বিজ্ঞাপন

বন্ধ হোক পর্নহাব।। শেষ পর্ব

February 28, 2021 | 2:56 pm

রেহমান মোস্তাফিজ

তৃতীয় পর্বের পর (পর্নহাবের কন্যারা  )

বিজ্ঞাপন

৫.
কোন ভিডিও একবার ইন্টারনেটে আপলোড হয়ে গেলে সেটি যেন চিরস্থায়ী হয়ে যায়। একটি সাইট থেকে ডিলিট দিলেও অন্য সাইটে আবারও আপলোড হতে থাকে। আর এই সমস্যাটিই ভোগাচ্ছে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য নারীকে। নিকোল নামের এক ব্রিটিশ নারী আমাকে বলে ‘এটা সবসময়ই অনলাইনে থাকবে’। তার নগ্ন ভিডিও পর্নহাবে প্রকাশের পর অভিযোগ করা হলে সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু পরে বারবারই তা পুনরায় প্রকাশ হচ্ছে। ‘আমার সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে ভবিষ্যতে আমার বাচ্চাকাচ্চা আর তারা মায়ের এই ভিডিওটি দেখে ফেলে যদি’, হতাশা ঝরে পড়ে নিকোলের কণ্ঠে।

এসব ঘটনায় আক্রান্ত প্রত্যেকের কথাই যেন একই রকম। শারীরিক নির্যাতন তো একসময় শেষ হয়ে যায়, কিন্তু পর্নহাব দুর্ভোগটাকে মানসিক করতে থাকে প্রতিদিন।

নিকোলের নগ্ন দেহের ভিডিওটি তার ১৫ বছর বয়েসে পর্নহাবে ছড়িয়েছিলো। আজ সে ১৯ বছরের যুবতী। গত দুই বছর ধরে সে ভিডিওটি পর্নহাব থেকে চিরতরে মুছে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

‘আমার ১৫ বছর বয়সের এক ভিডিও যা কিনা আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে আদায় করা তাও আবার যা কিনা শিশুদের পর্ন সেটা কেন বারবার প্রকাশ করা হবে?’ নিকোল গতবছর পর্নহাবের কাছে পাঠানো এক মেসেজে প্রকাশ্য প্রতিবাদ করেছিলো, ‘তোমাদের উচিৎ তোমাদের সিস্টেমকে আরও ভালো করে তোলা…. আমি প্রতিবারই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি, যখন তোমাদের ওয়েবসাইটে আমার ভিডিওটি নতুন করে প্রকাশ পেতে দেখেছি।’

নিকোলের আইনজীবী দানি পিন্টার বলেছে এখনো পর্নহাবে নিকোলের ১৫ এবং ১৬ বছর বয়েসের অন্তত তিনটি ভিডিও রয়েছে যা তারা সেখান থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

নিকোল বলছিলো ‘এটি যেন কখনোই শেষ হবার না। আর তারা আমাদের এই মানসিক আঘাতগুলো দিয়েই প্রচুর টাকা কামিয়ে নিচ্ছে।’

বিজ্ঞাপন

পর্নহাব একটি নতুন সফটওয়্যার চালু করেছিলো যার কথা ছিলো যেকোন ধর্ষণ ভিডিও প্রকাশ রোধে কাজ করবে। কিন্তু ‘ভাইস’ দেখিয়েছে এই পদ্ধতি কত সহজে ভেঙ্গে ফেলা যায় আর ধর্ষণের ভিডিও পর্নহাবে প্রকাশ করা যায়।

গার্ল ডু পর্ন প্রযোজনা সংস্থার সাথে পর্নহাবও একই কেলেঙ্কারিতে জড়িত। এসব ওয়েবসাইটে যুবতী মেয়েদের সাথে মডেলিংয়ের জন্য যোগাযোগ করা হয় এবং পরবর্তীতে তাদের পর্নের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাদের বলা হয় এগুলো বিদেশে শুধুমাত্র ডিভিডিতেই প্রকাশ হবে এবং কেউই জানবে না এগুলোর কথা। কিছু মেয়ে তাতে রাজিও হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে পর্নহাব এগুলোর আগ্রাসী বিজ্ঞাপন করে পর্নহাবে ছড়িয়ে দেয়।

গার্লস ডু পর্ন এর বিরুদ্ধে যৌন পাচারের অভিযোগে মামলা হয় এবং তাদের কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু পর্নহাবে সেগুলো বারবারই প্রকাশ পেতে থাকে। শেষবার যখন আমি খুঁজেছি, তখন দেখেছি গার্লস ডু পর্ণের শিকার অন্তত ছয় নারীর ভিডিও এখনো সেখানে আছে এবং সেসব ভিডিও থেকে তারা এখনও অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে।

গার্লস ডু পর্ন ওয়েবসাইটের শিকার নারীদের একজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। মাত্র ২০ বছর বয়সে তাকে হত্যা করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে তার কোন এক ক্রুদ্ধ প্রাক্তন প্রেমিকই তাকে হত্যা করেছে। আসামী এখন বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। আমি মেয়েটির নাম এখানে বলছি না কারণ আমি চাই মেয়েটিকে স্মরণ করা হোক একজন প্রানবন্ত অ্যাথলেট হিসেবে, এমন কোন যৌন ভিডিওর জন্য নয় যা তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক অধ্যায় হয়ে আছে।

বিজ্ঞাপন

৬. 
তাহলে সমাধান কি?
আমি আশা করছি পর্নহাবকে বন্ধ করে হবে এবং তার কর্মকর্তাদের জেলে পোরা হবে। আমার মতো অনেকেই এমনটা চেয়েছে। আবার অনেকেই বিচার চাইতে চাইতে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়েছে। ২০ বছর বয়সী লিডিয়া শিশুকালে পাচার হয়েছিলো। তার অনেকগুলো ধর্ষণের ভিডিও রয়েছে পর্নহাবে। ‘আমার এখনো সেকথা মনে করে চিন্তায় পেটে ব্যথা হতে থাকে’ লিডিয়া আমাকে বলেছিলো। কিন্তু সে একথাও বলেছে যে, সে চায় না এর কারণে পর্নকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হোক।

সুসান পাডরন আমাকে বলেছে ১৫ বছর বয়েসে তার বয়ফ্রেন্ড যখন তাদের গোপন ভিডিও ধারন করে পর্নহাবে ছড়িয়ে দেয় তার আগ পর্যন্ত তার ধারনা ছিলো পর্নগ্রাফি সকলের সম্মতিতে হয়ে থাকে৷ সেই থেকে তার লড়াই শুরু। তার মতে স্বেচ্ছায় পর্নে অভিনয় করে শুধুমাত্র সেসব ভিডিওই প্রকাশ করা উচিৎ।

ছটবেলায় পাচারের শিকার জেসিকা শোমওয়ের এক কাস্টোমার তার ভিডিও পর্নহাবে ছড়িয়ে দেয়। জেসিকার মতে, ‘আমাদের এমন ব্যবস্থা ভেবে বের করতে হবে যাতে ভিডিওগুলোতে কে অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক তা খুঁজে বের করে বন্ধ করতে হবে এবং ভিডিওতে যারা আছে প্রত্যেকের সম্মতি আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে।’

১৮ বছরের লিওর ১৪ বছর বয়সের ভিডিও রয়েছে পর্নহাবে। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে কি বলতে চায় এই বিষয়ে। লিওর মতে, ‘এ বিষয়ে কিছু বলা অনেক কঠিন। আমার মতে পর্নকে পেশাদার পর্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। কারণ তাদের সাথে কাজ করতে প্রাপ্তবয়স্ক হতে হয় এবং সম্মতির প্রয়োজন হয়।’

বর্তমানে প্রযোজনা কোম্পানিগুলো এধরনের প্রতিষ্ঠানের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না যারা কিনা একদমই বিনামূল্যে পর্ন দেখতে দিচ্ছে। যেমন পর্নহাব এবং এক্সভিডিওজ।

পর্নস্টার এবং লেখক স্টয়া বলছিলো, ‘পর্নহাব ইতোমধ্যেই ব্যবসার মডেল ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে’। সেও মনে করে ইউটিউব থেকে পর্নহাব সকল প্লাটফর্মেরই ব্যাক্তিগত ভিডিও প্রকাশের পূর্বে প্রমাণস্বরূপ সম্মতিপত্র চাওয়া উচিৎ।’

‘যদি পর্নহাব ভিডিওগুলিকে আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, তবে সবচেয়ে আপত্তিজনক ভিডিওগুলো কেবল ডার্ক ওয়েব বা নিয়ন্ত্রণ কম এমন দেশগুলোর ওয়েবসাইটগুলিতে চলে যেতে পারে। তবুও অন্ততপক্ষে এগুলো মূলধারার সাইটে তখন আর এখনকার মত অতি সাধারণভাবে দেখা যাবে না।’

‘আরও বেশি চাপ প্রয়োগ এবং প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস হয়তো সাহায্য করবে। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি যে, ধারা ২৩০-এ প্রতিরোধ ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করার ফলে তারা কিছুটা শোধরানোর চেষ্টা করছে।’

‘আমি ভেবে পাই না কেন সার্চ ইঞ্জিন, ব্যাংক বা ক্রেডিট কার্ড সংস্থাগুলো এমন এক প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করে যারা শিশু নির্যাতন অথবা অজ্ঞান নারীদের সুযোগ নেওয়ার মাধ্যমে লাভবান হয়। যদি পেপাল পর্নহাবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে তাহলে আমেরিকান এক্সপ্রেস, মাস্টারকার্ড এবং ভিসাও পারে,’ বলেন স্টয়া।

পর্নহাবসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নারী ও শিশুদের অপব্যাবহারের কোন পরিষ্কার সমাধান দেখতে পাচ্ছি না। তবে তাদের রেহাই দেওয়ার উপায়গুলো সীমাবদ্ধ করতে হবে যাতে সংস্থাগুলি সতর্ক হয়। এখানে তিনটি পদক্ষেপ রয়েছে যা একাজে সহায়তা করবে- ১. কেবলমাত্র যাচাই করা ব্যবহারকারীদের ভিডিও পোস্ট করার অনুমতি দিন ২. ডাউনলোড নিষিদ্ধ করা হোক ৩. বাড়াতে হবে সংযম।

এই তিনটি পদক্ষেপ পর্ন পুরোপুরি বন্ধ করবে না আবার এর গ্রাহকদেরও তেমন বিরক্ত করবে না। ইউটিউব ডাউনলোড ছাড়াই বাজারে টিকে আছে। সিরি ঢাল বলে এক উঠতি পর্ন তারকা যে নিজেই পর্নহাবের সাথে ব্যবসায় জড়িত সে আমাকে বলেছে আমার এই প্রস্তাবগুলো খুবই যুক্তিসঙ্গত।

শিশুদের যৌন নির্যাতনের বিষয়ে ক্যাথলিক চার্চ থেকে শুরু করে বয়েস স্কাউট বরাবরই চুপ। খুব দেরিতে, আমরা জেফরি অ্যাপস্টাইন বা আর কেলির মতো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করি তবে আমাদের এমন সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে যারা নিয়মিতভাবে শিশুদের শোষণ করে যাচ্ছে। পর্নহাবকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো গেলে আমরা জেফরি অ্যাপস্টেনের চেয়ে ১০০০ গুণ বড় কোন অপরাধীকে পেয়ে যাবো।

প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম বিভিন্ন পর্নওয়েবসাইট। এগুলোর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতাকে উসকে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ আছে। এমনই একটি ওয়েবসাইট পর্নহাব। সম্প্রতি পর্নহাবের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে বরং একে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পর্নহাব নিজে নারী বা শিশু নির্যাতনে অংশ নিচ্ছে তা নয়, কিন্তু এটি একটি মুক্ত প্লাটফর্ম হওয়ায় এখানে যেকোন ব্যবহারকারী ইচ্ছামতো ভিডিও আপলোড দিতে পারেন। আবার সেসব ভিডিও সহজেই ডাউনলোড দিয়ে ব্যক্তিগত সংগ্রহেও রাখা যায়।

এই সুযোগে অনেকেই শিশু, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অবৈধ উপায়ে সংগৃহীত ভিডিও আপলোড দেন পর্নহাবে। ভুক্তোভোগীরা অভিযোগ করে বা আইনের আশ্রয় নিলেও সঠিক বিচার পাচ্ছেন না। এবং আইনের ঘোরপ্যাঁচে শাস্তির আওতায় আসে না অন্যতম বড় এই পর্ন ওয়েবসাইট। শাস্তি তো দূরের কথা এসব ভিডিওর মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে তারা। এবিষয়েই সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসে নিকোলাস ক্রিস্টোফের মতামত কলাম ছাপা হয়েছে। সারাবাংলার জন্য সেটি অনুবাদ করেছেন রেহমান মোস্তাফিজ। 

সারাবাংলা/আরএফ

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন