বিজ্ঞাপন

বাংলা সাহিত্যে নারীর অবদান

March 8, 2021 | 3:31 pm

শাহীনূর সরকার

নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বাংলা সাহিত্যে বড় একটা জায়গা দখলে নিয়েছেন নারী লেখকরা। মূলত আঠারো শতকের মাঝামাঝি থেকেই সাহিত্যে নারীদের উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু ‍করে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম ও পিছিয়ে পড়া  নারী সমাজকে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসতে রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। এমন কয়েকজন নারী সাহিত্যিক নিয়েই সারাবাংলার এই আয়োজন।

বিজ্ঞাপন

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
বাঙালি নারী জাগরণের পথিকৃত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। একাধারে প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক বেগম রোকেয়া নানান প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কার থেকে মুসলিম নারী সমাজকে আলোর পথ দেখিয়েছিলেন। ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামক বাংলা গদ্য দিয়ে তার সাহিত্য জীবন শুরু। তার রচিত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়। তার লেখনীতে একদিকে যেমন বিজ্ঞান সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসার পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যদিকে নারী সমাজের পশ্চাৎপদতার নানা কারণ উল্লেখ করে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস হিসেবে পালন করে বাংলাদেশ সরকার। দেওয়া হয় বেগম রোকেয়া পদক। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপে ষষ্ঠ স্থান পেয়েছিলেন বেগম রোকেয়া।

বেগম সুফিয়া কামাল
দেশে নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ও প্রথিতযশা কবি সুফিয়া কামাল। পারিবারিক প্রচণ্ড রক্ষণশীলতার মধ্যে বড় হয়েও তিনি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা নারী নির্যাতন ও অপমানের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়েছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। সেই প্রকাশ ছিল তার লেখনী ও কর্মে। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ— দেশের প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং ‘জননী সাহসিকা’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের শরিক হয়েছেন, কারফিউ উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেছেন। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন তিনি।দেশভাগের সময় নারীদের জন্য প্রকাশিত সাময়িকী ‘বেগম পত্রিকা’র সম্পাদক ছিলেন।

নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক দেশ ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এবং গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে একসূত্রে গ্রথিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিলগ্নে ১৯৭০ সনের ৪ এপ্রিল সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সে সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের ছাত্রী তরুণীদের এক অংশ এবং দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ সচেতন নারী সমাজের উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমের অঙ্গীকার নিয়ে গঠিত হয় আন্দোলনমুখী, জাতীয়ভিত্তিক, অরাজনৈতিক এই স্বেচ্ছাসেবী গণ নারী সংগঠন। এছাড়াও ছায়ানট, কচি-কাঁচার মেলাসহ বিভিন্ন সংগঠনের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন কবি সুফিয়া কামাল।

বিজ্ঞাপন

জাহানারা ইমাম
শহীদ জননী হিসেবে খ্যাত মহিয়সী এই নারী একজন কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী। শিশু ও কিশোরদের জন্য রচনা দিয়ে ষাট ও সত্তরের দশকে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তবে তার অনবদ্য গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলো’ অনেক বেশি খ্যাতি এনে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের শিহরণ জাগানো আর আবেগাপ্লুত ঘটনা উঠে এসেছে সেই গ্রন্থে। একাত্তরে তার বড় ছেলে শাফী ইমাম রুমী কয়েকটি সফল গেরিলা অপারেশনের পর গ্রেফতার হন ও পরে পাকিস্তানিদের নির্যাতনে মারা যান। সে কারণেই তাকে শহীদ জননীর মর্যাদায় ভূষিত করা হয়।

নীলিমা ইব্রাহিম
বাঙালি নারী জাগরণের আরেক পথিকৃত নীলিমা ইব্রাহিম। মেধাবী এ্ই নারী প্রথম বাঙালি যিনি নারী হিসেবে বাংলায় ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী। তার রচিত উপন্যাস-বিশ শতকের মেয়ে, এক পথ দুই বাক, কেয়াবন সঞ্চারিনী  ও বহ্নিবলয়। এছাড়াও রয়েছে নাটক ও প্রবন্ধ। ‘আমি বীরঙ্গনা বলছি’ তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ।  পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, জয় বাংলা পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার, বেগম রোকেয়া পদকসহ আরও কিছু সাহিত্য পদক ।

সেলিনা হোসেন
বাংলা সাহিত্যে একটি অনন্য নাম সেলিনা হোসেন। শুধুমাত্র বাংলা নয়, নিজস্ব লেখনীর মাধ্যমে সেলিনা হোসেন হয়ে উঠেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কথাসাহিত্যিক। এ পর্যন্ত তিনি ৪৩ টি উপন্যাস, ১৬ টি গল্পগ্রন্থ, ১০ টি প্রবন্ধ আর শিশু সাহিত্য লিখেছেন ৩৫ টি। তার লেখা ১১ টি গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস ইংরেজি, ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় তার গল্প-উপন্যাস অনুবাদের কাজ চলছে। সেলিনা হোসেন তার লেখায় রাজনৈতিক সংকট ও দ্বন্দ্বের ‍উৎস ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন।  মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তার প্রথম উপন্যাস  ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই উপন্যাসে মুগ্ধ হয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। পরে বাংলাদেশে সেটি নির্মাণ করেছিলেন চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম।

বিজ্ঞাপন

রাবেয়া খাতুন
আধুনিক সাহিত্যের গঠন যুগের অগ্রবর্তী লেখক, কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন। উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথাসহ চলচ্চিত্র, নাট্য জগত, সাহিত্যের সকল শাখায় সফল বিচরণ ছিল তার। রাবেয়া খাতুনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘মেঘের পরে মেঘ’ জনপ্রিয় একটি চলচ্চিত্র। ‘মধুমতি’ এবং ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ ও প্রশংসিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি, চলচ্চিত্র জুরি বোর্ড, লেডিস ক্লাব, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, মহিলা সমিতিসহ অসংখ্য সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন রাবেয়া খাতুন। রাবেয়া খাতুনের প্রথম উপন্যাস ‘মধুমতী’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। ক্ষয়িষ্ণু তাঁতী সম্প্রদায়ের জীবন সংকট ও উঠতি মধ্যবিত্ত জীবনের অস্তিত্ব জিজ্ঞাসার সেই উপন্যাসেই কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। সাহিত্যচর্চার জন্য একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

আনোয়ারা সৈয়দ হক
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকের প্রথম ছোটগল্প ‘পরিবর্তন’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। তার সাহিত্যের ভান্ডারে রয়েছে ১১ টি ছোটগল্প, ৩০ টিরও বেশি উপন্যাস। এছাড়াও লিখেছেন কাব্যগ্রন্থ ও প্রবন্ধ। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি তার লেখনীতে মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন। বাংলা অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদকসহ নানা সম্মাননা।

তসলিমা নাসরিন
আশির দশকে একজন উদীয়মান কবি হিসেবে সাহিত্যজগতে তসলিমা নাসরিনের পদচারণা। নারীবাদী ও ধর্মীয় সমালোচনামূলক রচনার কারণে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন। তিনি তার রচনা ও ভাষণের মাধ্যমে লিঙ্গসমতা, মুক্তচিন্তা, নাস্তিক্যবাদ এবং ধর্মবিরোধী মতবাদ প্রচার করায় ইসলামপন্থীদের রোষানলে পড়েন ও তাদের নিকট হতে হত্যার হুমকি পাওয়া শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করতে বাধ্য হন।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসএসএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন