বিজ্ঞাপন

সলঙ্গা বিদ্রোহের ইতিহাস রহস্যজনকভাবে চাপা পড়ে আছে

January 26, 2021 | 7:22 pm

এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া

২৭ জানুয়ারি ব্রিটিশবিরোধী আজাদি লড়াইয়ে সলঙ্গা আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। ১৯২২ সালের এই দিনে তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ বাহিনীর গুলিতে রায়গঞ্জ থানার সলঙ্গা হাটে বিলেতি পণ্য বর্জন আন্দোলনের কর্মীসহ সাধারণ জনতা শহীদ হন। ব্রিটিশ শাসন আমলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে জনতা উদ্বেলিত হয়ে বিলেতি পণ্য বর্জন করে স্বদেশী পণ্য ব্যবহারের সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। এ আন্দোলনের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে সলঙ্গায়। যাদের শাহাদাতের রক্তপিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে ভারতবর্ষ থেকে এক সময় শোষণের হাত গুটাতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা, এবং এই পথ ধরেই কিছুকাল পরে আমরা পেয়েছি স্বাধীন একটি ভূখণ্ড—বাংলাদেশ। পেয়েছি একটি মানচিত্র আর লাল সবুজের পতাকা।

বিজ্ঞাপন

১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি তরুণ নেতা মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার সলঙ্গা হাটে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ওই দিন প্রায় ১২০০ প্রতিবাদী মানুষ ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায়। আহত হয় চার হাজারের বেশি। নিহতদের লাশের সঙ্গে সংজ্ঞাহীন আহতদের উঠিয়ে নিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ সিরাজগঞ্জের রহমতগঞ্জে গণকবর দেয়।

সলঙ্গা তদানীন্তন পাবনা জেলার একটি ব্যবসায়িক জনপদ। সপ্তাহে দুই দিন হাট বসত। ১৯২২ সালে ২৭ জানুয়ারি শুক্রবার ছিল বড় হাটবার। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের কর্মীরা হাটে নেমেছে বিলেতি পণ্য ক্রয় বিক্রয় বন্ধ করতে। আর এই স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীদের রুখতে ছুটে আসে তদানীন্তন পাবনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব আরএনদাস, জেলা পুলিশ সুপার ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক জনাব এসকে সিংহ-সহ ৪০ জন সশস্ত্র লাল পাগড়িওয়ালা পুলিশের একটি দল। সলঙ্গার গো-হাটায় ছিল বিপ্লবী স্বদেশী কর্মীদের অফিস। পুলিশ এসে তার ব্যাটেলিয়নদের নিয়ে কংগ্রেস অফিস ঘেরাও দিয়ে গ্রেফতার করে নেতৃত্বদানকারী মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে। সঙ্গে সঙ্গে জনতার মধ্যে থেকে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার ও মহকুমা অফিসারকে ঘিরে জনতা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে উদ্ধারের জন্য মিছিল বের করে।

জনতার ঢল ও আক্রোশ দেখে ম্যাজিস্ট্রেট জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে গুলি চালাতে নির্দেশ দেন। শুরু হয়ে বুলেটবৃষ্টি। ৪০টি রাইফেলের মধ্যে মাত্র একটি রাইফেল থেকে কোনো গুলি বের হয়নি। ওই রাইফেলটি ছিল একজন বাঙালি পুলিশের। পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে হতাহতের সরকারি সংখ্যা ৪, ৫০০ দেখানো হলেও বেসরকারি মতে দশ হাজারেরও বেশি বলে জানা যায়। সলঙ্গা হাটের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের চেয়ে বহুগুণ ভয়ংকর ও নৃশংস। অথচ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তথা শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ এই ঘটনা অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে চাপা পড়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯২২ সালের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে সলঙ্গা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যেমন সবচেয়ে নৃশংস পাশবিক তেমনি নিহতের সংখ্যাও সর্বাধিক।

বিজ্ঞাপন

সেদিন সলঙ্গা হাটে নিরপরাধ জনতারা ছিলেন নিরস্ত্র। তবে তাদের বুকে ছিল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, চোখে ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন আর চেতনা। পুলিশ মদের দোকানের কাছে অবস্থান নেয় এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে আন্দোলনকারী এবং সাধারণ হাটুরে জনতার উপর গুলিবর্ষণ করে কাপুরুষের মতো। ৩৯টি রাইফেলের নির্বিচার গুলিবর্ষণে অল্পক্ষণের মধ্যেই তাজা রক্ত আর নিথর লাশের স্তূপ জমে যায় সলঙ্গার হাটে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত জনতা নিজেদের দাবি থেকে তারপরও একচুল সরেনি। ব্রিটিশদের গ্রেফতারিতে রেখে যেতে চায়নি তাদের নেতাকে। সংবাদপত্রের উপর সে সময় ব্রিটিশদের কড়া নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, নায়ক এবং অন্যান্য পত্রপত্রিকায় বহুদিন ধরে সলঙ্গা হত্যাকাণ্ডের  খবর এবং সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।

আজ ৯৯ বছর পর আজকের প্রজন্মের নিকট এ ঘটনা নতুন ও বিস্ময়কর মনে হতে পারে। এটা স্বাভাবিক, কারণ তৎকালীন পাবনা জেলার (বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলা) সলঙ্গার হাটের যে গণ বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল তা নিয়ে খুব বেশি লেখালেখি হয়নি। উপমহাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে বাঙালি মুসলমান নেই বললেই চলে। ফলে মুসলমানদের বীরোচিত কাহিনী এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আবার মুছেও ফেলা হয়েছে। সুবিধাবাদীরা নিজেদের মতো করেই ইতিহাস রচনা করেছে। ফলে দুঃখজনকভাবে সলঙ্গার ঘটনাটি ইতিহাসের কাঁদায় চাঁপা পড়ে গেছে।

মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ সলঙ্গা বিদ্রোহ উপনিবেশিক শাসনের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সলঙ্গার রক্তসিক্ত বিদ্রোহ শুধু বাংলার মাটিকে সিক্ত করেনি, সিক্ত করেছে সমগ্র উপমহাদেশ। রক্তে ভেজা পিচ্ছিল পথে অহিংস, অসহযোগ আন্দোলনে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তা সলঙ্গা বিদ্রোহেরই ফসল।

বিজ্ঞাপন

২৭ জানুয়ারি সেই রক্তে আগুন জ্বালানো দিন। আমরা গর্বিত আমরা সলঙ্গা বিদ্রোহের মহানায়ক মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের উত্তরসূরি। আজকের এই দিনে তার অমর স্মৃতির প্রতি গভীরতম শ্রদ্ধা।

লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন 

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন