বিজ্ঞাপন

গর্ভের বাচ্চার ডিএনএ দিয়ে মায়ের হত্যাকারী চিহ্নিত

January 20, 2021 | 3:17 pm

সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার জয়পুর এলাকার নবম শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার (১৭)। সাত বছর আগে সে স্থানীয় পীরগঞ্জ কাবিলপুর টিএম ফাজিল মাদরাসায় পড়তো। ২০১৪ সালের ৭ মার্চ মধ্যরাতে ফাতেমাকে হত্যা করা হয়। যদিও গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ফাতেমার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় বলে প্রথমে এটিকে অপমৃত্যু মামলা হিসেবে নেয় পুলিশ। কিন্তু মৃতদেহ ময়নাতদন্তের পর বেরিয়ে আসে তাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে এবং সে ৪০ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু তার হত্যাকারীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে ফাতেমার গর্ভের সন্তানের পিতৃ-পরিচয় খুঁজতে গিয়েই ধরা পড়ে হত্যাকারী।

বিজ্ঞাপন

গত সাত বছরে হত্যার রহস্য উদঘাটনে ধাপে ধাপে সন্দেজনকভাবে মোট ১৩ জনের ডিএনএ টেস্ট করে সিআইডি। সম্প্রতি সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে নিহত ফাতেমার পেটের বাচ্চার ডিএনএ’র সঙ্গে ওই ১৩ জনের মধ্যে তার চাচাতো ভাই মো. হাসানুর জামান শিপন ওরফে টেক্কার (২৬) ডিএনএ মিলে যায়। আর একারণে সন্দেহভাজন আসামি টেক্কাকে সিআইডি আটক করে। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে যে, ফাতেমাকে ধর্ষণ এবং পরবর্তী সময়ে গর্ভবতী হওয়ায় তাকে হত্যা করে টেক্কা। এরপর পুলিশ তাকে গ্রেফতার দেখায়।

জানা যায়, আত্মীয়তার সুযোগে ফাতেমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয় আপন চাচাতো ভাই টেক্কার। ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে একদিন দুপুরে বাড়ি ফাঁকা পেয়ে তাকে ধর্ষণ করে টেক্কা। এতে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে ফাতেমা। কিন্তু লোক-লজ্জার ভয়ে বিষয়টি কাউকে জানাতে পারেনি। এদিকে তার পেটে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে অনাগত সন্তান। ফাতেমার গর্ভের সন্তানের বয়স যখন সাত মাস তখন টেক্কা অন্য জায়গায় বিয়ে করে। তারপরও ফাতেমা বিষয়টি টেক্কাকে জানাতে পারেনি। টেক্কাও বিয়ের পর ফাতেমার ডাকে আর সাড়া দেয় না। এভাবে সময় গড়াতে গড়াতে গর্ভের সন্তানের বয়স যখন প্রায় ১০ মাস তখন টেক্কাকে রাতের বেলা ডেকে নিয়ে গর্ভের সন্তানের কথা জানায়। টেক্কা অনাগত সন্তানের বিস্তারিত শোনার পর উপায়-অন্ত না দেখে তাৎক্ষণিক ফাতেমাকে গলা টিপে হত্যা করে। এরপর তার মৃতদেহ রুমে ওড়না দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়।

প্রায় সাত বছর আগে এই ঘটনা ঘটে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার জয়পুর এলাকায়। ২০১৪ সালের ৭ মার্চ মধ্যে রাতে ফাতেমাকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখে টেক্কা। এর কয়েক ঘণ্টা পর অর্থাৎ ভোরের দিকে ফাতেমার ছোটবোনের ঘুম ভাঙলে সে তার বড় বোনের ঝুলন্ত মৃতদেহ দেখে চিৎকার দেয়। পরে তার মা বাবা ও আশপাশের লোকজন দৌড়ে এসে দেখে ফাতেমা গলায় ফাঁস দিয়েছে। তারা ভেবেছিল ফাতেমা আত্মহত্যা করেছে।

বিজ্ঞাপন

এ ঘটনায় পীরগঞ্জ থানা পুলিশ এটিকে অপমৃত্যুর মামলা হিসেবে নেয়। কিন্তু যখন নিহতের ময়নাতদন্তে করা হয় তখন তদন্ত রিপোর্টে ফাতেমার গর্ভে ৪০ সপ্তাহের সন্তান থাকার বিষয়টি ধরা পড়ে। তখনই ঘটনার মোড় ঘুরে যায়। এছাড়া প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করে, ফাতেমা ফাঁস দেয়নি। তাকে কেউ মেরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছে। ময়নাতদন্তেও ফাতেমাকে গলা টিপে হত্যার আলামত ধরা পড়ে।

তবে যেহেতু ফাতেমার তখনও বিয়ে হয়নি, তাই তার পরিবার গর্ভবতী হওয়ার বিষয়টি টের পায়নি। গোয়েন্দা পুলিশ তাই তার গর্ভবতী হওয়া বা ফাতেমার ধর্ষণকারী প্রকৃতপক্ষে কে সেই তদন্তে নামে। কিন্তু রহস্য উদঘাটনে মামলাটির তদন্তে পর পর ছয় কর্মকর্তা ব্যর্থ হয়। পুলিশ প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে না পেয়ে তদন্তের সময় বাড়াতে থাকে। এক পর্যায়ে মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আদালত সিআইডিকে তদন্ত অব্যাহত রাখতে নির্দেশ দেয়। গত ৭ বছরে ধাপে ধাপে সন্দেজনকভাবে মোট ১৩ জনের ডিএনএ টেস্ট করে সিআইডি। সম্প্রতি সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে নিহত ফাতেমার গর্ভের বাচ্চার ডিএনএ’র সঙ্গে টেক্কার ডিএনএ মিলে যায়।

প্রকৃত হত্যাকারী খুঁজতে ব্যর্থ হচ্ছিল ৬ তদন্ত কর্মকর্তা

বিজ্ঞাপন

ফাতেমার মৃতদেহ উদ্ধারের পর এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার প্রথম তদন্তের দায়িত্ব পায় পীরগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. মিজানুর রহমান। তিনি ২০১৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখ পর্যন্ত মামলাটির তদন্ত করেন। কিন্তু তদন্ত করে নিহত ফাতেমার হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে না পারায় আদালত মামলাটি অধিক তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেয়। এরপর ২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডির উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আখের আলী। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর নিহত ফাতেমার বাবা মো. কালাম মিয়া (৪০), বড় ভাই মো. শাহাজাহান (২০), প্রাইভেট শিক্ষা মো. শাহজালাল মিয়া (৩৩), মামা (মার চাচাতো ভাই) মো. মাজহারুল ইসলামের (২১) ডিএনএ টেস্ট করে। কিন্তু তাতে রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। তাই ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি মামলাটি আরও অধিকতর তদন্তের জন্য দায়িত্ব পান সিআইডির অপর এসআই মো. ফরহাদ হোসেন মন্ডল। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর নিহত ফাতেমার অপর মামা (মা’র চাচাতো ভাই মাজাহারুল ইসলামের বন্ধু) মো. নাজমুল হক (২০) মাদরাসার শিক্ষক মো. আসাদুজ্জামান মন্ডল ওরফে সুরুজ (৫৮) এবং আপন চাচাতো ভাই মো. আহম্মেদ আলী ওরপে এরশাদ (২৩) এর ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করে। কিন্তু এবারও ভিকটিমের গর্ভের বাচ্চার সঙ্গে কোনো মিল পাওয়া যায়নি।

সন্দেহভাজন সাতজনের ডিএনএ পরীক্ষায় মিল না পাওয়ায় তিন বছর পরও মামলার রহস্য উদঘাটন হয়নি। তাই মামলাটি অধিক তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডির রংপুর ইউনিটের পরিদর্শক মো. আতাউর রহমান আকন্দ। তিনি ২০১৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ৯ মে পর্যন্ত মামলাটি তদন্ত করেন। কিন্তু তিনিও কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। তাই পঞ্চমবারে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় এসআই মো. ফরহাদ হোসেন মন্ডলকে। তিনিও প্রকৃত হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে পারেননি। এরপর মামলাটি ষষ্ঠবার সিআইডির অপর পুলিশ পরিদর্শক মো. ফেরদৌস ওয়াহিদকে তদন্তের জন্য দায়িত্বে আনা হয়। তিনিও ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের ১৩ মে পর্যন্ত তদন্ত করেন। কিন্তু এবারও উদঘাটন হয়নি প্রকৃত হত্যাকারী কে। ২০১৪ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ছয়জন কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করেও প্রকৃত আসামিকে খুঁজে বের করতে পারেননি। কিন্তু প্রকৃত আসামি তাদের সামনেই ছিল।

যেভাবে রহস্য উদঘাটন

যেহেতু ছয়জন কর্মকর্তা ধাপে ধাপে তদন্ত করেও রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি সেহেতু মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া হওয়া পর্যন্ত আদালত সিআইডিকে তদন্ত অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। তাই আবারও সপ্তমবার মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির অপর এসআই আহসান উল্লাহকে। তিনি ২০২০ সালের ১৩ মে থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত তদন্ত শেষে সন্দেহভাজন আরও ছয়জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেন। তারা হলেন- নিহত ফাতেমার আপন চাচাতো ভাই মো. হাসানুর জামান শিপন ওরফে টেক্কা (৩৩), চাচা (ফাতেমার বাবার চাচাতো ভাই) মো. নায়েব আলী (৪৯), আপন চাচা মো. হেলাল মিয়া (৬৪), আপন চাচা মো. জালাল আহম্মেদ (৬২), নানা (ফাতেমার মার চাচা) মো. ফজলার রহমান (৮৪), দাদা (প্রতিবেশী) মো. আব্দুল জলিল (৫৮) এবং নানা (মার খালু) মো. আইয়ুব আলী (৬৪)। এই ছয়জনের ডিএনএ’র নমুনা সংগ্রহের পর ফরেনসিক প্রোফাইল তৈরি করা হয়। প্রোফাইলে নিহত ফাতেমার গর্ভের সন্তানের সঙ্গে তার চাচাতো ভাই টেক্কার রিপোর্ট মিলে যায়। আর এভাবেই ফাতেমার মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হন এসআই আহসান উল্লাহ।

বিজ্ঞাপন

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এসআই আহসান উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মামলাটির তদন্ত করতে গিয়ে আমাদের ব্যাপক পরিশ্রম করতে হয়েছে। কারণ ময়নাতদন্তের রিপোর্টে নিহতের গর্ভে পরিপূর্ণ একটি সন্তান ছিল। যার বয়স প্রায় দশ মাস। কিন্তু তার পরিবারই জানে না তার গর্ভবতী হওয়ার বিষয়টি। তাই নিহতের গর্ভে কার সন্তান আমাদের টার্গেট ছিল সেটি বের করা।’

তিনি বলেন, ‘এ লক্ষ্যে তদন্ত কাজ এগিয়ে নিচ্ছিলাম। একটা পর্যায়ে যখন দেখলাম ওই মেয়েটির কাছের আত্মীয় ও যাদের বিভিন্ন কারণে সন্দেহ করা হয়েছে এমন সাতজনের ডিএনএ রিপোর্ট নেগেটিভ আসছে তখন ভাবলাম এর বাহিরে আর কারা কারা আছে। এই টার্গেটে আমি আরও ছয়জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করি। সেইসঙ্গে জানতে পারি যে, নিহতের চাচাতো ভাই টেক্কা বিয়ে করার দুমাস পর তার চাচাতো বোন ফাতেমা আত্মহত্যা করেছে। এটা শোনার পর তাকে একটু বেশি সন্দেহ করতে থাকি। তাই টেক্কাসহ ওই ছয়জনের ডিএনএ নমুনা ফরেনসিক ল্যাবে পাঠাই। ল্যাবে রিপোর্টে জানা যায়, টেক্কার সঙ্গে নিহতের গর্ভের বাচ্চার ডিএনএ ম্যাচ করেছে। এরপরই তাকে আটক করে আমাদের হেফাজতে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করি। জিজ্ঞাসাবাদে সে ধর্ষণ ও হত্যার সবকিছু স্বীকার করে। আসামি টেক্কা বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। খুব শিগগিরই এই তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (ফরেনসিক) রুমানা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভিকটিমের গর্ভের সন্তানের পিতৃ-পরিচয় খুঁজতে গিয়েই মূলত ধরা পড়ে আসামি। আমরা ভিকটিমের গর্ভের বাচ্চার ডিএনএ’র সঙ্গে সন্দেহভাজনদের ডিএনএ তিন ধাপে পরীক্ষা করি। এতে প্রথমে চারজন এবং পরে তিন জনের ডিএনএ টেস্ট করা হয়। কিন্তু তাতেও সন্তানের পিতৃ-পরিচয় মিলছিল না। পরে আরও ছয়জনের ডিএনএ টেস্ট করলে সেখানে ভিকটিমের চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে রিপোর্ট ম্যাচ করে। আর এভাবেই ভিকটিমের গর্ভের সন্তানের পিতৃ-পরিচয় তথা হত্যাকারীও চিহ্নিত হয়।’

এ বিষয়ে সিআইডির ডিআইজি শেখ নাজমুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছয় বছর আগে একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তের নির্দেশ পায় সিআইডি। দায়িত্ব পাওয়ার পর নিহতের গর্ভের বাচ্চার ডিএনএ’র সঙ্গে ১৩ জনের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে আসামি গ্রেফতার করতে সক্ষম হই।’ ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে আসামি চিহ্নিত করার ঘটনাটি সিআইডির তদন্ত কার্যক্রমে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে বলে মনে করেন তিনি।

সারাবাংলা/এসএইচ/পিটিএম

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন