বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের বিশ্ব জয়ের বছর

December 30, 2020 | 6:03 pm

মহিবুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

দেখতে দেখতে কালের গর্ভে বিলীন হতে চলেছে আরও একটি বছর। পুরোনো বছরের জরা-জীর্ণতাকে ঝেড়ে ফেলে নতুনের জয়ধ্বনি শোনাতে দরজায় সজোরে কড়া নাড়ছে ২০২১ সাল। নতুন বছরের ঊষালগ্নে আমরা ফিরে যাব ২০২০ সালে দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে। অতিমারির বছরে লাল সবুজের ক্রিকেটাঙ্গন কেমন গেল সেটাই অতশী কাঁচের নিচে দেখার চেষ্টা করব।

বিজ্ঞাপন

জানুয়ারি মাস, তখনো অদৃশ্য শত্রু করোনা বিশ্বব্যাপী সংক্রমন ছড়াতে শুরু করেনি। তবে খবরের পাতা খুললে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘাতক করোনার খবর মিলছিল। ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে স্বাগতিক পাকিস্তানের বিপক্ষে টি টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে গেল সফরকারী বাংলাদেশ। যদিও সফরের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর ছিল না। সফরে টি টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার ছিল তিনটি অথচ গড়াল দুটি। বৃষ্টির দাপটে অপরটি গড়ালই না। দুখঃজনকভাবে ওই দুই ম্যাচের দুটিতেই ভীষণ দৃষ্টিকটুভাবে হেরে বসে টিম বাংলাদেশ।

একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচটি খেলতে পরের মাসেই রাওয়ালপিন্ডির চাটার্ড বিমান ধরল ডোমিঙ্গ শিষ্যরা। কিন্তু সেখানেও সেই যাচ্ছেতাই ফলাফল, ইনিংস ও ৪৪ রানের হারের বেদনায় নীল হয়ে ফিরে এল মুমিনুল হক অ্যান্ড কোং। সিরিজের শেষ ম্যাচটি গড়ানোর কথা ছিল এপ্রিলে। সেটা গেছে করোনার পেটে। তার আগে আকবর আলী, শরিফুল ইসলাম, তৌহিদ হৃদয়রা বিশ্বজয় করে পুরো বাংলাদেশকে আনন্দে ভাসিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বকাপকে সামনে রেখে অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে নিয়ে অনেকদিনের পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি)। বিশ্বমঞ্চে যুবারা যে উপন্যাসের সুন্দর কাহিনীর মতো সেটা বাস্তবায়ন করে দেখাবেন সেটা কী আর সবাই ভেবেছিল! নিউজিল্যান্ড, স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তানের মতো দলকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে আকবর আলির দল। ফাইনালে বাংলাদেশি যুবাদের প্রতিপক্ষ ছিল টুর্নামেন্টটিতে একক আধিপত্য দেখানো ভারত, যারা সর্বোচ্চ চারবার শিরোপা জিতেছে। ভারতের দলটাও ছিল দুর্দান্ত শক্তিশালী।

শরিফুল ইসলামদের তাক লাগানো বোলিং, আকবর আলির মুগ্ধতা ছড়ানো ‘ক্যাপ্টেন্স নকে’ সেই অপ্রতিরোধ্য ভারতকে বৃষ্টি আইনে ৩ উইকেটে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে নেয় বাংলাদেশ। আকবর, হৃদয়, শরিফুলরা বিশ্বকে বার্তা পৌঁছে দেন, আমরাও উঠে আসছি। যেকোনো পর্যায়ের ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেটা প্রথম বিশ্বকাপ জয়। সেদিন উত্তেজনা, উল্লাস যেন থামছিল না আকবরদের। দেশের ক্রিকেট, ক্রীড়াঙ্গন, ক্রীড়াপ্রেমীসহ আনন্দের সেই ঢেউ বয়ে গেছে দেশের সকলের ওপর দিয়ে। করোনার বিষন্নতার বছরে যুবাদের এই বিশ্বজয়ই দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় আনন্দ। বড় ঘটনাও বটে!

জাতীয় দল পাকিস্তানের কাছে শোচনীয় হারের বিস্মৃতি ভুলতে ফেব্রুয়ারিতেই পূর্ণাঙ্গ সিরিজের জন্য জিম্বাবুয়েকে আমন্ত্রণ জানায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-বিসিবি। সিরিজের সূচি চূড়ান্ত হতেই দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে চাউর হয়, রোডেশিয়ানদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজেই অধিনায়কত্বের এপিটাফ লিখে দিবেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। যা হোক, বাংলাদেশ সফরে একমাত্র টেস্টে স্রেফ উড়ে যায় সফরকারীরা।

বিজ্ঞাপন

টেস্টে ইনিংস ও ১০৬ রানের হারের যন্ত্রণা ভুলতে জিম্বাবুয়ানরা পাখির চোখ করে ওয়ানডে সিরিজের দিকে। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। বরং মাশরাফির নিপুন অধিনায়কত্বে তিন ম্যাচ সিরিজের ওয়ানডের তিনটিতেই যাচ্ছেতাই রকমের হার বরন করে নেয়। সেই খবর সন্দেহাতীতভাবেই দেশের ক্রিকেট অনুরাগীদের হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ তুলেছিল। কিন্তু সেই আনন্দ বিষাদে রুপ নেয়, মাশরাফির বিদায় বার্তায়।

৫ মার্চ সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সিরিজের শেষ ওয়ানডে ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে এসে নড়াইল এক্সপ্রেস জানিয়ে দেন, অধিনায়ক হিসেবে এটিই তার শেষ আন্তর্জাতিক ওয়ানডে। তার এই ঘোষণা বিষাদের বিউগল বেজে উঠে চা-এর নগরীতে। শেষ হল বাংলাদেশ ক্রিকেটের সফলতম অধিনায়কের নেতৃত্বের অধ্যায়। ওয়ানডে সিরিজ শেষে দুই ম্যাচ সিরিজের টি টোয়েন্টিতেও ক্ষুরধার টাইগারদের দেখা যায়। পূর্ণাঙ্গ সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়ে ১২ মার্চ দেশে ফিরে যায় জিম্বাবুয়ে।

দেশে তখন করোনা সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে। সংক্রমণ রোধের সতর্কতায় দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি ঘোষণা হচ্ছে এমন ঘোষণা আসি আসি করছে। ঠিক এমন পরিস্থিতে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ২০১৯-২০ মৌসুমের দামামা বেজে উঠল। লম্বা বিরতির পর উন্মুক্ত দল বদলের মধ্য দিয়ে ১৫ মার্চ মাঠে গড়াল ১২ দলের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। কিন্তু এক রাউন্ড শেষ হতেই ক্রীড়া মন্ত্রনালয় দেশের সকল খেলাধুলা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। মন্ত্রনালয়ের ঘোষণার পর ১৯ মার্চ এক অনানুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে বিসিবি (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) নাজমুল হাসান পাপনও অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশের ক্রিকেট বন্ধ ঘোষণা করেন।

বিজ্ঞাপন

বিসিবি সভাপতির ঘোষণার মধ্য দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় দেশের সব ধরণের ক্রিকেট। শুধু কী তাই? মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলাদেশের একেকটি আন্তর্জাতিক সিরিজ ও ক্রিকেটের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সব টুর্নামেন্ট। প্রথম ঘোষণাটি আসে পাকিস্তানের বিপক্ষে এপ্রিলে অনুষ্ঠেয় সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট ম্যাচটি অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিতের। এরপর একে একে স্থগিত হয়ে যায় টাইগারদের আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা সফর। সেপ্টেম্বরে মাঠে গড়ানোর অপেক্ষায় থাকা এশিয়া কাপ ও অক্টোবর-নভেম্বরের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপও একই ভাগ্য বরণ করে নেয়।

এপ্রিল থেকে জুলাই অবধি টানা চার মাস ঘরে বসে কাটে জাতীয় ছেলে দল, মেয়ে দল, প্রথম শ্রেণি, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ ও তৃতীয় বিভাগের ক্রিকেটারদের। অতিমারির দাপটে এই চার মাসে মাঠের ক্রিকেট বন্ধ থাকায় ঘরে বসে শুধুই ফিটনেস নিয়ে কাজ করতে থাকেন দেশের তাবৎ ক্রিকেটাররা। জাতীয় দল ও এর র‌্যাডারে থাকা অনেকে আবার নিজ বাসার গ্যারেজ ও লনে বোলিং, ব্যাটি অনুশীলন চালিয়ে যান।

অবশ্য শুধুই ফিটনেস ও অনুশীলন নিয়ে ব্যস্ত থাকেননি, করোনার ছোবলে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিতে অসহায়দের পাশে দাঁড়ান টাইগার পঞ্চপান্ডসহ আরো অনেকে। নন্দিত ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা নিজ জেলা নড়াইলের দুস্থ অসহায়দের মাঝে আর্থিক সহাযোগিতাসহ খাদ্য সহযোগিতা পৌঁছে দেন। তামিম ইকবাল ঢাকাস্থ ও নিজ জেলা চট্টগ্রামে সহায় সম্বলহীনদের আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি খাদ্য সহযোগিতাও অব্যাহত রাখেন।

আর্তের পাশে দাঁড়াতে সাকিব আল হাসান নিলামে তোলেন বিশ্বকাপের ব্যাট। যে ব্যাটে ভর করে ২০১৯ আইসিসি বিশ্বকাপে সুপারম্যানের তকমা জিতেছিলেন অনলাইন অকশনে তা ২০ লাখ টাকায় কিনে নেন, যুক্তরাষ্ট্র

প্রবাসী এক বাংলাদেশী। সেই ব্যাট বিক্রির টাকা পুরোটাই স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেন। বসে থাকেননি মিস্টার ডিপেন্ডেবল মুশফিকুর রহিমও। যে ব্যাটে টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল শতকের দেখা পেয়েছিলেন তা বিক্রির লক্ষ্যে নিলামে তোলেন। ১৮ লাখ টাকায় তা কিনে নন বিশ্ব নন্দিত অলরাউন্ডার শহিদ আফ্রিদি। এর পুরোটাই সম্বলহীনদের জন্য ব্যয় করেন।

বসে থাকেননি মাশরাফি বিন মুর্তজাও। দুস্থের পাশে দাঁড়াতে নিজের ১৬ বছরের সঙ্গী ব্রেসলেট নিলামে তোলেন। যা ৪২ লাখ টাকা দামে কিনে নেন স্বদেশী এক সুহৃদ। এছাড়াও মহামারিকালে স্বপ্ল আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়াতে উদ্যোগী হয়েছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মোস্তাফিজুর রহমান, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ও নাজমুল ইসলাম অপুসহ আরো অনেকেই।

টাইগার প্রশাসন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও স্বপ্রনদিত হয়ে জাতীয় দলের ছেলে ও মেয়ে ক্রিকেটার, প্রথম শ্রেণি, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ, তৃতীয় বিভাগের ক্রিকেটারসহ দেশের প্রায় প্রতিটি বিভাগের দুস্থদের মাঝে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি খাদ্য সহযোগিতাও পৌঁছে দেন। এভাবে দিন, মাস পেরিয়ে যেতে থাকে। এরপর হুট করেই একদিন জানা যায়, ১৯ জুলাই থেকে মিরপুর শের ই বাংলাসহ দেশের অপর দুই ভেন্যু; চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধূরী স্টেডিয়াম ও সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে একক অনুশীলন শুরু করেন ৯ ক্রিকেটার। তারা হলেন; মুশফিকুর রহিম, ইমরুল কায়েস, শফিউল ইসলাম, মোহাম্মদ মিঠুন, মেহেদি হাসান, নুরল হাসান, সৈয়দ খালেদ আহমেদ, নাঈম হাসান ও নাসুম আহমেদ।

এরপর দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটার ও ভেন্যুর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। দেশের প্রতিটি বিভাগীয় ভেন্যুতে ছেলে ক্রিকেটারদের পাশাপাশি মেয়েরাও একক অনুশীলন চালিয়ে যেতে থাকেন। এভাবে দুই মাস কেটে যাওয়ার পর অক্টোবরে বিসিবি প্রেসিডেন্ট’স কাপ দিয়ে অতিমারিকালে প্রথম কোন টুর্নামেন্ট আয়োজন করে টাইগার ক্রিকেট প্রশাসন। তিন দলের ওয়ানডে টুর্নামেন্টে নাজমুল একাদশকে হারিয়ে শিরোপা জেতে মাহমুদউল্লাহ একাদশ।

প্রেসিডেন্ট’স কাপ শেষ হতেই স্থানীয় ক্রিকেটারদের নিয়ে বিসিবি আয়োজন করে মহামারিকালের প্রথম কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতামুলক ক্রিকেট-বঙ্গবন্ধু টি টোয়েন্টি কাপ। চার ছক্কার ফুল ঝুঁড়ি ছোটানো ৫ দলের এই টুর্নামেন্টেও অধিনায়ক হিসেবে সাফল্যের দেখা পান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। শ্বাসরুদ্ধকর শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামকে ৫ রানে হারিয়ে উঁচিয়ে ধরেন করোনাকালের দ্বিতীয় শিরোপা।

বলে রাখা ভাল প্রেসিডেন্ট’স কাপ ও বঙ্গবন্ধু টি টোয়েন্টি কাপ দিয়ে কেবল জাতীয় দল ও এর র‌্যাডারের থাকারাই ক্রিকেটে ফেরার সুযোগ পেয়েছেন। প্রথম শ্রেণি, মেয়ে ক্রিকেট দল, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ ও তৃতীয় বিভাগের ক্রিকেটাররা এখনো ক্রিকেটে ফিরতে পারেননি। বিসিবি সভপতি নাজমুল হাসান পাপন জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিরি উন্নতি হলে কিংবা ভ্যাকসিন এলে পুরোদমে ফিরবে প্রাণের ক্রিকেট।

সারাবাংলা/এমআরএফ/এসএইচএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন