March 10, 2021 | 6:30 pm
এন্টারটেইনমেন্ট করেসপনডেন্ট
বাংলা গানের স্নিগ্ধময়ী শিল্পী হিসেবে শ্রোতারা যাকে একনামে চেনেন; তিনি- নিলুফার ইয়াসমিন। আশির দশকে আধুনিক বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন অনন্য এই সুরেলাকণ্ঠী। বিভিন্ন ধারার সঙ্গীতের উপর অগাধ দখল দ্রুতই তাকে সঙ্গীতপ্রেমীদের মাঝে জনপ্রিয় করে তোলে। অভিভূত সঙ্গীতপ্রেমীদের মাঝে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে নিলুফার ইয়াসমিনের নাম।
‘এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে’, ‘এতো সুখ সইবো কেমন করে’, ‘তোমাকে পাবার আগে’, ‘আগুন জ্বলেরে’, ‘জীবন সেতো পদ্ম পাতার শিশির বিন্দু’, ‘পথের শেষে অবশেষে বন্ধু তুমি’, ‘যদি আপনার লয়ে এ মাধুরী’, ‘এতো কান্নাই লিখা ছিলো ভাগ্যে আমার’, ‘যে মায়েরে মা বলে কেউ ডাকে না’, ‘প্রতিদিন সন্ধ্যায়’, ‘মাগো আমার যে ভাই’, ‘এখনো কেন কাঁদিস ও পাখি’, ‘ফুলে মধু থাকবেই’, ‘নীল পাখি ওরে’, ‘দিওনা দিওনা ফেলে দিওনা’- একের পর এক তার কণ্ঠসৃত এই গান গুলি ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। আজ ১০ মার্চ বাংলা গানের এই বরেণ্য শিল্পীর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৩ সালের এই দিনে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে কিংবদন্তি এই সঙ্গীতশিল্পী মৃত্যুবরণ করেন।
নিলুফার ইয়াসমিনের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার পার্ক স্ট্রীটে। বাবা লুৎফর রহমান এবং মা মৌলুদা খাতুন। পাঁচ বোনের মধ্যে নিলুফার ছিলেন চতুর্থ। বড় বোন ফরিদা ইয়াসমিন, মেজো বোন ফওজিয়া খান, সেজো বোন নাজমা ইয়াসমীন হক ও ছোট বোন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন।
নিলুফারের জন্মের সময় বাবা লুৎফর রহমান ছিলেন অবিভক্ত বাংলার একজন সিভিল সার্ভিস অফিসার। যার সঙ্গীতের প্রতি ছিল প্রবল অনুরাগ। পরিবারের গানের প্রচলন ছিল। এমন কি পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও নিলুফারের বাবা গান পরিবেশন করতেন এবং মা হারমোনিয়াম বাজাতেন। নিলুফারের মা মৌলুদা খাতুন মুর্শিদাবাদের স্বনামধন্য ওস্তাদ কাদের বখশের ছাত্রী ছিলেন। তিনি ভালো গান গাওয়া ছাড়াও ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন।
নিলুফার ইয়াসমিনের সংগীতে হাতেখড়ি তার মা মৌলুদা খাতুনের কাছে। এছাড়া বাড়ির গ্রামোফোন রেকর্ড শুনে শুনেও তিনি শিখে নিয়েছিলেন বহু গান। সেই সময়কার বিখ্যাত সংগীতশিল্পী আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, কমলা ঝরিয়া, হরিমতী, কে মল্লিক, জ্ঞান গোস্বামী, শচীনদেব বর্মন, মৃণালকান্তি ঘোষ, কমল দাশগুপ্ত, আব্বাসউদ্দীনসহ আরো সব শিল্পীদের গান রেকর্ড বাজিয়ে শিখতেন নিলুফারের মা মৌলুদা খাতুন। আর একইসাথে মায়ের সঙ্গে নিলুফারও এসব গান শিখে ফেলতেন। একই সময়ে নজরুল সঙ্গীতের প্রতিও বিশেষভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন নিলুফার ইয়াসমিন।
সংগীত শিক্ষার পাশাপাশি নিলুফারের লেখাপড়ার হাতে খড়িও হয়েছিল মায়ের কাছে। একটু বড় হয়ে তিনি আদমজী কটন মিল স্কুলে ভর্তি হন। এরপর বাংলাবাজার গার্লস স্কুল থেকে ১৯৬৩ সালে তিনি এস এস সি পাশ করে ভর্তি হন সিদ্ধেশ্বরী কলেজে। সেখান থেকে ১৯৬৫ সালে এইচএসসি পাশ করে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে বি এ (অনার্স) এবং ১৯৭০ সালে ২য় শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এম এ পাশ করেন নিলুফার।
এসএসসি পাশ করার পর যথাযথভাবে সংগীত গুরুর কাছে রাগ সঙ্গীত শেখা শুরু হয় নিলুফারের। যতটুকু জানা যায়, ১৯৬৪ সাল থেকে ওস্তাদ পি সি গোমেজ-এর কাছে তিনি রাগসঙ্গীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন। এবং ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই গুরুর কাছেই রাগ সংগীতের তালিম নেন। এরপর উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ-র সুযোগ্যা ছাত্রী মীরা ব্যানার্জী, প্রখ্যাত সারেঙ্গী বাদক ওস্তাদ সগীরউদ্দীন খাঁ, মুর্শিদাবাদের স্বনামধন্য ওস্তাদ এ দাউদ সাহেব এবং প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তালিম নেন নিলুফার।
নিলুফার ইয়াসমিন নজরুল-সঙ্গীতের প্রাথমিক শিক্ষাটা পেয়েছিলেন মায়ের কাছে। এর বাইরে তিনি নজরুল সঙ্গীত শিখেছেন পুরানো রেকর্ড এবং বিভিন্ন স্বরলিপি গ্রন্থ থেকে। স্বরলিপি অনুসরণ করে গান তোলার শিক্ষা পেয়েছিলেন ওস্তাদ পি সি গোমেজ-এর কাছ থেকে। পরবর্তীতে তিনি প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী, নজরুল-সংগীত স্বরলিপিকার ও বিশেষজ্ঞ শেখ লুৎফর রহমান ও সুধীন দাশ-এর কাছে নজরুল-সংগীত শিখেছেন।
বাংলাদেশ বেতারের ছোটদের অনুষ্ঠান ‘খেলাঘর’-এর মাধ্যমে শিল্পী জীবন শুরু হয়ে নিলুফারের। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে শিল্পী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হন। এবং উভয় প্রতিষ্ঠানেই তিনি আমৃত্যু একজন নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান গেয়েছেন। রাগসঙ্গীত এবং নজরুল সঙ্গীতের বাইরে তিনি গেয়েছেন অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, টপ্পা, ঠুমরি, কীর্তন, রাগপ্রধান, আধুনিক গান। তিনি বেশ কিছু চলচ্চিত্রে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও গান করেছেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো ছিল― ‘শুভদা’, ‘অরুণ-বরুণ-কিরণমালা’, ‘জোয়ার ভাটা’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘সুজন সখী’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘জীবন-তৃষ্ণা’, ‘জলছবি’ ইত্যাদি।
১৯৬৯ সালে প্রখ্যাত গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও অভিনেতা খান আতাউর রহমানকে বিয়ে করেন নিলুফার। এবং তাদের একমাত্র পুত্র আগুন বর্তমানে বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতা।
১৯৯৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের নজরুল সঙ্গীতের প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন এবং আমৃত্য এই পদে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ১৯৮৪ সালে কলকাতার ‘অগ্নিবীণা’-র আমন্ত্রণে তিনি কলকাতা এবং বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের আমন্ত্রণে দিল্লীতে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এছাড়াও তিনি পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ফ্রান্স, পাকিস্তানে সংগীত পরিবেশন করে প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেন।
‘শুভদা’ চলচ্চিত্রে কণ্ঠ প্রদানের জন্য ১৯৮৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন নিলুফার ইয়াসমিন। ২০০৪ সালে সংগীত বিষয়ে অনন্য অবদানের জন্য তাকে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় ‘একুশে পদক’ প্রদান করা হয়। এছাড়াও নজরুল সংগীতে তার অবদানের জন্য ১৪১০ বাংলা সালে ‘নজরুল পদক’ সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন তিনি।
২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে নিলুফার ইয়াসমিনের শরীরে টিউমার ধরা পড়ে। এরপর অপারেশন করা হলে তিনি বেশ সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু কয়েকদিন পরেই দেখা গেল আস্তে আস্তে জীবনী শক্তি হারিয়ে ফেলছেন তিনি। ২০০৩ সালের প্রথম থেকেই তার শরীরের মারাত্মক অবনতি ঘটে এবং একই বছরের ১০ মার্চ তারিখে সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে বারডেম হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন নিলুফার ইয়াসমিন।
আজ (১০ মার্চ) বাংলা গানের এই বরেণ্য সংগীতশিল্পীর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সারাবাংলার পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
প্রতিকৃতি: শিল্পী শাহজাহান আহমেদ বিকাশ
সারাবাংলা/এএসজি