বিজ্ঞাপন

‘বঙ্গবন্ধুকে অ্যারেস্ট না করলে যুদ্ধ হতো না’

December 11, 2017 | 7:59 pm

আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: সময়টা ১৯৭১। তিন বন্ধু। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরির সুবাদে একজন থাকেন শিয়ালকোট, একজন খারিয়া, আরেকজন রাওয়ালপিন্ডি ক্যান্টনমেন্টে। হাজার কিলোমিটার দূর থেকেও তাঁরা বুঝতে পারছিলেন, প্রিয় স্বদেশ ভাল নেই। বড় বিপদে আছে প্রিয় মাতৃভূমি।

এরইমধ্যে খারিয়া ক্যান্টনমেন্টে থাকা বন্ধুটি একদিন জানতে পারলেন, পাশের রেলস্টেশনে দুইটি মেয়েকে ধরে আনা হয়েছে। তারা কাঁদছে। এগিয়ে গেলেন তিনি। গিয়ে দেখলেন, মেয়ে দুইটি বাঙালি! বুকের গভীরে প্রচণ্ড ধাক্কা খেলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি তরুণ সেনা অফিসার। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন— আর নয় এখানে।

কিন্তু ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হবেন কীভাবে? পাকিস্তানি সেনারা ঘুণাক্ষরেও যদি জানতে পারে, দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য একজন বাঙালি সেনা অফিসার বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাহলে আর রক্ষা নেই— নিশ্চিত প্রাণ হারাতে হবে!

বিজ্ঞাপন

হঠাৎ করে মনের মধ্যে এই আপ্তবাক্য খেলে গেল তাঁর—‘মরার জন্য যে প্রস্তুত, বাঁচার অধিকার তারই।’ রাওয়ালপিন্ডি ও শিয়ালকোট ক্যান্টনমেন্টে থাকা দুই বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন তিনি। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসবেন। দিন হিসেবে বেছে নিলেন পাকিস্তানের জাতীয় দিবস ১৪ আগস্ট। ওই দিনটি তাদের সরকারি ছুটি।

বলছিলাম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহান ওমর বীর উত্তমের কথা। বিজয়ের ৪৬তম বর্ষে সারাবাংলার সঙ্গে যুদ্ধ দিনের স্মৃতিচারণ করেন তিনি। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত এই বীর যোদ্ধা আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে অ্যারেস্ট না করলে যুদ্ধ হতো না।’

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে আসার পর মো. শাহজাহান ওমরকে ৯ নম্বর সেক্টরের টাকি সাব-সেক্টরের বরিশাল বেইজের অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি বরিশাল এলাকায় একের পর এক পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের দিশেহারা করেন। রাজাপুরের যুদ্ধে তিনি আহত হন।

মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মো. শাহজাহান ওমরকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৯।

মো. শাহজাহান ওমর বীর উত্তম স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে মেজর হিসেবে অবসর নেন। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের আইন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি আইন পেশার পাশাপাশি বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত।

সারাবাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মো. শাহজাহান ওমর বীর উত্তম বলেন, ‘আমরা মার্চের প্রথম সপ্তাহে বুঝতে পেরেছিলাম, পাকিস্তান আর্মি জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তান সেনা কর্মকর্তাদের কথা-বার্তা ও আচরণ থেকে বুঝতে পারতাম বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ চলছে। আমি ক্যাপ্টেন হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে খারিয়া ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলাম। একদিন শুনতে পেলাম রেলস্টেশনে দুইটি মেয়েকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি একটু উৎসুক হয়ে রেলস্টেশনে গেলাম। গিয়ে দেখি মেয়ে দুইটি কাঁদছে। কাঁদায় অনুভব করলাম তারা বাঙালি। আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, আর এ দেশে থাকা যাবে না।’

বিজ্ঞাপন

‘আমরা তিন বন্ধু— একজন রাওয়ালপিন্ডি, একজন খারিয়া ও একজন শিয়ালকোটে থাকতাম। পরমার্শ করে ১৪ আগস্ট আমরা শেয়ালকোটে মিলিত হই। ওই দিন রাতেই পাকিস্তানের বর্ডার জম্মু-কাশমিরের দিকে রওনা হলাম। চারদিকে যুদ্ধাবস্থা। একদিকে পাকিস্তান আর্মি, একদিকে ইন্ডিয়ান আর্মি। এদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অসংখ্য নালা, ধানক্ষেত, আখক্ষেত অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু আমরা জানতাম না, ভারতে পৌছে গেছি। হঠাৎ দেখলাম, একটা সিগারেটের প্যাকেট। ওটায় লেখা রেড ল্যাম্প, মেইড ইন ইন্ডিয়া। তখন ভাবলাম, ইন্ডিয়া এসে গেছি। কিন্তু আমরা কনফার্ম ছিলাম না। খুব ভোরে একটা আখ ক্ষেতে পালালাম, দেখলাম একজন শিখ বের হচ্ছে। তখন বুঝলাম, আমরা ভারতে চলে এসেছি, বর্ডার ক্রোস করেছি। জায়গাটার নাম জাফরওয়ালা—পাকিস্তান বর্ডার। আর ইন্ডিয়া বর্ডারের নাম রামপুরা— জম্মু কাশ্মীরের মধ্যে পড়েছে। ওখান থেকে পরের দিন ভোরে জন্মু প্রশাসন আমাদেরকে নিয়ে গেল জম্মু হেডকোয়ার্টারে।’

পাকিস্তান বর্ডার ক্রোস করে ভারতের ভূ-খণ্ডে নিজেদের আবিষ্কারের পর  অনেকটা হাফ ছেড়ে বাঁচলেন মো. শাহজাহান ওমর। তাঁর বর্ণনায়, ‘ আমরা ইউনিফর্মড ছিলাম না। আমাদের ছিল এক প্যান্ট, এক শার্ট। অস্ত্র বলে কিছু ছিল না। আমরা রিস্ক নিয়েছি। পথে দেখতাম লোকজন শুয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলে বলতাম, খামোশ ফৌজি! তখন ওরা থেমে যেত। ভাগ্য ভাল আমরা চলে আসতে পেরেছি। ওই সময় যে চেতনা আমাদের মধ্যে ছিল—ধরা পড়ার ভয় খুব একটা আসেনি। ধরা তো পড়তেই পাড়ি। যুদ্ধে শহীদ হতে পারি, আহত হতে পারি, বন্দি হতে পারি। এই রিস্ক যুদ্ধক্ষেত্রে আছে। এটা মেনে নিয়েই তো আমাদের অগ্রসর হতে হবে। ‘

তিনি বলেন, ‘জম্মু-কাশ্মীর হেডকোয়ার্টার থেকে আমাদেরকে পরের দিন নিয়ে আসা হলো পাঠানপুর। সেখানে থেকে ট্রেনে দিল্লি। দিল্লিতে একদিন থাকার পর আমাদেরকে প্লেনে নিয়ে আসা হলো কোলকাতা। কোলকাতা থিয়েটার রোডে মুক্তিযুদ্ধের হেড কোয়ার্টারে জেনারেল মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর সঙ্গে দেখা করলাম। আমাকে বদলি করা হলো ৯ নম্বর সেক্টরে।’

পাকিস্তানি ইউনিফর্ডম আর্মির বিরুদ্ধে লুঙ্গি-গামছা পরেই যুদ্ধ করতে হতো দেশপ্রেমী মুক্তিযোদ্ধাদের। ছেড়া লুঙ্গি-গেঞ্জি-গামছাই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ইউনিফর্ম। মো. শাহজাহান ওমর বীর উত্তম বলেন, ‘দেশে যারা রিটায়ার্ড পুলিশ, বিডিয়ার, আনসার ছিলেন অথবা পাকিস্তান আর্মি থেকে পালিয়ে এসেছেন, তাদেরকে নিয়ে বিশাল বাহিনী গড়ে তুললাম। বৃহত্তর বরিশালের ৩২টি উপজেলায় ৩৮টি বাহিনী ছিল আমার। প্রাথমিক পর্যায়ে আমার সৈন্যসংখ্যা কম ছিল। কিন্তু নভেম্বর পযর্ন্ত আমার সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ায় ২০/২২ হাজার। এদের মধ্যে সেনাবাহিনী ছিল ২ হাজারের মতো। বাকি সবাই মুক্তিযোদ্ধা— যুবক, শ্রমিক, ছাত্র। একজন সেনাকর্মকর্তা হয়েও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে লুঙ্গি-গামছা পরে যুদ্ধ করেছি। আমাদের মধ্যে কোনো ভেদা-ভেদ ছিল না। সবাই আমার কমান্ড মেনে চলত।’

যাদের কাছ থেকে অস্ত্র চালানোর শিক্ষা নিয়েছেন, সেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ! সহযোদ্ধা হিসেবে যাদের পেয়েছিলেন, তাদের ৯০ ভাগই সাধারণ যুবক, শ্রমিক, ছাত্র। এদের কেউ জীবনে অস্ত্র হাতে নেননি। তারপরও পরাশক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের মন্ত্র কোথা থেকে পেলেন মো. শাহজাহান ওমর?

‘আমি যুদ্ধ করেছি মেজর নাদের পারভেজের বিরুদ্ধে। মিলিটারি একাডেমিতে তিনি আমার প্রশিক্ষক ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষ! নাদের পারভেজ একদিকে, আমি আরেক দিকে—গুরু-শিষ্য’র যুদ্ধ! তারপরও আমরা জিতেছি। কারণ, আমাদের ছিল স্বাধীনতার চেতনা। ওদের সেটা ছিল না। তাছাড়া দেড় হাজার কিলোমিটার দূর থেকে এসে অন্য একটা দেশ বেশি দিন দখল করে রাখা যায় না। আমেরিকা এত শক্তিশালী, ভিয়েতনাম দখল করতে পেরেছে? সুতরাং আমরা বুঝতে পেরেছিলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। আজ না হোক, কাল। ইন্ডিয়ান আর্মি যদি আমাদের সাথে না আসত, তারপরও আমরা স্বাধীন হতাম, কিন্তু সময় লাগত।’

মো. শাহজাহান ওমর বীর উত্তম বলেন,  ‘ওরা (পাকিস্তান) যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করত, তাহলে যুদ্ধ হতো না। ওরা যদি ২৫ মার্চ রাতে ধ্বংসযজ্ঞ না চালাত, তাহলে যুদ্ধ হতো না। বে-পরোয়াভাবে, যুবক-ছাত্র-শ্রমিকদের হত্যা না করত বা ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে যদি ওভাবে অ্যারেস্ট না করত, তাহলে যুদ্ধ হতো না। পাকিস্তান হওয়ার পর একাত্তর পযর্ন্ত যেভাবে চলছিল, সেভাবেই চলতে থাকত।’

যে যুদ্ধের জন্য মো. শাহজাহান ওমরকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়, সেই যুদ্ধের স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন- ‘১২ নভেম্বর ১৯৭১। রাতে একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নৌকাযোগে রওনা হই চাচৈরের উদ্দেশে। এর অবস্থান ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায়। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি উপদলে বিভক্ত ছিল। আমি তাঁদের সার্বিক নেতৃত্বে। ভোরে সবার আগে কয়েকজন সহযোদ্ধাসহ আমি পৌঁছে যাই চাচৈরের কাছে। পৌঁছেই খবর পাই, ওই এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এসেছে। তারা কয়েকটি বাড়িতে আগুন দিয়ে আশপাশে অবস্থান নিয়েছে।’

‘মুক্তিযোদ্ধাদের দলগুলো তখনো সেখানে এসে পৌঁছায়নি। তার পরও আমি সিদ্ধান্ত নিই, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করার। তখন  আমার দলের কাছে একটি মাত্র এসএলআর,  দুই ইঞ্চি একটি মর্টার ও একটি ২২ বোর রাইফেল ছাড়া আর কোনো অস্ত্র ছিল না। এর মধ্যে দুটি উপদল এসে আমার সঙ্গে যোগ দেয়।’

‘একটি দলকে আমি পাঠাই চাচৈর স্কুলে, অপর দলকে সঙ্গে নিয়ে প্রধান সড়কে আমি অবস্থান নিই। সকাল আনুমানিক নয়টায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল ক্যাপ্টেন আজমত এলাহীর নেতৃত্বে স্কুলে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ চালান। পাকিস্তানি সেনারা ওই দলকে পাল্টা আক্রমণের পর ধাওয়া করে প্রধান সড়কে আসে।’

‘আমি সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। গর্জে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা সবার অস্ত্র। থেমে থেমে সারা দিন ধরে যুদ্ধ চলে। মুক্তিযোদ্ধারা আমার নেতৃত্বে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করেন। সন্ধ্যার পর পাকিস্তানি সেনারা বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার হয়ে পিছু হটে যায়। কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে একজন শহীদ ও দুই তিনজন আহত হন।’

‘পরদিন ১৪ নভেম্বর সকালে বরিশাল ও ঝালকাঠি থেকে নতুন সেনা এসে যোগ দেয় চাচৈরে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আগের দলের সঙ্গে। আমি এতে বিচলিত হইনি, মনোবলও হারাইনি। সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে আমি পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ করি। আমাকে দেখে উজ্জীবিত হন অন্য সব সহযোদ্ধা।’

‘আমি অগ্রভাগে থেকে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেই। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা বিপুল শক্তি নিয়েও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ১৪ নভেম্বরও সারা দিন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। অনেক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। শেষের দিকে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটতে থাকে। খাল পার হতে গিয়ে আরও কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রাণ হারায়।’

‘সন্ধ্যার পর রাতের আঁধারে পাকিস্তানি সেনারা একেবারে পালিয়ে যায়। কয়েকজন মূল দলের সঙ্গে পালাতে না পেরে লুকিয়ে ছিল একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের খুঁজে বের করার পর আটক করে। এই যুদ্ধের সংবাদ তখন আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়।’

সারাবাংলা/এজেড/

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন