বিজ্ঞাপন

অ্যান্টিবডি টেস্ট অনুমোদন, জানে না ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর

January 26, 2021 | 9:58 am

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: গত রোববার (২৪ জানুয়ারি) সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, দেশে অ্যান্টিবডি টেস্টের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একদিন পার হয়ে গেলেও দেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর কর্তৃপক্ষ এখনও এ বিষয়ে কিছু জানে না বলে জানা গেছে। অ্যান্টিবডি টেস্টে কোন কিট ব্যবহার করা হবে বা আদৌ কোনো কিট অনুমোদন দেওয়া হয়েছে কিনা সে বিষয়েও কিছু বলতে পারছে না অধিদফতরের কর্মকর্তারা।

বিজ্ঞাপন

যদিও ওইদিন (২৪ জানুয়ারি) স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘দেশে অনেকের দাবি ছিল অ্যান্টিবডি টেস্টের অনুমতি দেওয়ার। এখন এটা চালু করার অনুমতি দিয়ে দিয়েছি। আজ আপনাদের যখন বললাম তখন থেকেই এটা চালু হয়ে গেল।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘অ্যান্টিবডি টেস্ট বিষয়ে ইতোমধ্যেই দেশে একটি নীতিমালা আছে। কিন্তু শুধুমাত্র মন্ত্রীর কথার ওপরেই তো আর কোনো কিছু চালু করা যেতে পারে না। এ জন্য একটি নির্দেশনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া প্রয়োজন।’

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় নাই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ধরণের প্রজ্ঞাপন বা অনুমতিপত্র ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কাছে দেওয়া হয় নাই। আর তাই যদি অ্যান্টিবডি টেস্টের অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে তবে তার জন্য কোন ধরণের কিট ব্যবহার করা হবে সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয় নাই। একইসঙ্গে দেশে অ্যান্টিবডি টেস্ট কী সরকারি ভাবে হবে নাকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হবে, সেরো সার্ভিলেন্সের জন্য ব্যবহার হবে নাকি বাণিজ্যিকভাবে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে হবে এমন কোনো নির্দেশনা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কর্মকর্তাদের জানা নেই।

বিজ্ঞাপন

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন অ্যান্টিবডি পরীক্ষা অনুমোদনের বিষয়ে। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা আসলে শুধু টিভিতেই দেখেছি। আর পত্র-পত্রিকায় আপনাদের করা সংবাদে দেখেছি। এর বেশি আমরা আর কিছু বলতে পারছি না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ধরণের প্রজ্ঞাপন বা নির্দেশনা এখনো আসেনি।’

জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মুখপাত্র ও উপপরিচালক আইয়ুব হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এমন নির্দেশনার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।’

জানতে চাইলে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, “এখন আবার অ্যান্টিবডি কিটের অনুমোদন? তাহলে এর আগে যে আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি’র এক গবেষণায় বলা হলো রাজধানীর ৪৫ শতাংশ মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) অ্যান্টিবডি পজিটিভ পাওয়া গেছে। বস্তি অঞ্চলে এই হার আরও বেশি— প্রায় ৭৪ শতাংশ। যদি দেশে অ্যান্টিবডি টেস্টের অনুমোদন না থাকে তবে তারা কিভাবে করলো? আর যদি এখন অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে তবে সেটা কী কিটের অনুমোদন নাকি কী- আমি আসলে তাই আর এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।”

বিজ্ঞাপন

দেশে নমুনা পরীক্ষা সম্প্রসারণ নীতিমালা কমিটির প্রধান অধ্যাপক লিয়াকত আলী সারাবাংলাকে বলেন, “ইতোমধ্যেই ২০২০ সালের জুন, জুলাই মাসের দিকে র‍্যাপিড টেস্ট বিষয়ে বাংলাদেশে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। সেই নীতিমালা মেনে ইউএসএফডিএ’র আমব্রেলা গাইডলাইন অন সেরোলজিক্যাল টেস্ট এবং আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের এর আলোকে র‍্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের জন্য কম্বাইন্ড (IgG+IgM) এর জন্য ন্যুনতম সেনসিভিটি ৯০ শতাংশ ও স্পেসিফিটি ৯৫ শতাংশ হতে হবে। এছাড়াও আলাদা আলাদাভাবে IgG এর ক্ষেত্রে ন্যুনতম ৯০ শতাংশ ও স্পেসিফিটি ৯৫ শতাংশ নির্ধারিত হবে। এলিসা মেথডের ক্ষেত্রে র‍্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের মতোই সেনসিভিটি ও স্পেসিফিটি নির্ধারিত হবে। তবে ডায়াগনস্টিক কিট হিসেবে নয়, শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সময় পরে অ্যান্টিবডি শনাক্তকরণের জন্য র‍্যাপিড টেস্ট কিট অনুমোদন পেতে পারে।”

র‍্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট অনুমোদন দিল সরকার

দেশের বিভিন্ন স্থানে সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনা করে এবং প্লাজমা থেরাপির সহায়তার জন্যেও র‍্যাপিড টেস্ট কিট অনুমোদন পেতে পারে বলেও উল্লেখ করেন অধ্যাপক লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, ‘দেশে যেহেতু ইতোমধ্যে নীতিমালা করা হয়েছে তাই এ বিষয়ে আর নতুন কিছু প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে দেশে যারা অ্যান্টিবডি কিট আমদানি করবে তারা সরাসরি আবেদন করবে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কাছে। সেখান থেকে অনাপত্তিপত্র পেলে তারা আমদানি করবে। অথবা দেশে যদি কোনো কিট বানানো হয়ে থাকে তবে তার মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে ব্যবহার করার অনুমতি নিবে। এক্ষেত্রে অবশ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনুমতি দেবে না, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর দেবে। কিন্তু সেজন্য তাদের কাছে সেই নির্দেশনাটা তো পৌঁছাতে হবে। কারণ এটি কী সরকারিভাবে ব্যবহার হবে নাকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার হবে তার নির্দেশনা কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতর বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেই দিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশে যখন র‍্যাপিড টেস্ট বিষয়ে নীতিমালা তৈরি করা হয় তখন কিন্তু নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোর একটা বিষয় ছিল। এখন কিন্তু সেই পরিস্থিতি নেই। অ্যান্টিবডি টেস্টটা হলো সেরো সার্ভিলেন্সের জন্য, এটা কখনোই ডায়াগনস্টিকের জন্য না। অর্থাৎ কারো অতীতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ হয়েছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আমরা এখনো জানি না যে কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে কতদিন অ্যান্টিবডি থাকতে পারে। হয়তোবা শুরু হলে তখন বলা যাবে। কারণ একেক দেশের আবার ভ্যারিয়েশন আছে। কোনো দেশে দেখা যাচ্ছে তিন মাস রিপোর্টেড হচ্ছে, তারপরে সেই গ্রাফ পড়তে থাকে। আর তাই আমাদের দেশের অ্যান্টিবডি কতদিন থাকবে, কারও দ্বিতীয় সংক্রমণ হচ্ছে কি না এগুলো হয়ত তখন জানা যাবে।’

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে কিনা তা জানার জন্য এই সার্ভিল্যান্স প্রয়োজন উল্লেখ করে অধ্যাপক লিয়াকত বলেন, ‘আমাদের পরামর্শ ছিল ডায়াগনস্টিক ক্ষেত্রে ব্যবহার না করে সেরোসার্ভিলেন্সের জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট চালু করার জন্য। কারণ দেশের অনেক রোগী কিন্তু দেখা যাচ্ছে উপসর্গহীন। যে কারণে অনেকেই নমুনা পরীক্ষা না করায় সংক্রমণের সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। অ্যান্টিবডি টেস্ট চালু হলে হয়তো সেরো সার্ভিল্যান্সে তাদের সংক্রমণের বিষয়ে জানা যাবে। এক্ষেত্রে মুখের কথার ওপর কিন্তু অ্যান্টিবডি টেস্ট চাইলেই শুরু করা যাবে না। এজন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটা নির্দেশনা বা প্রজ্ঞাপন জারি করা।’

বিজ্ঞাপন

কবে নাগাদ নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে এবং কোন কিট ব্যবহার করা হবে জানতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।

এর আগে, গত বছরের ২৪ আগস্ট স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) শনাক্তে অ্যান্টিবডি টেস্টের অনুমোদন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে সরকারি হাসপাতাল ও ল্যাবে অ্যান্টিজেন টেস্ট শুরু করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পরে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলেও তখন জানিয়েছিলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

তবে গত ৩ জুন দেশে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটি তাদের সভায় কোভিড-১৯ শনাক্তে র‌্যাপিড টেস্টের জন্য সুপারিশ করে। তারা আরটি পিসিআর (রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ পলিমারেজ রিঅ্যাকশন) পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করার পক্ষেও মত দেন।

পরবর্তীতে ১৭ সেপ্টেম্বর কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটি অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি টেস্টের ওপর গুরুত্বারোপ করে। কমিটি তাদের সভা শেষে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তখন বলেছিল, বর্তমানে পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হচ্ছে, যার পরিমাণ তুলনামূলক ভাবে কম। কোভিড-১৯ পরীক্ষার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারলে কোভিড-১৯ সংক্রমণ আরও বেশি শনাক্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য জাতীয় পরামর্শক কমিটি অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি টেস্টের জন্য একাধিক বার পরামর্শ দেয়। তিন পদ্ধতিতে (পিসিআর, অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি টেস্ট) কোভিড-১৯ পরীক্ষা কার্যক্রম পাশাপাশি থাকলে তা কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও পরামর্শ দেওয়া হয় জাতীয় কারিগরি কমিটির সভায়।

সারাবাংলা/এসবি/এমও

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন