বিজ্ঞাপন

‘জেলমুক্তির সময় কারারক্ষীরা বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দিতেন’

March 17, 2021 | 10:32 pm

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন তিনি। প্রতিটি মানুষকে তিনি গুরুত্ব দিতেন। নিজ দলের নেতাকর্মী তো বটেই, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের প্রতিও তার ছিল অগাধ সম্মান। তিনি সবাইকে ভালোবাসতেন। আর সে কারণেই যখন তিনি কারাগারে থাকতেন, কারারক্ষী এবং অন্যান্য কয়েদিরাও তাকে সম্মান করতেন। তারা বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হয়ে যেতেন। আমি দেখেছি, যখন তিনি জেল থেকে মুক্তি পেতেন, তাকে গার্ড অব অনার দিতেন কারারক্ষীরা।

বিজ্ঞাপন

মতিঝিলের চেম্বারে সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের কাছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব কথা বলেন বঙ্গবন্ধুর সহচর্যধন্য ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রথমে আইনমন্ত্রী ও পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ড. কামাল। বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও ছিলেন ঝানু এই আইনজীবী।

৮৪ বছর বয়সী ড. কামাল এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা তার নিত্যসঙ্গী। সে কারণেই অতীতের অনেক স্মৃতিই এখন তার ঝাঁপসা হয়ে এসেছে। তারপরও জাতির পিতার জন্মবার্ষিকী সামনে রেখে তার দ্বারস্থ হলে থেমে থেমে আবেগমথিত কণ্ঠে স্মৃতির অতল থেকে তুলে এনেছেন বিভিন্ন ঘটনা।

আরও পড়ুন-

বিজ্ঞাপন

স্মৃতিচারণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিজের জানাশোনার কথা তুলে ধরেন ড. কামাল হোসেন। আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ১৯৫৯ সালে আমি লন্ডন থেকে বার-অ্যাট-ল শেষ করে দেশে ফিরে আসি। লন্ডনে থাকতেই জানতে পারি, বঙ্গবন্ধু এক বিশেষ ব্যক্তিত্বের মানুষ। সব মহলে তার সমান গ্রহণযোগ্যতা। দেশের জনগণ তাকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। বঙ্গবন্ধুর গুণের কথা সবার কাছে শুনেছি। তার সম্পর্কে দেশে ফিরেও একই কথা শুনতে পাই। তার প্রশংসা শুনতে শুনতেই তার ভক্ত হয়ে যাই।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতিও মনে করলেন ড. কামাল। বললেন, একদিন আমার বাবার সঙ্গে ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক মানিক মিয়ার বাসভবনে গিয়েছিলাম। সেখানেই প্রথম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা, পরিচয়। ওই সময় আমি বঙ্গবন্ধুকে দেশ নিয়ে নানা প্রশ্ন করি। বঙ্গবন্ধু কোনো রকম বিরক্তি না হয়েই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমার প্রশ্নগুলোর জবাব দিলেন। তার সঙ্গে কথা বলে আমি তার প্রতি আরও আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। আমার প্রশ্নগুলো হয়তো তারও পছন্দ হয়েছিল। সে কারণেই ওই দিন থেকে তিনিও আমাকে কাছে টেনে নেন।

বিজ্ঞাপন

ড. কামাল হোসেন বলেন, ১৯৬৪ ও ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গেলেন ভুট্টোর (জুলফিকার আলী ভুট্টো, আইয়ুব খানের শাসনামলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী) সঙ্গে আলোচনা করতে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। ওই সময় বঙ্গবন্ধু আকারে-ইঙ্গিতে আমার সঙ্গে অনেক কথাই বলেন। সেগুলো আমি বুঝে নিয়ে ইংরেজিতে লিখে প্রেস রিলিজ তৈরি করে তা বঙ্গবন্ধুকে দেখাই। বঙ্গবন্ধু ‘ভেরি গুড’ বলে প্রেস রিলিজটি অনুমোদন করেন এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আমিও তার কথামতো কাজ করি। একপর্যায় তিনি আামকে তার প্রতিটি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ফেলেন। আমিও তার নির্দেশ মতো দায়িত্ব পালন করতে থাকি।

১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ওই মামলা লড়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দায়ের করা আগরতলা মামলার আমি একজন আইনজীবী ছিলাম। তখন আমার সিনিয়র অনেক আইনজীবীও ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রয়াত মির্জা গোলাম হাফিজ। অন্যান্য আইনজীবীদের নাম স্মরণ করতে পারেননি তিনি।

ওই মামলার কথা তুলে ধরে ড. কামাল আরও বলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আমি একদিন আদালতে গেলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে বললেন, তুমিও তো আইনজীবী। এরপর থেকে তুমি আমার জন্য আদালতে মুভ করবে। করণ ওরা (আইনজীবীরা) শুধু আমার হয়ে ওদের কথা বলে  আদালতে। তুমি আমার কথাগুলোই বলবে। এরপর আমি ওকলাতনামায় সই করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আদালতে মুভ করতে থাকি। এরপর থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়ে যায়। ওই সময় থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কার্যক্রমের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম।

বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। ড. কামাল জানান, এর মাসখানেক পর এপ্রিলে তাকেও গ্রেফতার করে পাকিস্তানিরা। তাকেও পাকিস্তানের একটি কারাগারে রাখা হয়। তবে পাকিস্তানের কোন কারাগারে তাকে রাখা হয়েছিল, সেটি স্মরণ করতে পারেননি তিনি।

বিজ্ঞাপন

ড. কামাল বলেন, কোন জেলে ছিলাম, স্মরণে আসছে না। তবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক জেলে ছিলাম না। বঙ্গবন্ধু এক জেলে, আমি অন্য জেলে ছিলাম। তবে একসঙ্গে আমরা দেশে ফিরেছি। ওই দিনটি আমার জীবনের বিশেষ একটি দিন। একসঙ্গে আমরা ফিরে এসেছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশে।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর কী করলেন— জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন বলেন, এ তো সবাই জানে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সংবিধান প্রণয়নের জন্য কাজ করেছি। বঙ্গবন্ধু বললেন, সংবিধানে আইনের বিষয়গুলো তুমি দেখো। আমি সেটাই করলাম।

মুক্তিযুদ্ধের আগেই ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন ড. কামাল। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির পর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী এবং পরে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে ড. কামালের। নব্বইয়ের দশকে তিনি গড়ে তোলেন গণফোরাম। এখনো দলটির চেয়ারম্যান তিনি। তবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হলেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শ্রদ্ধায় এতটুকু ঘাটতি তৈরি হয়নি— এমনটিই জানালেন ড. কামাল হোসেন।

বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ড. কামাল হোসেনের শেষ মন্তব্য, উনি যেমন মানুষকে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন; তেমনি মানুষও তাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত। মানুষের মুক্তিই ছিল তার সারাজীবনের লক্ষ্য। আর সে কারণেই তিনি যখন যেখানে যেতেন, সবার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা তাকে ঘিরে রাখত— সেটি রাজনীতির মাঠই হোক আর কারাগারই হোক। সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে যখন তিনি মুক্তি পেলেন, সেখানেও তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়েছিল। কারামুক্তির পর লন্ডন, ভারত হয়ে দেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও তাকে স্যালুট করেছিলেন।

সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন