বিজ্ঞাপন

‘চাঁদাবাজি’ করছে সাতগাঁও হাইওয়ে পুলিশ, অভিযোগ চালকদের

March 9, 2021 | 8:43 am

হৃদয় দেবনাথ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট 

মৌলভীবাজার: শ্রীমঙ্গল সাতগাঁও হাইওয়ে পুলিশের ওসি নবীর হোসেনের নেতৃত্বে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সাতগাঁও হাইওয়ে পুলিশের কয়েক সদস্য। রাতের বেলা পণ্যবাহী ট্রাক আটকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। অবৈধ টমটম ও ব্যাটারিচালিত রিকশা আটক করে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রফাদফা করেন বলে অভিযোগ করেন চালকরা।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া রাতের বেলায় শ্রীমঙ্গল প্রবেশ পথের লছনা এলাকায় বিভিন্ন যানবাহন আটক করে চাঁদা আদায় করছেন তারা। তবে অভিযোগ রয়েছে, সাতগাঁও লছনা বাজার এলাকায় হোটেল মালিক কমলার মধ্যস্ততায় খুব কৌশলে টাকার বিনিময়ে রাতের বেলায় রফাদফা করে আটককৃত গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই হোটেল মালিকই হাইওয়ে ওসির বিশ্বস্ত দালাল বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে।

অভিযোগ উঠেছে, সাতগাঁও হাইওয়ে পুলিশের ওসি নবীর হোসেন যোগদান করার পর থেকেই হয়রানি আর চাঁদাবাজিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে সাতগাঁও হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা। জানা যায়, সাতগাঁও হাইওয়ে পুলিশের ওসি নবীর হোসেনের ডান হাত হিসেবে কাজ করেন থানার সাব-ইন্সপেক্টর কবির হোসেন।ওসি নবীর হোসেনের নির্দেশেই চাঁদাবাজিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন হাইওয়ে পুলিশের এ সদস্য।

সেলিম হোসেন নামে এক ব্যাবসায়ী বলেন, শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন পয়েন্টে আসতে একটি পণ্যবাহী ট্রাক ৯ থেকে ১০ বার হাইওয়ে পুলিশের তল্লাশির মুখে পড়তে হয়। কোনো ধরনের কারণ ছাড়াই তারা গাড়ি থামিয়ে অবান্তর প্রশ্ন করেন। আবার হাইওয়ে পুলিশের দাবি করা টাকা দিয়ে দিলে কোনো কাগজপত্র না থাকলেও গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া রাতের বেলা ট্রাক থামিয়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলে। ট্রাক ড্রাইভার করিম বলেন, আমি প্রতি সপ্তাহে শ্রীমঙ্গলে মাল নিয়ে আসি আবার ফিরতি পথে লেবু আর অন্যান্য মালামাল নিয়ে যাই ঢাকায়। কিন্তু সাতগাঁও হাইওয়ে পুলিশের হয়রানিতে অতিষ্ঠ আমার মতো আরও হাজারো ট্রাক ড্রাইভার।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ওসি নবীর হোসেনের নেতৃত্বে দিন ছাড়াও রাতের বেলায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে সাতগাঁও হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা। হাইওয়ে সড়কে চলাচলের জন্য তাদের দেওয়া কুপন নিয়ে মাসোহারা দিয়েই চলতে হয়। আর যাদের কাছে এই গোপন কুপন থাকে না তাদেরকে আটক করে আড়াই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। একইসঙ্গে পরবর্তী মাস থেকে কুপন নিয়ে চলার নির্দেশনাও দেওয়া হয়। এজন্য হাইওয়ে সড়কে প্রকাশ্যেই চলছে অবৈধ টমটম ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। হাইওয়ে সড়কে এসব অবৈধ যানবাহনের বেপরোয়া চলাচলের কারণে সম্প্রতি সাতগাঁওয়ে এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান পাঁচজন।

বিজ্ঞাপন

সচেতন মহল এসব সড়ক দুর্ঘটনার জন্য পুলিশের ব্যাপক চাঁদাবাজিকেই দায়ী করছেন। কারণ হিসাবে তারা বলছেন, অবৈধ এসব যানবাহন চলাচল বন্ধ হলে পুলিশের অবৈধ বাণিজ্য কমে যাবে।

ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে আসা প্রাইভেটকার চালক আলমাস মিয়া জানান, আমি আমার স্যারের পরিবার নিয়ে শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে এসেছি। কিন্তু চা কন্যার ভাস্কর্যের সামনেই এসেই আমি হাইওয়ে পুলিশের খপ্পরে পড়েছি। সব কাগজ ঠিক থাকা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে তাদের এক হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে।

শ্রীমঙ্গল প্রবেশ করতে চা কন্যার ভাস্কর্যের পাশে, বটেরতল, মতিগঞ্জ ব্রিজের পাশে ও বিলাসের পারসহ প্রায় ১৪টি পয়েন্টে হাইওয়ে পুলিশের মুখোমুখি হতে হচ্ছে পরিবহন শ্রমিকদের। এই সুযোগে কারণে-অকারণে গাড়ি থামিয়ে মামলা দেওয়ার ভয় দেখিয়ে চালকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন তারা। আর টাকা দিলে সব ঝামেলা নিমিষেই চুকে যায় বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেন্ট্রাল রোডের এক পাইকারি ব্যবসায়ী জানান, ঢাকা থেকে প্রায় এক দুই দিন পর পরই তার বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী ট্রাকে করে নিয়ে আসেন চালকরা। কিন্তু পথিমধ্যেই হাইওয়ে পুলিশের হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, গাড়ি আটক করলেই তাদের টাকা দিয়ে আসতে হয়। অন্যথায় এই মামলা, সেই মামলা দেওয়ার কথা বলে হয়রানি করেন।

চুনারুঘাটের এক পাইকারি ব্যাবসায়ী অঞ্জন দত্ত বলেন, ব্যবসার মালামালের জন্য প্রতি সপ্তাহে এক দুইবার শ্রীমঙ্গলে যেতে হয়। মাল নিতে ট্রাক অথবা পিকআপে করে যাওয়ার পথেই গাড়ি আটক করে হাইওয়ে পুলিশ। আর ঝামেলা এড়াতে আমরাও বাধ্য হয়ে তাদের দাবিকৃত টাকা দেই। অন্যথায় বিভিন্ন মামলার ভয় দেখান তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাতগাঁও লছনা বাজারের এক ব্যাবসায়ী জানান, হাইওয়ে পুলিশের চাঁদাবাজির অন্যতম সিন্ডিকেটের হোতা লছনা বাজারের চা স্টল মালিক কমলা। গাড়ি আটক করে প্রায়ই দরদামের দায়িত্ব থাকে হাইওয়ে পুলিশের দালালখ্যাত এই কমলার। তাকে দিয়েই স্থানীয় বিষয়গুলো রফাদফা করা হয় বলে নিশ্চিত করেন এ ব্যাবসায়ী।

তবে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য লছনা বাজারে গেলে প্রতিবেদকের যাওয়ার খবর শুনেই পালিয়ে যান কমলা। এদিকে স্থানীয় চালকদের অভিযোগ সড়কে নানা অজুহাতে প্রতিদিনই হাইওয়ে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর কবির টাকা আদায় করে। না দিলে চালদের ভয়ভীতি দেখানো হয়।

সাতগাঁও এলাকার স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাইওয়ে পুলিশের এ চাঁদাবাজি নিত্যদিনের। শুধু দিনে নয়, রাতভর চাঁদা নিতে তৎপর এই হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা। প্রতিটি ট্রাক থেকে ন্যূনতম ১০০ থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা বা তারও বেশি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। এদিকে গত মঙ্গলবার রাতে লছনা বাজারের কিছুটা দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যানবাহন থামিয়ে হাইওয়ে পুলিশকে টাকা আদায় করতে দেখা গেছে। ওই দিন রাত আড়াইটার দিকে একটি পণ্যবাহী ট্রাক থামিয়ে চাঁদা আদায় করতে দেখেছেন স্থানীয় এক ব্যাবসায়ী।

স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, শ্রীমঙ্গল সিলেট বিভাগের মধ্যে অন্যতম পাইকারি বাজার হিসেবে খ্যাত। তাই হবিগঞ্জ, চুনারুঘাট, শায়েস্তাগঞ্জ, মাধবপুর এলাকার পাইকারি ব্যাবসায়ীরা শ্রীমঙ্গল থেকেই পাইকারি মালামাল ক্রয় করে নিয়ে যান।

মাধবপুর, চুনারুঘাট, শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও বাহুবল এলাকা থেকে আগত ভুক্তভোগী পাইকারি ব্যাবসায়ীরা জানান, দূর থেকে আসা বেশিরভাগ ব্যাবসায়ীই মালামাল ক্রয় করে ফিরতে রাত হয়ে যায়। রাত হলেই ফিরতি পথে হাইওয়ে পুলিশের কিছু সদস্য চাঁদাবাজি চালায়।

অতি তুচ্ছ কারণে রাতের বেলা রাস্তায় চলতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন ব্যাসায়ীসহ যানবাহন চালকরা। বিভিন্ন ধরনের যানবাহন রাস্তার পাশে থামিয়ে টাকা আদায় করছে হাইওয়ে পুলিশ। বিভিন্ন মিনিবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি, অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ট্রাক ও লরি থেকে প্রতিদিন মোটা দাগে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সাতগাঁও হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা। এদিকে হাইওয়ে পুলিশের বেপরোয়া চাঁদাবাজির কারণে পরিবহনের মালিক ও যাত্রীরা অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, সাতগাঁও হাইওয়ে পুলিশের ওসি নবীর হোসেনের নেতৃত্বে তার বিশ্বস্ত সাব-ইন্সপেক্টর কবির হোসেন সমস্ত হাইওয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের ওসি নবীর হোসেনকে সারাবাংলার কাছে সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এসব সত্য নয়। তিনি বলেন, আমার কোনো পুলিশ সদস্য যদি চাঁদা দাবি করে। আর আমার কাছে এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ এলে তা খতিয়ে দেখব।’

আপনার বিরুদ্ধেই চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে প্রতিবেদকের এমন কথায় তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ সত্য নয়।’

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য হাইওয়ে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর কবির হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিক ফোন এবং মেসেজ দিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

সারাবাংলা/এনএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন