বিজ্ঞাপন

চসিক নির্বাচন: ‘বিদ্রোহী’দের নিয়ে ‘বিদ্রোহ’ নগর আ.লীগে

January 14, 2021 | 7:07 pm

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হওয়া ‘বিদ্রোহী’দের নিয়ে মতবিরোধ আরও জোরালো হয়েছে নগর আওয়ামী লীগে। মাঠ পর্যায়ে ‘প্রভাবশালী’ কিছু নেতা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যে ‘বিদ্রোহী’দের পক্ষে থাকা-না থাকা নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে আছেন। ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ ও তাদের ‘ইন্ধনদাতা’দের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত আট দিন আগে নেওয়া হলেও সেটি কার্যকর হয়নি।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (১৩ জানুয়ারি) রাতে নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় আবার একই সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে বিদ্রোহী প্রার্থীসহ চসিকের সার্বিক নির্বাচনি কার্যক্রম নিয়ে সভায় উত্তেজনা দেখা দেয়। এ অবস্থায় চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের দুই নিয়ন্ত্রক নেতা মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও আ জ ম নাছির উদ্দীন বৃহস্পতিবার দুপুরে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন।

নগরীর দারুল ফজল মার্কেটের দলীয় কার্যালয়ে বুধবার রাতের সভায় সভাপতিত্ব করেন নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী। এতে সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী, সদস্য শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ কয়েকজন নেতা বক্তব্য রাখেন।

মঙ্গলবার রাতে নগরীর পাঠানটুলি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর ও বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল কাদেরের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত হন। নিহত আজগর আলী বাবুল (৫০) প্রার্থী বাহাদুরের সমর্থক ছিলেন। ঘটনার পর কাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। বাহাদুর উপমন্ত্রী নওফেল ও কাদের নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

বিজ্ঞাপন

এ ঘটনার একদিন পর অনুষ্ঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির জরুরি সভায় উপস্থিত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সভায় আ জ ম নাছির উদ্দীন দাবি করেছেন, বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল কাদের তার অনুসারী নন। বক্তব্যে তিনি বলেন— পাঠানটুলির হত্যাকাণ্ড কোনো ধরনের নির্বাচনি সহিংসতা নয়। এটা নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থে হয়েছে। সেজন্য মহানগর আওয়ামী লীগ কোনো বিবৃতি দিতে পারে না।

এ বক্তব্য নিয়ে সভায় নাছির ও নওফেলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বাক্যবিনিময় হয়। এছাড়া নাছির অভিযোগ করেন, নওফেলের অনুসারীদের কেউ কেউ ফেসবুকে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী ও অসৌজন্যমূলক কথাবার্তা লিখছেন। জবাবে নওফেল তাদের সতর্ক করার কথা বলেন।

সভায় নাছির বলেন, ‘কাদের জন্য কাজ করব? বিপদে পড়লে দেখা যাবে কে মাঠে থাকে। আমি উড়ে এসে জুড়ে বসিনি। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে এ পর্যায়ে এসেছি।’

বিজ্ঞাপন

সভায় উপস্থিত সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘নাছির ভাই গতকালের (বুধবার) সভায় খুবই উত্তেজিত ছিলেন। নেতাদের কয়েকজনও আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখেন। যার ফলে সভায় কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়। তবে রেজাউল ভাই একদম চুপ ছিলেন।’

দল সমর্থিত এবং বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়ে একেক ধরনের বক্তব্য দেন মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী। মাহতাব বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা অন্য কিছু বুঝি না। আমারা আমাদের প্রার্থী, নৌকার মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীর জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব।’ পরে তিনি আবার বলেন, ‘দলীয় প্রার্থীদের বাইরে কোনো নেতা যদি কারও পক্ষে কাজ করে, তারা মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতে পারবেন না। আমরা সবাই দলীয় প্রার্থীর পক্ষে আছি।’

ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও কয়েকজন বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন বলে বক্তব্য দেন একজন জ্যেষ্ঠ্য নেতা। নওফেল প্রতিবাদ করে বলেন, ‘ঢাকায় দুই-তিন জন বিজয়ী হয়েছেন। এটা উদাহরণ হতে পারে না। আমরা কোনো অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারি না।’

সভায় সহসভাপতি ইব্রাহীম হোসেন চৌধুরী বাবুল, আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শফিক আদনান, চন্দন ধর, হাসান মাহমুদ শমসেরসহ আরও কয়েকজন নেতা বক্তব্য রাখেন।

বিজ্ঞাপন

উপস্থিত নেতারা জানান, সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য অভিযোগ করেন— কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই শফিক আদনান, নোমান আল মাহমুদ ও শফিকুল ইসলাম ফারুক মিলে কেন্দ্র কমিটি করছেন। সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের নির্দেশে এই কমিটি গঠনের কথা বলে এতে জ্যেষ্ঠ্যতা মানা হচ্ছে না বলে তার অভিযোগ। এ নিয়েও পাল্টাপাল্টি কথাবার্তায় উত্তপ্ত হয় সভাস্থল।

এছাড়া সভার শেষ পর্যায়ে সম্প্রতি মেয়র প্রার্থী রেজাউলের সমর্থনে আয়োজিত একটি শ্রমিক সমাবেশের মঞ্চ থেকে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী আনজুমান আরা বেগমকে নামিয়ে দেওয়া নিয়ে নাছিরের তোপের মুখে পড়েন চন্দন ধর।

তবে শেষ পর্যন্ত সভায় সিদ্ধান্ত হয়— বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের বহিষ্কার করার সুপারিশ করে কেন্দ্রের কাছে চিঠি দেওয়া হবে। আর বিদ্রোহীদের যারা সহযোগিতা করছে, তাদেরও বহিষ্কারের সুপারিশ থাকবে একই চিঠিতে। এর আগে গত ৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির সভায়ও একই ধরনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু সেটি কার্যকর হয়নি বলে বুধবার সভায় জানিয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের নেতারাই।

জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইব্রাহীম হেসেন চৌধুরী বাবুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটি বড় সংগঠনের নানা মত, নানা আলোচনা থাকবে। তবে একটা বড় বিষয় হচ্ছে— আমরা বিদ্রোহীদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন্দ্রের কাছে চিঠি পাঠানোর বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।’ সভায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়া নিয়ে জানতে চাইলে বাবুল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জানতে চাইলে সাংগঠনিক সম্পাদক শফিক আদনান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের অনেক নেতাই বিদ্রোহীদের পক্ষে আছেন। কেউ দৃশ্যমান আছেন। কেউ ভেতরে আছেন। আমরা সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যারা বিদ্রোহীদের পক্ষে থাকবেন তারা মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে কোনো নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন না। তাদের ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কারের সুপারিশ করে কেন্দ্রের কাছে চিঠি দেওয়া হবে।’

আট দিন আগেও নেওয়া একই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি কেন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা কেন হয়নি, আপনি বুঝে নেন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর আওয়ামী লীগের এক সহসভাপতি সারাবাংলাকে বলেন, ‘চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত আইওয়াশ ছাড়া কিছু নয়। প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতিতে নেতারা যা-ই বলুক, অনেকেই শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীদের সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যাবেন।’

এদিকে, নগরীর জিইসি মোড়ে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি কক্ষে বৃহস্পতিবার দুপুরে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছিলেন উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও আ জ ম নাছির উদ্দীন। দুপুর দেড়টায় নাছির সেখানে যান। ২টা ৫০ মিনিটে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন।

বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘গতকালের (বুধবার) সভার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। দল যাদের মনোনয়ন দিয়েছে তাদের পক্ষে আমরা সবই ঐক্যবদ্ধ থাকব। বিদ্রোহীদের কেউ ওউন না করার বিষয়ে একমত হয়েছি। তিনিও (আ জ ম নাছির) এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন। বিদ্রোহীদের বহিষ্কারের জন্য নগর আওয়ামী লীগ তালিকা করে দ্রুততম সময়ে কেন্দ্রে পাঠাবে।’

এ বিষয়ে আ জ ম নাছির উদ্দীনের বক্তব্য জানতে পারেনি সারাবাংলা।

উল্লেখ্য, চসিক নির্বাচনে অংশ নেওয়া কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে দলীয় সমর্থনের বাইরে প্রায় অর্ধশত প্রার্থী আছেন, যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেলেও ২০১৫ সালে নির্বাচিত হওয়া ১২ জন কাউন্সিলরও নির্বাচন করছেন। বিদ্রোহীদের অধিকাংশই আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

পুনঃতফসিল অনুযায়ী আগামী ২৭ জানুয়ারি চসিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন