বিজ্ঞাপন

মেঘবতী নিশিঘোর কন্যা

January 20, 2021 | 10:30 am

নাজনীন হাসান চুমকী

[ইশরাত নিশাত। ঢাকার মঞ্চের জনপ্রিয় মুখ অভিনেত্রী, নির্দেশক ও আবৃত্তিশিল্পী। অসংখ্য নাটক ও আবৃত্তি প্রযোজনায় মঞ্চ এবং আলোক নির্দেশক হিসেবে কাজ করে সংস্কৃতি অঙ্গনে নিজেকে করে তুলেছিলেন অনন্য। দেশের যেকোনো প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও ছিলেন সবসময় সোচ্চার। তবে আর কখনো মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যাবে না ইশরাত নিশাতকে। শিল্পকলা একাডেমির চত্বরে আর দেখা মিলবে না সদাহাস্য নিশাতের। গত বছরের এইদিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন নাট্যাঙ্গনের এই ‘দ্রোহকন্যা’। ২০২০-এর ২০ জানুয়ারি রাত ১টা নাগাদ গুলশানে বোনের বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া কাটান ইশরাত নিশাত। ইশরাত নিশাতের প্রয়াণের পর তাকে নিয়ে সারাবাংলা’য় স্মৃতিচারণ করেছিলেন তারই দীর্ঘদিনের সহকর্মী অভিনেত্রী, নির্দেশক ও নাট্যকার নাজনীন হাসান চুমকী। আজ (২০ জানুয়ারি) তার প্রথম প্রয়াণ দিবসে, তারই স্মরণে লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।]

বিজ্ঞাপন

ইশরাত নিশাত, এক বিশাল সাদা নরম তুলোর মতো মেঘ। যে মেঘ ছোট ছোট মেঘগুলোকে স্নেহময় পরশ দিয়ে যায়। আবার প্রয়োজনে হরেক রঙ ধারণ করে। দেশ নাটকের প্রচণ্ড খরার সময় ‘বৃষ্টি’ হয়ে ঝরে ফলনশীল করে তুলেছিলেন নিশাত নামের ‘মেঘ’। কোনো অনাচার দেখলেই ‘ঝড়’ হয়ে উড়িয়ে নেবার ক্ষমতাধর এক মেঘ ইশরাত নিশাত, আমাদের প্রিয় আপা।

আপনাকে নিয়ে লিখতে হচ্ছে, কী দুঃসাহস আমার! এত যোগ্য কবে হলাম? সেদিন, যেদিন আপনি মফস্বলের এই চুমকীকে হাত ধরে পথ চলতে সাহায্য করলেন তারপরই তো একটু একটু করে যোগ্য করে গড়ে তুললেন।

বিজ্ঞাপন

‘লোহা’ নাটকটি করার সময় দেখেছি, নাজমা আনোয়ার খালা কিভাবে মেয়ের নির্দেশনা মেনে কাজ করছেন। কোনদিন তর্ক বিতর্ক বা দ্বিমত পোষণ করেননি তিনি নির্দেশক কন্যার সাথে। সেই থেকে শুরু আমাদের শিক্ষা নেবার। নিশাত আপা ছিলেন আমার, আমাদের প্রতিষ্ঠান। ঘটা করে কখনোই আমাদের নিয়ে বসেননি তিনি, কিন্তু ছোট ছোট করে অনেক কিছুই শিখিয়েছেন।

শ্বাশত বাঙালি নারী ছিলেন প্রিয় নিশাত আপা। কি অসাধারণ রান্নার হাত! আমরা কে কোনটা খেতে ভালবাসি, মুখস্থ। রান্না করে, ডেকে, সামনে বসে খাওয়াতে কি যে সুখ পেতেন উনি। কি টিপটপ বাসা। ঈদের পর আপার বাসায় পরিবার নিয়ে দলের প্রতিটা সদস্যের নিমন্ত্রণ, ঐদিনটাও আমাদের ঈদের দিন হতো। একটা জিনিসও এদিক সেদিক করার উপায় ছিল না।

বিজ্ঞাপন

আপার সাহচর্যে আসার পর আদরে আমি হয়ে উঠেছিলাম দুরন্ত। ‘৯৭ সালের দিকে সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রায়দিনই আপার সাথেই সময় কাটতো আমার। এটা ওটা ওলটপালট করলেই ধমক দিতো, কপট ধমক। কি যে মধুর সে ধমক। এভাবেই তো মানুষ করে তুললেন আমাকে।

বাংলা টিভি’র জন্য আমার লেখা এবং নির্দেশিত একটি নাটক ‘তিলোত্তমা’র স্ক্রিপ্ট ও একটা চরিত্রে আপা কাজ করেছিলেন। এটা আমার সৌভাগ্য যে, এই নাটকে প্রথম টিভি স্ক্রিনের সামনে এসেছিলাম আপার সাথে আমি।

আমার একটা শাড়িতে নিজ হাতে কাজ করে দিয়েছেন। সেই শাড়ি দেখে হতবাক আমি। ঈষৎ ভাব নিয়ে বললেন ‘আমি কি তোর মতোই বেগুন’।

বিজ্ঞাপন

‘লোহা’ নাটকের রিহার্সালের মধ্যে একদিন দাওয়াত ছিল। হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি, দু হাতে কয়েকটি কাঁচের চুড়ি, কপালে কালো ছোট্ট একটা টিপ পরা আপাকে দেখে আমার মাথা ঘুরে পড়ে যাবার উপক্রম। তাই দেখে কী মিষ্টি হাসি। ঐ হাসিমুখ আমি দ্বিতীয়বার দেখেছি, এই তো এক মাস আগে তাঁর বাসায় পুরনো অ্যালবাম নিয়ে বসেছিলাম। একের পর এক পাতা উল্টাচ্ছি, টিনএজার নিশাত আপার ছবি দেখছি আর তিনি প্রতিটি মুহূর্তের গল্প শোনাচ্ছিলেন। সেই লাজুক হাসি ছিল ঠোঁটে।

মানুষ তৈরির কারিগর ছিলেন তিনি। এই যে আজ বাংলাদেশের মানুষ আমাকে চিনেন, টিভি পর্দায় আমাকে দেখেন, আমার যা কিছু অর্জন- সব, সবই তাঁর কৃতিত্ব। আমাকে নতুন পরিচয় দিয়েছেন নিশাত আপা, একটু একটু করে। আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলেছেন আমাকে, আমাদেরকে।

তিনি ছিলেন আমাদের মনোবিশারদ। কেউ আপার চোখ এড়াতে পারেননি। সবার যে কোনো সমস্যায় ডুব না দিলে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। সমাধান করেই যেন স্বস্তি পেতেন। তিনি আমাদের আত্মার আত্নীয়। দলের সদস্যদের স্ত্রী-স্বামী-সন্তান নিশাত আপার কলিজা। মৌসুমি নাগ আপার কাছ থেকে আচারের বয়াম পাবেই। টিটু ভাইয়ের বাসার একটা রুম তো দেশ নাটকের জিনিসে আটকে গেছে। বেবী আপা টিটু ভাইয়ের স্ত্রী পৃথিবীর যেখানেই যাক নিশাত আপার জন্যে সুতো হলেও কিনবেন। সুস্মিতা রান্না করে বক্সে তুলে নিয়ে আসতো আপার জন্যে। আপাও সুস্মিতা অয়ন দার জন্যে খাবার তুলে রাখতো ফ্রিজে। বিলকিস আপার মতো লক্ষ্মী মেয়েকে নিয়ে প্রায়ই কথা শুনতে হতো আমাকে। যে কোন বিষয়ে সবাইকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলেই বনির উপর ভরসা করতেন ভীষণ।

লিসা গাজী আপাকে নিয়ে নিশাত আপা যখন গল্প করতেন, ভালবাসায় চকচক করতো চোখ। ঈর্ষাবোধ করতাম। তখন আমার হাতে হাত রেখে বলতেন ‘বেটা তোকেও আমি ভালবাসি’। মিমি আপা (আফসানা মিমি) থিয়েটার কেন করলেন না, এই আফসোস উনি সবসময়ই করতেন।

দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য বিথু (ব্রততী বিথু) সেই শনিরআখড়া যায় রাতে। সে নিয়ে আমি উদগ্রীব হয়ে ঐ দিকে দলের কে কে আছে খোঁজ করতেই বিকট ধমক দিলেন ‘সবাইকে তোর মতো পঙ্গু বানাতে চাস? ও সাহসী মেয়ে, আহ্লাদ দিয়ে ভীতু বানাস না’। বললেন ঠিকই তারপরই বিথুকে শেখালেন রাস্তায় নামার আগে ৯৯৯ এ ডায়াল করতে হবে, কোন জায়গায় বসবে, কোন ধরনের মানুষ থেকে দূরে বসবে, এমনই কত কত কথা।

বন্যা আপার (বন্যা মির্জা) সাথে কখনো কখনো তর্ক বেঁধে যেত। ভয় পেতাম আমি। ওমা একটু পরেই দেখতাম বন্যা আপা আর নিশাত আপা জড়াজড়ি করে বসে আছেন। এ ভালবাসার নাম জানিনা আমি! তিথির (তামিমা তিথি) সব কথায় ভেংচি দিতেন। আমরা হেসে ফেললে চোখ রাঙিয়ে দিতেন। সুষমাকে (সুষমা সরকার) তো নায়িকা ছাড়া ডাকতেনই না। মিষ্টি হাসির সুষমা লজ্জা পেলেও আপার ডাক থামতো না। শোয়েব ভাই, মিলন ভাই দলে আসতে পারেন না। তো কি হয়েছে?… ভালাবাসা এক রত্তিও কমেনি তাদের প্রতি। উজাড় করে ভালোবাসা কাকে বলে, নিশাত আপার কারণেই বুঝেছি। কিন্তু আমরা কি সেই ভালবাসা আাপাকে দিতে পেরেছি। বুকটা ফেটে যায় সেই দুঃখে।

শুধু দলের না, দলের বাইরেও সবার প্রতি মনোযোগের এতটুকু কমতি দেখি নাই। দীক্ষাগুরু জ্ঞানদান করতে এতটুকু কার্পণ্য করেননি। যা জানতেন তা যেন উজাড় করে দেবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে সবসময়। নারী-পুরুষ-শিশু যে বয়সের চরিত্রই হোক, আপা যখনই দেখিয়ে দিতেন মনে হতো ‘উনিই সেরা’ আমরা কেউ আপার মতো অভিনয় করতে পারবো না। অভিনয়, বললে ভুল হবে, আপা চরিত্রায়ন করতেন। চরিত্রের কথা বলতেন।

নিশাত আপার কণ্ঠ, যাদু কণ্ঠ। অভিনয়, আবৃত্তি ছাড়াও বেইলী রোডের পুরোনো ধ্বনিচিত্রের ছাদে বসে যে গানের কণ্ঠ শুনেছি, অসাধারণ, অতুলনীয়। ভীষণ গান ভালোবাসতেন, মিউজিক সেন্স ছিল অকল্পনীয়। উদাত্ত কণ্ঠে যখন গাইতেন ‘মানুষ আমি আমার কেন পাখির মতো মন’ … আমরা বুদ হয়ে শুনতাম। সেই পাখিই আজ আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন।

কি যে ভাল লিখতেন। সব জমা করে রেখে গেছেন। জানি না আদৌও আর সেসব লেখা পড়তে পারবো কিনা। যখন আপা নিজের লেখাগুলো পাঠ করতেন, ছবির মতো সব যেন স্পষ্ট দেখতে পেতাম।

ভ্রাতৃত্বের সাঁকো তৈরির কারিগর। অন্যান্য দলের সদস্যদের সাথে মতবিনিময়, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের মধ্যে দিয়ে কত সুন্দর মনের সহযোদ্ধাদের সাথে পরিচিত হতে পেরেছি নিশাত আপার মাধ্যমে, তার সংখ্যা অগণন। আপাকে ভালও বেসেছে থিয়েটার কর্মী থেকে শুরু করে, ঝালমুড়িওয়ালা, চটপটিওয়ালা, বাদামওয়ালাও।

পারিবারিক হৃদ্যতার এক অপার বিস্ময় ছিলেন নিশাত আপা। চার বোন, ভাইসহ ভাগ্নে-ভাগ্নি-ভাতিজা ছিলেন আপার কাছে কলিজার টুকরো। তাদের সাথে কথা বললে, তাদের কথা তুললে আপার কণ্ঠস্বর অদ্ভুত মজার আর আহ্লাদী হয়ে যেত। তেমনি যে কোন শিশু ভক্ত হয়ে যেত নিশাত আপার।

আলোকিত মানুষ মঞ্চে আলো ফেলে মোমেন্ট তৈরির ওস্তাদ ছিলেন তিনি, অথচ এখন ঘুটঘুটে অন্ধকারে বাস নিয়েছেন। ভাবতেই শরীর কাঁপছে আমার। নিয়তির ডাকে কেঁড়ে নিয়ে গেল আমাদের কাছ থেকে আটকে রাখতে পারলাম না। যেদিন থেকে দলে যাওয়া আসা করছি মাসুম ভাই (মাসুম রেজা), বাবু ভাই (এহসানুল আজিজ বাবু), জাকির ভাই, কামাল ভাই, তপনদা সহ দলের আরো কিছু সিনিয়রকে সবসময়ই আপার পাশে থাকতে দেখেছি। তাঁরাও আটকাতে পারলো না আপাকে অন্ধকার ঘরে যাওয়া থেকে! শিমুল আপা (শিমুল ইউসুফ), বাচ্চু ভাই (নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু) কি যে আগলে রাখতেন আপাকে। তাঁদেরকে ফাঁকি দিয়ে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেন!

আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, বোধ বুদ্ধি হতে সাহায্য করেছেন। কিন্তু আমাকে আত্মবিশ্বাসী এবং মানবিক গুণের শিক্ষা দিয়ে মানুষ করে গড়ে তুলেছেন নিশাত আপা, তিনিও আমার মা। মা হারানোর যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছি আমি। অসহায়বোধ করছি। ভীষণ নিশ্বাস বন্ধ হওয়া যন্ত্রণায় ভুগছি।

এ লেখা আমার নিশাত আপাকে স্মৃতিচারণ করে নয়। তাঁকে ধারণ করে।

লেখক- অভিনেত্রী, নির্দেশক ও নাট্যকার

সারাবাংলা/এএসজি

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন