বিজ্ঞাপন

পর্নহাবের কন্যারা।। পর্ব-১

January 30, 2021 | 8:57 pm

রেহমান মোস্তাফিজ

প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম বিভিন্ন পর্নওয়েবসাইট। এগুলোর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতাকে উসকে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ আছে। এমনই একটি ওয়েবসাইট পর্নহাব। সম্প্রতি পর্নহাবের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে বরং একে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পর্নহাব নিজে নারী বা শিশু নির্যাতনে অংশ নিচ্ছে তা নয়, কিন্তু এটি একটি মুক্ত প্লাটফর্ম হওয়ায় এখানে যেকোন ব্যবহারকারী ইচ্ছামতো ভিডিও আপলোড দিতে পারেন। আবার সেসব ভিডিও সহজেই ডাউনলোড দিয়ে ব্যক্তিগত সংগ্রহেও রাখা যায়।

বিজ্ঞাপন

এই সুযোগে অনেকেই শিশু, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অবৈধ উপায়ে সংগৃহীত ভিডিও আপলোড দেন পর্নহাবে। ভুক্তোভোগীরা অভিযোগ করে বা আইনের আশ্রয় নিলেও সঠিক বিচার পাচ্ছেন না। এবং আইনের ঘোরপ্যাঁচে শাস্তির আওতায় আসে না অন্যতম বড় এই পর্ন ওয়েবসাইট। শাস্তি তো দূরের কথা এসব ভিডিওর মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে তারা। এবিষয়েই সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসে নিকোলাস ক্রিস্টোফের মতামত কলাম ছাপা হয়েছে। সারাবাংলার জন্য সেটি অনুবাদ করেছেন রেহমান মোস্তাফিজ। চার পর্বের লেখাটি পড়তে সারাংলার সঙ্গেই থাকুন।

১ম পর্ব 

নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারের মতো জায়গায় বিশাল এক বিলবোর্ডে তাদের বিজ্ঞাপন দেখতে পাবেন। আবার জনসেবাতেও দেখা যায় তাদের। বোস্টনের তুষারে ঢাকা রাস্তায় তুষার সরানোর ট্রাক সরবরাহ করে, জাতিগত সাম্যের জন্য লড়ে যাওয়া বিভিন্ন সংস্থাকে আর্থিক অনুদান দেয় আবার কোভিড পরিস্থিতিতে ঘরে আটকে থাকা মানুষের জন্য বিনামূল্যে তাদের ভিডিও দেখার সুযোগ করে দেয়। পর্নহাব এভাবে শুধুমাত্র আলোচনাতেই থাকে না, প্রাপ্তবয়স্ক ভিডিওর কথিত মুখ হিসেবে নিজেদের নিয়ে রীতিমত গর্ব করে।

বিজ্ঞাপন

তবে  আর এভাবেই নিজেদের ‘উপকারী’ হিসেবে দেখানো পর্নহাব মাসে প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন মানুষকে আকৃষ্ট করে যা কিনা ইয়াহু, নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজন থেকেও অনেক বেশি। প্রতিদিন পর্নহাব প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার আয় করে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন থেকে। ‘ওয়ান র‍্যাংকিং’ এর মতে বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক দেখা ওয়েবসাইটের মধ্যে পর্নহাবের অবস্থান ১০ম।

তবে বিনোদনের আড়ালেই রয়েছে এর অন্য চেহারা। এটি ধর্ষণের ভিডিও দিয়ে ভরা। শিশু ধর্ষণ, প্রতিশোধ পরায়ণ পর্নগ্রাফি, গোপন ক্যামেরায় নারীদের গোসলের দৃশ্য, বর্ণবাদী এবং মেসজোনিস্ট (পুরুষকে শ্রেষ্ঠ দেখানো হয় এমন) বিষয়বস্তু এবং নারীকে প্লাস্টিক ব্যাগের ভেতর শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় দেখানোর মতো ভিডিয়ে দিয়ে এটি ভরা। আর এভাবেই কানাডিয়ান এই প্রতিষ্ঠানটি কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে। এই ওয়েবসাইটে “girls under 18” বা “18yo” লিখে খুঁজলে ১ লাখেরও বেশি ভিডিওচিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে৷  আর এগুলোর অনেকাংশই লাঞ্ছিত হওয়ার ভিডিও।

ফ্লোরিডায় ১৫ বছরের এক মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর তার মা তাকে পর্নহাবের ৫৮টি ভিডিওতে খুঁজে পায়। ক্যালিফোর্নিয়ার ১৪ বছরের এক মেয়ে যৌন নিপিড়নের ভিডিও পর্নহাবে খুঁজে পায় তারই এক ছেলে সহপাঠি। যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ জানালে  আসামীকে গ্রেফতারও করা হয় কিন্তু কিছুই হয়না পর্নহাবের। বরং তারা এই ভিডিও প্রকাশ করে যা মুনাফা কামানোর তা কামিয়ে নেয়।

বিজ্ঞাপন

পর্নহাব অনেকটাই ইউটিউবের মতো। সদস্যরা নিজেদের ইচ্ছামতো ভিডিও প্রকাশ করতে পারেন। এভাবে এই সাইটে প্রতিবছর ৬৮ লাখ ভিডিও প্রকাশ পায়। এর অনেকগুলোই প্রাপ্ত বয়স্কদের সম্মতিতে করা হলেও শিশু নির্যাতন বা অন্যান্য অসংবেদনশীল ভিডিওর সংখ্যাও কম না। আর পর্নহাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা এগুলো কোন পর্যবেক্ষণই করে না বা এসব ভিডিওর কোন দায়িত্ব নেয় না। ভিডিও দেখে কোন মেয়ের বয়স ১৪ নাকি ১৮ তা বোঝা না গেলেও পর্নহাবের উচিৎ এগুলোর বৈধতা খুঁজে দেখা।

আবার পর্নহাব কিন্তু পুরোপুরি ইউটিউবের মতোও না। এখান থেকে যেকোন ভিডিও সরাসরি ডাউনলোড করা যায়। আর তাই যদি কখনো কোন ধর্ষণের ভিডিও কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মুছেও ফেলা হয়, তাতেও খুব একটা কাজের কাজ হয়না। দেখা যায় ইতোমধ্যেই সেটি লাখ লাখ মানুষের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে। আবার অবাধে শেয়ারও হতে থাকে এবং বারবার সেটি আপলোডও হতে থাকে।

ক্যালি নামের এক মেয়ে আমাকে বলে, ‘পর্নহাব আমার পাচারকারী’। তাকে চায়না থেকে যুক্তরাষ্ট্রে দত্তক নিয়ে আসা হয়। আসলে দত্তক নেওয়া পরিবারটির মাধ্যমেই সে পাচার হয়। এখানে আসার পর মাত্র নয় বছর বয়স থেকেই তাকে জোরপূর্বক পর্নগ্রাফিক ভিডিওচিত্রে আসতে বাধ্য করেছে তারা। তার কিছু ভিডিও শেষ পর্যন্ত পর্নহাবে এসে পৌঁছায় আর সেগুলো কিছুদিন পর পর নতুন করে আপলোড দেওয়া হয়।

সে আরও জানায়, ‘ইন্টারনেটে আমাকে এখনও বিক্রি করা হচ্ছে অথচ আজ পাঁচ বছর হল আমি সে জীবন পেছনে ফেলে এসেছি’। বর্তমানে ২৩ বছর বয়সী ক্যালি আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। কিন্তু পুরনো সেই ভিডিওগুলো যেন কিছুতেই তার পিছু ছাড়ে না। ফিরতে দিচ্ছে না স্বাভাবিক জীবনেও।

বিজ্ঞাপন

ক্যালি বলেন, ‘আমি হয়তো এর থেকে কখনও পালিয়ে বাঁচতে পারবো না। আমার বয়স যখন ৪০ হবে, হয়তো আমার ৮ বাচ্চা হবে এবং তখনো কেউ না কেউ আমার ছবি দেখে হয়তো হস্তমৈথুন করবে’। সে আরও যোগ করে, ‘তুমি শুধুমাত্র ‘এশিয়ান যুবতী’ লিখে খুঁজলেও হয়তো আমাকে সেখানে আমাকে পেয়ে যাবে’।

পর্নহাবে সম্প্রতি সেই অনুসন্ধানের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ২৬ হাজার ভিডিও দেখায়। সাজেস্টেড ভিডিও, ‘ইয়াং টাইনি টিন’, ‘এক্সট্রা স্মল পেটিট টিন’, ‘টাইনি এশিয়ান টিন’ অথবা শুধু ‘ইয়াং গার্ল’ লিখে সার্চ দেওয়ার তালিকার কথা আর নাইবা বলি। এছাড়াও পর্নহাবের ‘এক্সপ্লিটেড টিন এশিয়া’ নামক চ্যানেলেও অসংখ্য ভিডিও ছড়িয়ে আছে।

বিষয়টা পর্নগ্রাফি নিয়ে নয়, ধর্ষণ নিয়ে। আমাদের সবার একমত হতে হবে যে যে শিশুদের উপর নির্যাতন বা প্রাপ্তবয়স্ক কারও সম্মতি ছাড়া এসব প্রচার করাটাও অপরাধ। বিল কসবি, হার্ভি উইনস্টিন বা জেফরি এপস্টেইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ কিন্তু তাদের যৌনক্রিয়া নিয়ে নয়, সমস্যা নির্যাতিত নারীদের সম্মতির ধার না ধারা। ঠিক এই অভিযোগই পর্নহাবের বিরুদ্ধেও।

মেয়েদের বিনা অনুমতিতে তাদেরকে করা নির্যাতনের অনেক রেকর্ডিং আমি পর্নহাবে দেখেছি৷ এদের অনেকগুলোতে ধর্ষণকারী সেসব নারীর চোখের পাতা জোর করে খুলে দেখাতো যে তারা অনুভূতিহীন নয়৷

চীনে একদল পুরুষের হাতে নগ্ন করে নির্যাতনের শিকার এক নারীর ভিডিওর মাধ্যমে পর্নহাব সম্প্রতি কোটি কোটি টাকা লাভ করেছে। এছাড়াও পর্নহাব ‘স্ক্রিমিং টিন’, ‘ডিগ্রেডেড টিন’ এবং ‘এক্সট্রিম চোকিং’ এর মতো শিরোনামসহ ভিডিওর মাধ্যমে কোটি টাকার মুনাফা কামিয়ে নেয়। সমস্যা হচ্ছে এধরনের একটি ভিডিও দেখলেই নীচে অসংখ্য একইধরনের ভিডিওর সাজেশন আসতে থাকে।

যৌনতা ইতিবাচক হলেও পর্নহাব যা করছে তা নেতিবাচক
পর্নহাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে তারা কোনধরনের তথ্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইতে তারা বলে যে, ‘পর্নহাব শিশুদের সঙ্গে হওয়া যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এবং তাদের ওয়েবসাইট থেকে অবৈধ ভিডিও শনাক্ত ও নির্মূল করার জন্য একটি সুরক্ষা নীতি চালু করেছে।’ পর্নহাব আরও দাবি করে যে ওয়েবসাইটটি শিশুরা আছে এমন ভিডিওগুলি অনুমতি দেয় না এবং এধরনের অভিযোগ ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং নির্জলা মিথ্যা।’

সারাবাংলা/আরএফ/

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন