বিজ্ঞাপন

চসিকে দুর্নীতি: রেজাউলকে ‘চোখ-কান’ খোলা রাখতে বললেন সুজন

February 4, 2021 | 4:59 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে ‘চোখ-কান খোলা রাখার’ পরামর্শ দিয়েছেন সদ্য বিদায় নেওয়া প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম ‍সুজন। এছাড়া মেয়রের হিসেবে প্রকৃত অর্থেই ‘নগরপিতা’ হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (০৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নগরীর জামালখানে সিনিয়রস ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় সুজন এসব কথা বলেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি চসিকের প্রশাসক পদ থেকে বিদায় নেওয়ার পর গত ছয়মাসের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তিনি।

নতুন মেয়রকে ‘নগরপিতা’ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সুজন বলেন, ‘নতুন মেয়রের প্রতি আমার পরামর্শ হচ্ছে- উনাকে নগরপিতা হতে হবে। প্রকৃত অর্থেই নগরপিতা হয়ে উনাকে সব মানুষের হতে হবে। দল থেকে নির্বাচন করে নির্বাচিত হলেও মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর ভাবতে হবে- আমি এই শহরের ৬০ লাখ মানুষের অভিভাবক। সিটি করপোরেশনের যে টাকা-সম্পদ, সেটা জনগণের সম্পদ, সেটাই ভাবতে হবে।’

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘করপোরেশনের প্রত্যেকটি বিভাগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হবে। দুর্নীতি সারা বাংলাদেশে যেটা আছে, সেটা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনেও আছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন তো আর বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। কিন্তু মেয়র যদি সজাগ থাকেন, চোখ-কান খোলা রাখেন এবং দুর্নীতিবাজ হিসেবে যারা পরিচিতি তাদের যদি আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেন, তাহলে দুর্নীতি নির্মূল করা না গেলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন যাদের তদন্ত করছে, তাদের সরিয়ে দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’

বিজ্ঞাপন

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকে দিনের ১২টায়ও অফিসে আসে না। অনেকে আবার রাত ২টায়ও লাইট জ্বালিয়ে কাজ করে। এটা কেন হবে? আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সোয়া ৯টায় কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দিয়েছি। এরপর অনেকে এসে ঢুকতে পারেনি।’

‘আবার বললাম- ৫টার পর কেউ অফিসে থাকতে পারবেন না। যদি কাউকে বিশেষ কাজের প্রয়োজনে থাকতে হয়, তাহলে আমার অনুমতি নিতে হবে। আপনি অফিস টাইমের পর বাসায় চলে যান, বাসায় গিয়ে বৌয়ের সঙ্গে ছক্কা খেলা খেলেন, অফিসে বসে ফুসুরফুসুর করার দরকার নাই। তিনদিনের মধ্যে দেখলাম- শতভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী সকাল ৯টার মধ্যে অফিসে এসে গেছেন এবং বিকেল ৫টায় অফিস ছেড়ে গেছেন। পৌরসভা থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন হয়েছে। কিন্তু মানসিকতাটা এখনও পৌরসভা লেভেলে রয়ে গেছে।’

বিজ্ঞাপন

চসিকে দক্ষ জনবল সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে প্রায় ১০ হাজার লোক কাজ করে। এক হাজারও কাজের লোক নেই। নিয়োগে কোনো নিয়মবালাই নেই। দক্ষ জনবল তৈরি করতে না পারলে সংকট থেকে যাবে। যিনি যে কাজের লোক, তাকে সেই জায়গায় বসাতে হবে। পরিচ্ছন্ন বিভাগে কিছু অতিরিক্ত লোক আছে। অতিরিক্ত জনবল ছাটাই করা উচিত। মেকানিক্যাল ও বিদ্যুৎ বিভাগ আকারে বিরাট, কিন্তু সেখানে একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারও নেই।’

অতিরিক্ত জনবলের কারণে শিক্ষা খাত এখন চসিকের জন্য বিরাট সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অপ্রয়োজনীয় অনেককিছুই শিক্ষাখাতে ঢুকে গেছে। অতিরিক্ত খরচ, এখানে একজন শিক্ষক ষষ্ঠ গ্রেডের একজন শিক্ষকের চেয়েও ২৫ হাজার টাকা বেশি বেতন পায়। মাসে তিন কোটি আর বছরে ৩৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ একটা আছে, সেখানে ৭০ জন ছাত্র ৩৫ জন শিক্ষক। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় রেখে বাকিগুলো ছেড়ে দিতে হবে।’

স্বাস্থ্যখাতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী চলে যাওয়ার পর স্বাস্থ্যখাতের মারাত্মক অবনতি হয়েছে। অনেক হাসপাতাল বসে আছে, সেগুলো সচল করতে হবে। আমি কিছুটা চেষ্টা করেছি।’

নগর পরিকল্পনা বিভাগের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্ল্যানিং বিভাগের কাজ দেখি শুধু গাছের চারা লাগানো। সেখানে পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদ দিয়ে সেটাকে নতুনভাবে সাজাতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

‘পরিচ্ছন্ন বিভাগে কিছু অতিরিক্ত লোক আছে। ডোর টু ডোর প্রকল্প মন্ত্রণালয় থেকে দিয়েছিল আউটসোর্সিং হিসেবে। দেখি উল্টো তারা করপোরেশন থেকে টাকা নেয়। সেগুলোর ৪০-৪৫ শতাংশ সক্রিয় আছে। অতিরিক্ত জনবল ছাটাই করা উচিত’— বলেন খোরশেদ আলম সুজন।

চসিকের আয়-ব্যয়ের মধ্যে বিশাল ফারাক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘করপোরেশনে এখন খরচ মাসে ১৮ কোটি টাকা। মার্চ থেকে সেটা ১৯ কোটি টাকা হবে। অনেক খাতে লাগাম টানতে হবে। গ্যাস-জ্বালানি তেল এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা তৈরি করতে পারলে সাশ্রয় হবে। আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।’

গৃহকরের পাশাপাশি আয় বাড়াতে আরও কিছু পথ নতুন মেয়রকে বাতলে দেন খোরশেদ আলম সুজন। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের ভৌগলিক অবস্থানের যারা সুবিধাভোগী তাদের থেকে সার্ভিস চার্জ আদায় করতে হবে। সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী চট্টগ্রাম বন্দর। পাঁচটন গাড়ি চলার উপযোগী রাস্তায় চট্টগ্রাম বন্দরের ২০-৩০ টন গাড়ি চলছে। তাদের ১ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। কেন তারা দেবে না। নতুন এসেসমেস্টে ২১৬ কোটি টাকা হয়, এখন দেয় ৩৬ কোটি টাকা। ১ শতাংশ দিলে ৭০০ কোটি টাকা আসবে।’

‘কাস্টমস আয় করেছে একবছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা। সেখান থেকেও ১ শতাংশ দিতে হবে। নীতিনির্ধারকরা বলেন— এটা বলবেন না। কেন বলব না? ল্যান্ড অব অরিজিন চট্টগ্রাম। করপোরেশনকে দেওয়া মানে চট্টগ্রামকে দেওয়া, বাংলাদেশের উন্নতি হবে। দুই ইপিজেডে মিলে ১৪০০ প্রতিষ্ঠান। ১২ টার ট্রেড লাইসেন্স আছে। দুই ইপিজেডের ১০-১৫ লাখ লোক এ শহরকে ব্যবহার করছে। সার্ভিস চার্জ কেন দেবেন না? ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া এরা কি ব্যবসায়ী। দুবাই, আমরিকা, সিঙ্গাপুর গেলে কি ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করতে পারবে ?’

পণ্যবাহী বড় যানবাহন থেকেও চার্জ আদায়ের পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, ‘কনটেইনার ইয়ার্ডগুলো এখন শহরের গলার কাঁটা। প্রতি প্রবেশপথে ইয়ার্ড। হাজার হাজার ট্রেলার চলছে। কাঠগড় থেকে পতেঙ্গা সব কনটেইনার ইয়ার্ড। তারা ডলারে চার্জ নেয়। আমাদের চার্জ দিতে হবে। বছরে দুই তিন হাজার কোটি টাকা আয় হবে। চসিক নিজে চলতে পারবে, আশেপাশের কয়েকটি পৌরসভাও চালাতে পারবে।’

সিটি করপোরেশনের আয়ের বড় খাত গৃহকর দেওয়া নিয়ে মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি এসে আপিল বোর্ড করলাম। স্পটে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করলাম। সবাইকে বললাম- মানুষের ওপর জোর খাটানো যাবে না। নিয়ম-নীতির মধ্যে আদায় করতে হবে। কিন্তু ওভার ট্যাক্সেশন করে আয় বাড়ানো যাবে না। নিয়মের মধ্যে যা দিতে চায় তা নিয়ে নেওয়াই ভালো। অটোমেশনে গেলে আয় বাড়তো। সবাই টাকা দিতে চায়, কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে দিতে চায় না। ঘরে বসে দেওয়ার সিস্টেম তৈরি করতে পারলে আয় বাড়বে।’

এক্ষেত্রে করপোরেশনের ভেতরের কিছু লোক বাধার পাঁচিল সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ খোরশেদ আলম সুজনের।

হঠাৎ প্রশাসক পদ গ্রহণের অনুরোধ পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে কেন যে ছয়মাসের জন্য দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমি জানি না। এর আগেও আমি সংসদ নির্বাচনে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়েছিলাম। তখন নানা কারণে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এবার ছয়মাসের জন্য দায়িত্ব দিয়েছে, আমি আমার চিন্তা-চেতনা দিয়ে, সাধ্যের সবটুকু দিয়ে দায়িত্ব পালন করেছি। সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পেরেছি, ততটুকু করেছি।’

প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২-৩টি কাজ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন বলে জানান খোরশেদ আলম সুজন। নগরীর পোর্ট কানেকটিং রোডের কাজে গতি আনাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রায় পৌনে ছয় কিলোমিটার সড়ক, বন্দরের কারণে এটাকে লাইফলাইন বলা যায়। কিন্তু নানা কারণে কাজটা থেমে ছিল। এটার জন্য অর্থ দিচ্ছে জাইকা। তারা টাকা নিয়ে বসে আছে কিন্তু ঠিকাদার কাজ করছে না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম, এখানে একটা অংশে কাজ করছে রানা বিল্ডার্স নামের একটা প্রতিষ্ঠান যেটা জি কে শামীমের পার্টনার। তার বাড়ি কুমিল্লা। সে কাজ না করে কুমিল্লা গিয়ে বসে আছে। আমি তাকে ধরে আনলাম। তাকে বললাম- কাজ না করলে চট্টগ্রাম থেকে যেতে দেব না।’

‘আরেকজন ঠিকাদার ছিল ইয়াকুব ব্রাদার্স। সেও কাজ না করে বসেছিল। তাকে বললাম- আপনার বাড়ি তো চট্টগ্রামে, আপনি কেন কাজ করছেন না। তিনি বললেন- টাকা নেই। উনাকে সিটি করপোরেশন থেকে অগ্রিম কিছু টাকা দিলাম। একটা ব্যাংক থেকে এক কোটি টাকা লোন নিয়ে দিলাম। জাইকার কথা হচ্ছে- তোমরা কাজ কর, টাকা নাও। কিন্তু যার পকেটে চার টাকা নেই, সে বসে আছে ৪০ কোটি টাকার কাজ নিয়ে।’

পোর্ট কানেকটিং রোডের কাজ শেষ করতে না পারার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অদক্ষ ঠিকাদারের কারণে পারিনি। এরপরও যতটুকু করেছি, মানুষ ১২ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে অলঙ্কার মোড় থেকে নিমতলা পর্যন্ত যেতে পারছে। তবে বর্ষার আগে যদি এই রাস্তার কাজ শেষ না হয় মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না।’

সারা শহরে ভাঙা রাস্তাঘাট ঠিক করা আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রাস্তাঘাট ঠিক করতে গিয়ে আমি অনেকের গালমন্দ শুনেছি, অনেকের প্রশংসাও পেয়েছি। রাস্তাঘাটের বিষয়টা খুবই সেনসিটিভ। অনেকে অসহিঞ্চু হয়ে পড়েন। কিন্তু রাস্তার কাজ তো আর পরোটা না যে, টুপ করে ভেজে খেয়ে ফেলব। সাধ্যমতো করার চেষ্টা করেছি।’

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের ২৯ মার্চ নির্ধারিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন স্থগিত হয়। সেসময়কার মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সরকার নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজনকে চসিকের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। ৬ আগস্ট তিনি দায়িত্বভার নেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি সুজনের ১৮০ দিনের দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হয়েছে। গত ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত চসিকের নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন