বিজ্ঞাপন

রোহিঙ্গা ডায়াসপোরাকে প্রকাশ্যে আর্থিক সহযোগিতার তাগিদ

January 29, 2021 | 8:11 pm

এমএকে জিলানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: চলমান রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়ের তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সংকট সমাধানে এসব নেতৃত্বের সহায়তা নিতে পারে বাংলাদেশ। এছাড়া সংকট সমাধানে রোহিঙ্গা ডায়াসপোরা, তথা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে কাজে লাগানো উচিত। প্রয়োজনে রোহিঙ্গা ডায়াসপোরাকে প্রকাশ্যে আর্থিক সহায়তাও করতে পারে বাংলাদেশ। এটি করতে পারলে রোহিঙ্গা ডায়াসপোরার মাধ্যমে মিয়ানমারের অপকর্ম বিশ্ববাসী জানতে পারবে বলে মত দিচ্ছেন তারা সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞাপন

তারা আরও বলছেন, এর পাশাপাশি সাইবার বিশ্বে বাংলাদেশ সরকার পাঁচ হাজার কর্মী নিয়োগ দিতে পারে, যারা রোহিঙ্গা নির্যাতনের সত্য তথ্য-উপাত্ত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে কাজ করবে।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধান বিষয়ে সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমিনুল করিম ও রোহিঙ্গা স্টুডেন্টস নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা রো সাইয়েদুল্লাহ এমন মন্তব্য করেছেন।

আরও পড়ুন-

বিজ্ঞাপন

মিয়ানমারের রাখাইনে হত্যা ও নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন ৮ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক। এর আগেও আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ।

২০১৭ সালের ওই সময়ে সীমান্ত পেরিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সম্মানজনকভাবে স্বদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে আসছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর প্রত্যাবাসন চুক্তি, ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন এবং ২০১৮ সালের ১৫-১৬ জানুয়ারি দুই দিনব্যাপী বৈঠকে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত মাঠ পর্যায়ের বিষয় সই করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু মিয়ানমার এখনো এসব চুক্তির কিছুই মানেনি। মাঝে চীনের সহায়তায় ত্রিপাক্ষিক উদ্যোগ ও বৈঠকও হয়েছে। তাতেও কোনো ফল আসেনি।

বিজ্ঞাপন

চলমান এই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের পথ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রোহিঙ্গা স্টুডেন্টস নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা রো সাইয়েদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যেন নিরাপদে ও সম্মানের সঙ্গে মিয়ানমারে যেতে পারে, সেজন্য বাংলাদেশ সরকার কাজ করছে। এই কাজে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’

এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমিনুল করিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বের বড় বড় শহর, বিশেষ করে যে দেশগুলোর নাগরিকরা মিয়ানমারের অপরাধ সম্পর্কে তেমন জানে না, সেসব দেশের শহরে শহরে এই বিষয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে জনমত গড়তে ধারাবাহিকভাবে সেমিনার, আলোচনা, লিফলেট বিতরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।’

বিশ্বব্যাপী এমন জনমত গড়তে সমন্বিত পদক্ষেপের তাগিদ দিয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়তে যে কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে, তা সমন্বিতভাবে পরিপল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে সরকারি-বেসরকারি উভয়ের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে (রোহিঙ্গা ডায়াসপোরা)। বাংলাদেশের উচিত রোহিঙ্গা ডায়াসপোরা ব্যবহার করা। প্রয়োজনে রোহিঙ্গা ডায়াসপোরাকে প্রকাশ্যে অর্থনৈতিক সহায়তাও করতে পারে বাংলাদেশ। এখানে গোপনীয়তার কিছু নেই। কেননা রোহিঙ্গা ডায়াসপোরাও প্রত্যাবাসনের পক্ষেই কাজ করছে। তাই তাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা করাই যায়। এতে অনেক বেশি কাজ হবে। কারণ তারা ভুক্তভোগী। তারা বিশ্বব্যাপী তাদের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরলে তা বিশ্বে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।’

বিজ্ঞাপন

তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মিয়ানমারের আচরণ দৃশ্যমান রাখা। বিশ্ব মানবতার জন্য রোহিঙ্গা ইস্যু খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মিয়ানমার রাখাইনে যে গণহত্যা চালিয়েছে, তার জন্য তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা উচিত। তাই যত ইস্যুই আসুক না কেন, এই ইস্যুকে দৃশ্যমান রাখতে হবে।’

এ ক্ষেত্রে অনলাইন প্রচারের দিকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন সাবেক এই সচিব। তিনি আরও বলেন, ‘সাইবার জগতে মিয়ানমার বাংলাদেশের তুলনায় বেশি সক্রিয়। সাইবার ওয়ার্ল্ড এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সাইবার ওয়ার্ল্ডে বাংলাদেশের আরও বেশি সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। এখানে সরকারের তরফ থেকে পাঁচ হাজার ছেলেকে লাগিয়ে দেওয়া যেতে পারে, যারা মিয়ানমারের অপকর্ম নিয়ে সাইবার বিশ্বে কাজ চালাবে। রোহিঙ্গা নির্যাতনের সত্য তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এই তরুণরা কাজ করবে। এর পেছনে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ সহযোগিতা করার সামর্থ্য আছে।‘

এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোরও তাগিদ দিয়েছেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমিনুল করিম। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা ও এক্সটার্নাল পাবলিসিটি— দুইটিকেই আরও শক্তিশালী করতে হবে। এই ইস্যুতে বিশ্বব্যাপী স্লোগান চাউর করতে হবে।’

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতৃত্ব গড়ে ওঠার বিষয়টি সমন্বয় করা প্রয়োজন। ক্যাম্পগুলোতে এক ধরনের রোহিঙ্গা নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। কিন্তু এসব নেতৃত্বের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বরং তারা অনেক অপকর্মেও জড়িত। কিন্তু যদি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সমন্বয়ের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নেতৃত্ব গড়ে তোলা হতো, তাহলে তারা বাংলাদেশের উদ্যোগের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারত।’

এদিকে, গত বছরের ৪ ও ২৯ ডিসেম্বর দুই দফায় ৩ হাজার ৪৪৬ জন রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের আশ্রয় শিবির থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে নোয়াখালীর ভাসানচরে। সবশেষ আজ শুক্রবার (২৯ জানুয়ারি) তৃতীয় দফায় আরও ১ হাজার ৭৭৮ জন রোহিঙ্গাকে পাঠানো হয়েছে ভাসানচরে। সরকার বলছে, ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করা সম্ভব। কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরগুলো থেকে যারা আগ্রহী, তাদেরই কেবল সেখানে পুনর্বাসন করা হবে।

সারাবাংলা/জেআইএল/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন