বিজ্ঞাপন

আতশবাজির আলো কতটা ভালো?

December 30, 2020 | 10:17 pm

শেখ আনোয়ার

প্রতিবছর ইংরেজি থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনকে ঘিরে আতশবাজি ফাটানোর একটা প্রচলন রয়েছে। তবে এবারের থার্টি ফার্স্ট নাইট যে কোনো বছরের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম। কারণ, করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্ববাসীর ঘুম কেড়েছে। চমকে রয়েছে মানুষ। শয়ে শয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে রোজ। ধুঁকছে অর্থনীতি। মানুষ চাপের মধ্যে রয়েছে। উদ্বেগে রয়েছে। এরই মধ্যে সিঁদুরে মেঘ দেখছে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ। চলে এসেছে ব্রিটিশের নতুন করোনা। ভরা এই করোনাকালে আমরা নতুন বছরকে গ্রহণ করতে যাচ্ছি। তাই এই বছর আতশবাজি ফাটানো হয়তো উচিত নয়। ৩১ ডিসেম্বর রাতে নতুন বছর উদযাপনকে ঘিরে আতশবাজি নিয়ে আম জনতার মনে উৎকণ্ঠা প্রকাশিত হয়। শব্দবাজির দাপট কি এবার আরও বাড়বে? পরিবেশকর্মীরা সচেতন করেন আমাদের। আতশবাজি, শব্দবাজি কত ক্ষতি করতে পারে? বলে চলেন তারা। বোঝান। তবুও শব্দ চমকাতেই থাকে।

বিজ্ঞাপন

আতশবাজি কেমন করে এলো
আতশবাজির প্রচলন অনেক আগে থেকেই রয়েছে। প্রায় দু’হাজার বছর আগে চীন দেশে হ্যান রাজবংশ রাজত্ব করতো। সেসময় চীন-দেশীয়দের ধারণা ছিলো, অনাবৃষ্টি, মহামারি, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয় অপদেবতাদের অপকর্মের ফলে। তাই তারা ওসব শয়তানদের ভয় দেখাবার উদ্দেশ্যে আতশবাজি করতো। নানারকম বাজি পটকা ফাটাতো। এই বিশ্বাস বহুকাল ধরেই প্রচলিত ছিলো। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১২৩২ সালের অনেক আগে থেকেই চীনদেশে উৎসব অনুষ্ঠানে হাউই-বাজি আকাশে পাঠানো হতো। সেই বছরই ইতালিতে সর্বপ্রথম আনন্দ উৎসবে বাজি পোড়ানো হয়। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আরও দেখা যায়, ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথের আমলে, ১৫৭২ সালে, ওভারভিচ শহরে এক বিরাট আতশবাজি পোড়ানোর উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে, পঞ্চদশ লুইয়ের উৎসাহে এবং পৃষ্ঠপোষকতায়, ফরাসি দেশেও আতশবাজি পটকা নিয়ে নানারকম উৎসব অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।

আতশবাজি তৈরির কলাকৌশল প্রথম দিকে খুবই গোপন রাখা হতো। আর সে যুগে এই বিদ্যা ছিলো সম্পূর্ণরূপে পরিবারকেন্দ্রিক। বাবা শিখিয়ে দিতো ছেলেকে, আর ছেলে শিখিয়ে দিতো তার ছেলেকে। এভাবে এই বিদ্যা বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হতো। এজন্য প্রতিটি পরিবারের আতশবাজির বৈশিষ্ট্য ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা। তবে এই ব্যাপারে রোমের রুঞ্জিয়ারি পরিবারের খুব সুনাম ছিলো এবং প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে তারা এই সুনামের অধিকারী ছিলেন। ১৭৪৯ সালে, এক শান্তি চুক্তির বর্ষপূর্তি উৎসব উপলক্ষে, ইউরোপের বিভিন্ন শহরে আতশবাজি পোড়ানো হয়। এজন্য তখনই ইতালি থেকে লন্ডনে এসেছিলেন বেশ কয়েকজন বাজি-বিশেষজ্ঞ। তারপর ইংল্যান্ডের ব্রুক পরিবারের অনুপ্রেরণায় অনেকেই আতশবাজি পটকা তৈরি করে সেগুলো বিক্রি করতে থাকে। ১৮৬৫ সালে, চার্লস টমাস ব্রুক লন্ডন শহরের ক্রিস্টাল প্রাসাদে এক আতশবাজির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। এরপর থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত, প্রত্যেক বছরই ওই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আনন্দ-উৎসবে নানারকম আতশবাজি পোড়ানো হয়ে থাকে। আমাদের দেশে নানারকম আতশবাজি পোড়ানোর প্রথা একেবারে নতুন কিছু নয়। সম্ভবত ৬৩৫ সালে, হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা আতশবাজি তৈরির কলা কৌশল চীন থেকে বঙ্গদেশে আমদানি করেন। শোনা যায়, ১৭৮৩ সালে, টিপু সুলতান ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় খবর পাঠানোর উদ্দেশ্যে, সংকেত হিসেবে, আতশবাজি ব্যবহার করেছিলেন।

আতশবাজির বিজ্ঞান রহস্য
আতশবাজিতে কী থাকে? আতশবাজির মধ্যে থাকে একটি সহজদাহ্য মিশ্রণ। যা বাতাসের সাহায্য ছাড়াই জ্বলতে পারে। এজন্য প্রধানত ব্যবহার করা হয় পটাসিয়াম ক্লোরেট। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় পটাশিয়াম নাইট্রেট অথবা সোডিয়াম নাইট্রেট। এছাড়া দাহ্য পদার্থ হিসেবে থাকে কাঠ-কয়লার গুঁড়ো, সালফার বা গন্ধক ইত্যাদি। আগুন লাগলে, পটাসিয়াম ক্লোরেট থেকে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন বেরিয়ে আসে। আর তারই সাহায্যে অন্য পদার্থগুলো জ্বলতে থাকে। এই হলো নানা রকম আতশবাজির আসল বিজ্ঞান রহস্য। আমাদের জানা সবচেয়ে প্রাচীন বিস্ফোরক পদার্থ হলো বারুদ। পুরনো দিনে, বিস্ফোরক পদার্থ হিসেবে, কামান-বন্দুকে এটিই সর্বত্র ব্যবহার করা হতো। ১২৫০ সালে রজার বেকন সর্বপ্রথম বারুদ-এর বর্ণনা করেন। তখন বারুদের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হতো—সোরার সঙ্গে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে কাঠ কয়লার গুঁড়ো এবং সালফার বা গন্ধক। পরবর্তীকালে আরও উন্নতমানের যে বারুদ ব্যবহৃত হয়, তার উপাদান ছিলো এই রকম-পটাসিয়াম নাইট্রেট বা সোরা-পঁচাত্তর শতাংশ, কাঠ-কয়লার গুঁড়ো-পনেরো শতাংশ এবং সালফার (বা গন্ধক)-দশ শতাংশ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে অনেক উন্নতমানের বিস্ফোরক পদার্থ আবিষ্কৃত হয়, যেমন-নাইট্রোগ্লিসারিন, গান-কটন, কর্ডাইট প্রভৃতি। সেজন্য কামান-বন্দুকে এখন আর বারুদ ব্যবহৃত হয় না। বর্তমানে বারুদ ব্যবহার করা হয় প্রধানত আতশবাজি, পটকা, তুবড়ি, হাউই বাজি প্রভৃতি প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে।

বিজ্ঞাপন

আতশবাজি বানানো হয় কীভাবে
তুবড়ির খোলের মধ্যে বারুদ ঠেসে ভর্তি করে নেওয়া হয়। বারুদের সঙ্গে অবশ্য খানিকটা লোহার গুঁড়ো, অথবা অ্যালুমিনিয়াম-পাউডার মিশিয়ে নেওয়া হয়। তুবড়ির মুখে আগুন ধরিয়ে দিলে, বারুদ জ্বলে ওঠে এবং জ্বলন্ত আগুন ফোয়ারার মতো করে উপর দিকে উঠে যায়। আর সেই সঙ্গে নানা রকম আলোর ফুলকি ছিটকে বেরুতে থাকে। তখন দেখতে খুব মজা লাগে। আতশবাজির মাথায়, নিচের দিকে থাকে বারুদ, আর তার উপরে থাকে নানারকম আতশবাজির মসলা। হাউইয়ের সলতেয় আগুন ধরিয়ে দিলেই তা প্রচণ্ড বেগে আকাশের দিকে ছুটে যায়। কিন্তু কেন এমন করে ছুটে যায়? বিজ্ঞানী নিউটন বলেছেন, প্রতিটি ক্রিয়ার বিপরীতমুখী এবং সমপরিমাণে প্রতিক্রিয়া রয়েছে। হাউয়ের সলতেয় আগুন ধরিয়ে দিলে, সঙ্গে সঙ্গে বারুদে আগুন ধরে যায়। এর ফলে হাউইয়ের তলা দিয়ে প্রবল বেগে গ্যাস বেরুতে থাকে। এই গ্যাস বেরুনোটা হলো ক্রিয়া। কাজেই এর সমান এবং বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই দেখা দেবে? অর্থাৎ, ওই গ্যাস যত জোরে তলা দিয়ে বেরুতে থাকবে, প্রতিক্রিয়া ঠিক ততো জোরে হাউইটিকে উপর দিকে ঠেলে তুলতে থাকবে। যে হাউইয়ের বারুদ ভালো এবং বেশি পরিমাণে থাকবে, তা আকাশে ততো বেশিদূর পর্যন্ত উপর দিকে উঠে যাবে। এভাবে হাউই-বাজি উপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে উপরদিকে অবস্থিত বাজির মসলায় আগুন ধরে যায়। তাই তখন তা পটকার মতো, সশব্দে ফেটে যায়। সেই সঙ্গে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে আলোর রোশনাই। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, হাউইয়ের নিচের দিকে একটা কাঠি লেজের মতো লাগানো থাকে। এটি অনেকটা নৌকার হালের মতো কাজ করে হাউইয়ের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। হাউইটিকে উপরের দিকে ঠিক পথে চালনা করে।

আতশবাজির আলোর রঙ রহস্য
আতশবাজির রঙ-মশালে থাকে প্রধানত ম্যাগনেসিয়ামের গুঁড়ো। বাতাসের সংস্পর্শে ম্যাগনেসিয়াম যখন জ্বলে, তখন খুব উজ্জ্বল আলোক উৎপন্ন হয়। চারিদিক আলোয় ছেয়ে যায়। তারাবাতি যখন জ্বলে, তখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যায়। এর কারণ ফুলঝুরি বা তারাবাতিতে স্ফুলিঙ্গ বা আলোর ফুলকি সৃষ্টি করার জন্য সীসার যৌগ, লোহার গুঁড়ো বা অ্যালুমিনিয়ামের গুঁড়ো ইত্যাদি মিশিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে বাজারে রয়েছে রঙ-বেরঙের আলো সৃষ্টি করার হরেক রকম আতশবাজি। এসব আতশবাজিতে, বিভিন্ন রঙের আলো সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রকম ধাতব লবণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যেমন-অ্যান্টিমনি বা আর্সেনিকের যৌগ থাকলে উৎপন্ন হয় উজ্জ্বল সাদা রঙ। তেমনি বেরিয়াম লবণ থাকলে পাওয়া যায় সবুজ আলো। স্ট্রনসিয়াম লবণ থেকে উজ্জ্বল লাল আলো। তামার লবণ থেকে নীল। সোডিয়াম লবন থেকে সোনালী হলুদ। আর পটাসিয়াম লবণ থেকে উজ্জ্বল বেগুনী আলো। তাই রঙ-বেরঙের আতশবাজি পোড়ালে, উৎসব খুব জমে ওঠে। সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যায়।

আতশবাজি কেন ক্ষতিকর
আঁটবি-পটকাতে জ্বালানি হিসেবে কার্বন ও সালফার ব্যবহৃত হয়। এগুলো পুড়ে গেলে, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড প্রভৃতি গ্যাস উৎপন্ন হয়। এগুলো স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস ফুসফুসের মাধ্যমে রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। তার ফলে সুস্থিত কার্বক্সিহিমোগ্লোবিন উৎপন্ন হয়। এর ফলে রক্তের অক্সিজেন পরিবহন করার ক্ষমতা বিনষ্ট হয়। তাছাড়া এজন্য মাথাধরা, ক্লান্তিভাব এবং আরও নানারকম উপসর্গ দেখা দেয়। সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস, শ্বাসনালী এবং ফুসফুসে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া এই গ্যাস বাতাসে থাকলে, তা বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে তৈরি করে সালফিউরাস ও সালফিউরিক অ্যাসিড। এসব অ্যাসিড ত্বকের ক্ষতি সাধন করে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে, বাজি-পটকা থেকে উৎপন্ন লেড বা সীসার অক্সাইডের বিষক্রিয়ায় রক্ত শূন্যতা, দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অসাড়তা প্রভৃতি রোগ হতে পারে। অ্যান্টিমনি দূষণের ফলেও অনেকটা এরকম হয়ে থাকে। আর্সেনিক দূষণের ফল দুরারোগ্য চর্ম রোগ (যেমন-চুলকানি) এবং যকৃতের রোগ হতে পারে। শরীরবিদদের মতে, আর্সেনিকের বিষক্রিয়া শরীরের প্রভূত ক্ষতি সাধন করতে পারে। ম্যাগনেসিয়াম প্রভৃতি ধাতু আমাদের জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া চালানোর জন্য খুবই প্রয়োজন, একথা সত্যি, তবে এদের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে, শরীরে দেখা দেয় নানা রকম বিপত্তি। বলা বাহুল্য, আতশবাজি-পটকা থেকে নির্গত ধোঁয়ার সঙ্গে এইসব পদার্থ প্রথমে ফুসফুসে যায়। তারপর রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। তাই তখন নানা রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

বিজ্ঞাপন

আতশবাজি মানে আগুন নিয়ে খেলা
মনে রাখতে হবে, আতশবাজি পোড়ানো মানেই আগুন নিয়ে খেলা করা আর চরম ক্ষতিকর শব্দদূষণ ঘটানো। সব রকমের আতশবাজিই অনেক ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। আতশবাজি পোড়ানোর সময় অসাবধানতার দরুন হঠাৎ কোথাও আগুন লেগে যেতে পারে। বাড়ি ঘর পুড়ে যেতে পারে এবং তার ফলে প্রভূত ক্ষতি হতে পারে। সেজন্য ওই সময় প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। এবারের করোনাকালে বছরের প্রথম প্রহর বা থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি যেন খারাপ সময়টাকে আরও খারাপ করে না দেয় সে প্রত্যাশার পাশাপাশি সচেতন থাকা জরুরি। থার্টি ফার্স্ট নাইটে সরকারও যথেষ্ট সতর্ক ও সচেষ্ট থাকেন। কোনো ধরনের নিরাপত্তা হুমকি জঙ্গি হামলা বা নাশকতার পরিকল্পনা রুখতে র‌্যাব সদা সতর্ক কাজ করেন। এবারে ঘরে বসে নিজের পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে আনন্দ-উল্লাস উপভোগ করার জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। যা সত্যিই প্রশংসনীয়।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন