বিজ্ঞাপন

শ্রমিকদের দুঃখ ঘুচবে কবে?

January 25, 2021 | 7:34 pm

রায়হান আহমেদ

শ্রম, শ্রমিক ও উৎপাদন তিনটি জিনিস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শ্রমিকদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে আসে উৎপাদন। তাদের কঠোর পরিশ্রম আর খাটুনির মাধ্যমে নির্মিত হয় ইতিহাস। গড় উঠে শহর, নগরী, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সভ্যতা। কিন্তু এই শ্রমিকরাই তাদের প্রাপ্য মজুরি থেকে হচ্ছে বঞ্চিত । যুগ যুগ ধরে মালিকসমাজ শ্রমিকদের রক্ত শোষণ করে তাদের ন্যায্য মজুরী থেকে বঞ্চিত করে আসছে। বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে শুধুমাত্র গার্মেন্টস শিল্পে রফতানি আয় বেড়েছে বহুগুণ, কিন্ত সেই অনুপাতে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরী নিশ্চিত হয়নি। বরং চরম অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার শ্রমিক সমাজ। দায়িত্বশীল সরকার ও এ ব্যাপারে এখনও কোনো সমাধান দিতে পারেনি। বরং তারা তাদের মজুরি চুরি, কারখানার ইউনিয়নীকরণ, অগ্নিনিয়ন্ত্রণ ও ভবন নিরাপত্তার চরম অভাবসহ বিভিন্ন অধিকারের জন্য আন্দোলন করে ক্রমাগত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ফলে কেউ কর্মক্ষমতাহীন, আবার কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

বিজ্ঞাপন

একটা সময় ছিল যখন শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা ছিল না। মালিকপক্ষ জোর করে শ্রমিকদের ১০-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করাতো। কিন্ত সেই অনুযায়ী তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হতো না। তখন ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ ও তাদের ন্যায্য মজুরীর জন্য আন্দোলন ও বিক্ষোভ শুরু করে। পরে কয়েকজন শ্রমিকের প্রাণের বিনিময়ে মালিকপক্ষ তাদের দাবী মানতে বাধ্য হয়। সেই থেকে গোটা বিশ্বে শ্রমিক সমাজে ব্যাপক উন্নতি হয় শ্রমিকরাও তাদের প্রাপ্ত সুবিধাগুলো ভোগ করে।

কিন্ত সেই অনুযায়ী অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রমিকদের দুঃখ দুর্দশা ঘুচেনি। বিশেষ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন পোশাক গার্মেন্টস, কল কারখানার, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের অবস্থা খুবই হতাশাজনক। এই শ্রমিকগুলোই শুধুমাত্র প্রকৃত মজুরীর জন্য, তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য প্রায়শ ধর্মঘট, রাস্তায় বিক্ষোভ আন্দোলন করে থাকেন। এতে অনেক শ্রমিক প্রাণ হারান, অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করে কর্মক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। চিন্তার বিষয় এখানে যে, যাদের শ্রমে দেশের উন্নতি নির্ভর করে, অর্থনীতি সচল থাকে, জিডিপি বৃদ্ধি পায়, তাদের প্রতি আমাদের দেশের মালিকপক্ষের ও শাসকসমাজের এই স্বার্থান্বেষী শোষণ, নিপীড়ন কতটুকু শোভা পায়?

সম্প্রতি গাজীপুরের স্টাইল ক্র্যাফটসের পোশাক শ্রমিকেরা তাদের তিন মাসের বকেয়া বেতন ভাতার দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করেছে। এছাড়াও ৭ জানুয়ারি ইস্ট ওয়েস্ট লিমিটেড কারখানার শ্রমিক ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে। এভাবে মাসের পর মাস দেশের গার্মেন্টস, পাটকল, চিনিকলের শ্রমিকেরা শুধুমাত্র তাদের প্রাপ্য অধিকার ও প্রকৃত মজুরির জন্য আন্দোলন, ধর্মঘট করে যাচ্ছে। গত বছর করোনা মহামারি যখন প্রকট আকারে ধারণ করেছে ঠিক সেই পরিস্থিতিতেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাজীপুরের দুরন্ত গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন করতে গিয়ে আহত হয়েছে অনেক শ্রমিক৷ এভাবে আন্দোলন করেও প্রতিদিন নিপীড়িত হচ্ছে তারা।

বিজ্ঞাপন

২০১৭ সালের খুলনার প্লাটিনাম জুটমিল শ্রমিকদের আন্দোলন যেখানে অনশন করে জীবন দিয়েছিল এক শ্রমিক। সাভারের মৃত্যুকুপ রানাপ্লাজার ধ্বস যেখানে সহস্রাধিক শ্রমিক নিহত হয়েছিল এছাড়াও তাজরীন ফ্যাশনের স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড যা গোটাবিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। এই শত শত শ্রমিকদের তাজাপ্রাণগুলোর ক্ষতিপূরণ মালিকপক্ষ এবং সরকার কেউ দিতে পারেনি। এর সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়াল দোষীদের শাস্তি প্রদান করতে বার বার ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র প্রশাসন।

সিডিপির তথ্য মতে, জাতীয় খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের একজন শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রয়োজন ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা। সেখানে দেশের শ্রমিকদের গড় আয় আয় হচ্ছে মাত্র ৫৪১২ টাকা। ফেয়ার লেবার অ্যাসোসিয়েশন জানায় যে, বাংলাদেশে কারখানা শ্রমিকদের আয় বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র সীমার নিচে। ফলে শহর অঞ্চলে একজন শ্রমিকের পরিবারসহ ভরণপোষণের ব্যয়ভার এই টাকা দিয়ে কখনো সম্ভব হয়ে উঠে না।

জানা যায়, প্রতিবছর বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্প প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক নিয়োগ করে এবং প্রায় ২৫০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করে। কিন্তু সেই অনুপাতে আমাদের দেশের শ্রমিক অধিকার বারবার খর্ব করা হয় ক্রমাগত নির্যাতন, মামলা, হামলার মাধ্যমে। শ্রমিকদের এই ন্যায্য অধিকারের জন্য বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, ওয়ার্কার্স পার্টি, ট্রেড ইউনিয়ন বিভিন্ন আন্দোলন করলেও আশানুরূপ ফল পায়নি। শ্রমিকদের দাবী ছিল তাদের ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্মস্থলের নিশ্চয়তা। সেই সঙ্গে ন্যূনতম বেঁচে থাকার মতো মজুরি তাদেরকে দিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

আমাদের এই অনুন্নত দেশের জন্য, উন্নত সভ্যতার জন্য শিল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এটি শুধু মালিকপক্ষ আর শ্রমিকপক্ষের দ্বন্দ্ব নয়, এটাকে জাতীয় ইস্যু হিসেবে নিয়ে শ্রমিকদের পক্ষে আমাদের জোর দাবি তুলতে হবে। তাই  আমাদের প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার যেন সমুন্নত থাকে সেই প্রচেষ্টা করতে হবে। সকল বৈষম্য দূর করে শ্রমজীবী মানুষের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন