগমের পরিবার। তারাও ভাসানচরে গেছেন।

বয়স প্রায় নব্বইয়ের কোঠায় পৌঁছা ফজল হক মেয়ের কাঁধে ভর দিয়ে পৌঁছেন জেটিতে। ৭০ পার করা বৃদ্ধা ভর করেছেন ছেলের কোলে। শেষ বয়সে একটু স্বস্তির খোঁজে তারাও ‘শয্যা পাততে চলেছেন সাগরদ্বীপে’।

ছবি: শ্যামল নন্দী

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন