বিজ্ঞাপন

গল্প : জুয়াড়ি

March 22, 2018 | 5:03 pm

যেদিন ‘এরশাদ অন্তরীণ’ ব্যানার হেডলাইনের ইনকিলাব পত্রিকাটা একদিনের বাসি হয়ে পিয়াসা মদির গাঁয়ে এল, সেইদিন জন্ম মামুনের। এরশাদের অন্তরীণের মত মামুনের  জন্মের খবরও গাঁয়ে তেমন সাড়া ফেলে না। মামুনদের বাড়িতেও এটা বিশেষ কোনো খবর নয়। সে আজব বেগমের নয় নম্বর নাতী।

তার বয়স সার্টিফিকেটের চেয়ে চার বছর বেশি। মামুন দুইনাম্বার। না মানে বাবামায়ের দুই নম্বর ছেলে সে। বলতে গেলে তার চৌদ্দগুষ্টি কৃষক। এখানেও দুইনম্বরি হয়ে গেল তার। হওয়ার কথা কৃষক, হয়ে গেল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। একেবারে অশিক্ষিত নয় মামুনের পরিবার। সকলেই গাঁয়ের স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছে। এমন কি তার বাবা-মাও। কিন্তু তারপর আর কলেজের পথ মাড়ায়নি কেউ। যে পিয়াসা মদির গাঁয়ে মামুনদের বাড়ি, সে গাঁয়ের কামুক লোমশ শরীরের বগল ঘেঁসে বয়ে গেছে চনমনে নদী জুয়াড়ি। আর বেরসিক কলেজ জুয়াড়ির ওইপার। পিয়াসা মদির গাঁয়ের কেউ দুই কুড়ি দুই না পেরোলে জুয়াড়ি পেরোয় না। কবে থেকে এই নিয়ম ভালো করে জানা যায় না। একবার নাকি জুয়াড়িতে নৌকা ডুবে মরেছিল পিপাসা মদিরের আঠারজন জোয়ান ছেলে। তাদের সকলের বয়স ছিল বাইশের কম। তাহলে আঠারোতে ম্যাট্রিক পাশ করলে চার চারটা বছর কলেজতো আর পিয়াসা মদিরের জন্য বসে থাকে না। মামুন যে সেই কলেজও পেছনে ফেলে আরো দূরে যেতে পারল, তার কারণ সে লেট লতিফ। ক্লাস ওয়ানে যেতে সে দশটা বছর লাগিয়েছিল। এর পেছনে দাদী আজব বেগমের ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে করে তার অন্য নাতী-নাতনীরা। জন্মের বছর খানেক পরেই মামুনকে যে কী জাদু করল বুড়ি, সারাক্ষণ দাদীর পেছন পেছন ঘুরত সে। নাওয়া-খাওয়া, শোওয়া সব দাদীর সাথে। স্কুলে যাওয়ার বয়স পেরিয়ে যায়, সে দাদীর আঁচল ছেড়ে নড়ে না। খৎনা করে লুঙ্গি ধরে ফেলল তবু দাদীকে ছাড়ে না। দশ পেরিয়ে যখন এগারোতে পরল, তখন দাদী তার কানে কানে বলল, এইবার ইস্কুলে যাও দাদা। স্কুলের হেড মাষ্টার গাঁইগুই করেছিলেন, এত্ত বড় ছ্যাড়া কেলাশ অনে ভত্তি করব? আজব বেগম ঘাড় বেঁকিয়ে বলেছিল, ছয় লেইহা ভত্তি কর মাস্টর। ছয়ের ছ্যাড়া এত বড় অইলে হে বুজতো আর তোমার লয়। বয়স বেশি বলে আর বড় ভাইবোনদের পড়া দেখে দেখে আগেই খানিক পেকেছিল বলে, সে ফার্স্ট হয়ে হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ক্লাস টপকায়। বাইশ বছরে ম্যাট্রিক পাশ করে সে। পিয়াসা মদির গাঁয়ের স্কুলে এর আগে কেউ আর এত ভালো পাশ দেয় নাই। এইবার আবার কলকাঠি নাড়ে আজব বেগম, মামুনের স্যান্ডোগেঞ্জির নীচ দিয়ে কাঠি কাঠি হাত ঢুকিয়ে পিঠ হাতায় আর বলে, হোন দাদা, কলেজ-মলেজ বাতথো, বড় পড়া পড়। ধুর বুড়ি কি কও! কলেজের মাতার উপুর দিয়্যা লাপ দিয়্যা বড় কলেজ আমাক লিবি?

বিজ্ঞাপন

এই করতে করতে কলেজ বাদ দিয়ে পলিটেকনিকে ভর্তি হলো মামুন। ডিপ্লোমা আর ইঞ্জিনিয়ার কোনোটাই উচ্চারণ করতে পারে না আজব বেগম। আর পারেনা বলেই তার খুশির সীমা নাই। নাতী যে কলেজের চেয়ে বড় কলেজে ভর্তি হয়েছে সে খুশিতে সে গুনগুনিয়ে গান গায় আর রোদে পিঠ দিয়ে বসে তার বাঁশের লাঠিতে তেল ঘসে। চার বছর পর নাতী যখন ডিপ্লোমা ইঙ্গিনিয়ারিং পাশ করল, আবারো নড়ে উঠল আজব বেগমের কাঠি কাঠি হাত। হোন দাদা, তোর বাপ চাচাদের ধান চাইল বেচা ট্যাহা ম্যালা দেকচি, এহন অপিসের ট্যাহা লাইরব্যার মন চায়।

দাদীর যদি অফিসের টাকা নাড়তে ইচ্ছে করে তবে তার চাকরি খোঁজা ছাড়া আর কী করার থাকে! ভালো রেজাল্ট করেছিল বলে বগুড়া পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষকরা তাকে চিনত। দাদীর শখের জায়গায় অভাব বসিয়ে তাদের কাছে চাকরি খোঁজার বুদ্ধি চায় মামুন। দাদীর শখ মেটানো ছাড়া তার চাকরির টাকার তেমন কোনো কাজ নেই। তার পরিবার স্বচ্ছল কৃষক পরিবার।

মামুনের শিক্ষকরা চেয়েছিলেন, সে রাজশাহী বিআইটিতে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক। কিন্তু তার অভাবের বানানো গল্প শুনে তাদের মন গলে যায়। শিক্ষকদের একজনের সুপারিশে ঢাকার এক ডেভেলপিং কোম্পানির সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি পেয়ে যায় সে। মোহাম্মদপুরের এক নয়তলা বিল্ডিংয়ের কেবল পাইলিং শুরু হয়েছে, এমন সাইটে তার অফিস। কাজ যতটা না ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তার চেয়ে বেশি তদারকির। সারাদিন ভীষণ শব্দের মধ্যে থাকতে হয়। কাদা কাদা ভেজা ভেজা জায়গায় কাটে সারাদিন। তারপরও ভালই লাগে তার। কাছাকাছি একটা পুরান বিল্ডিংয়ের চারতলার ছাদের এক রুমের একটা বাসা ভাড়া নেয় সে। তার রুম বাদে বাকিটা ছাদ। পয়লা মাসের বেতনের সাথে দুদিনের ছুটিও পায়। দাদীর জন্য নতুন কড়কড়ে টাকা নিয়ে বাড়ি যায়। আজব বেগমের হাসি আর ফোকলা দাঁতে আটকায় না। আবার স্যান্ডোগেঞ্জির নীচ দিয়ে পিঠ হাতায় আর বলে, বিয়া কইরবা লয় দাদা?

বিজ্ঞাপন

আঁতকে ওঠে মামুন, আরে থামো থামো বুড়ি! এহনি কিসের বিয়া? টিবি কেনব দুইডো, একখান বাড়ির একখান আমার, মোবাইল কেনব তিনডো। তোমার, মা’র, আমার। বুড়ি সোয়াগের মাত্রা বাড়ায়, স্যান্ডো গেঞ্জির ভেতরের হাত এবার পেটে বুকে আসে, তা কিন্ন, বউ কি মানা করবি?

বুড়ির আরো সোহাগের আগেই ঢাকা চলে আসে মামুন। পরের দুইমাস ছুটি পায়না। হাতে টাকা জমে যায় অনেক। মোবাইল কেনে দুইটা। তিনদিনের ছুটিতে বাড়ি যায়। আজব বেগম মোবাইল পেয়ে হাসে না। উসখুস করে, কী যেন বলতে চায়। মামুন সন্দেহের চোখে তাকায়, লক্ষন মোটেই সুবিধার ঠেকে না। দাদির ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে নেমে মায়ের খোঁজ করতে গিয়ে দেখে একটা মেয়ে সুরুত করে রান্না ঘরে ঢোকে। অচেনা মেয়ে। তার নিজের ভাই চাচাতো ভাইদের মিলিলে ছয়জন বউ বাড়িতে, তাদের কারো বোন হবে ভাবে সে। মাকে খুঁজে না পেয়ে আবার দাদির ঘরেই ঢোকে। এবার বুড়িকে অনেক শক্ত লাগে। কী বলবে মন স্থির করে ফেলেছে বলে অনেক শান্ত দেখায়। খানিক আগের আনচান ভাব আর নেই।

বুড়ি যা বলে তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না সে। না, ঘটনার সাথে আজব বেগমের প্রত্যক্ষ যোগ নেই। আসল আসামী তার মা। কিন্তু যা সে ঘটিয়েছে তা ছেলেকে বলার সাহস তার নেই। আজব বেগম ছাড়া এই মিমাংসা আর কেউ করতে পারবে না।

বিজ্ঞাপন

তিন দিন আগে স্বামীকে সাথে নিয়ে মামুনের মা গিয়েছিল তিন গ্রাম দূরে ননদের বাড়ি। আজব বেগম সেদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই ছেলের বউকে বলেছিল মেয়ের জন্য তার কইলজা খাবলায়। কাল সকালে ছেলেদের কাউকে পাঠিয়ে দেবে বলে বুড়িকে শান্ত করতে চায় মামুনের মা। কিন্তু বুড়ি সকালের নাস্তার ভাত সামনে নিয়ে বসে থাকে। উপায় না দেখে মামুনের বাবা-মা রওনা দেয় মোহনপুর গাঁয়ের উদ্দেশ্যে। পথে বেড়িয়ে তাদের ভালই লাগে। ভ্যানে পা ঝুলিয়ে বসে পান চিবাতে চিবাতে দুইজন সুখ-দুখের গল্প করে। তাদের মনে পরে বহুকাল পরে তারা দুইজন এতটা সময় জেগে জেগে কথা বলে। ননদের বাড়ি পৌঁছায় বেলা পড়ে আসার আগেই। কুটুম বাড়ির সবাই তাদের দেখে খুব খুশি হয়। ননদ ভালোই আছে, আজব বেগমের কইলজা খাবলানোর মত কিছুই ঘটে নাই। খুব গল্প হয়, খাওয়া-দাওয়া হয়। রাতটা থেকে সকালে দুজন রওনা দেবে ঠিক করে ঘুমাতে যায়। ননদের সাথে গল্প করে টরে তার সাথেই ঘুমায় ভাবী। মামুনের বাবা বাইরের ঘরে। অনেক রাতে হঠাৎ পাশের বাড়িতে নারীকন্ঠের চিৎকার সাথে টিনের বেড়ায় বাড়ির শব্দ। লাফ দিয়ে ওঠে মামুনের মা আর ফুপু। কী হয়েছে? দরজা খুলে বাইরে আসে তারা। ননদের যাবে কি যাবে না ভাব খেয়ালও করে না মামুনের মা। পাশেই খড় নেড়ে দেওয়ার একটা কারাল পড়ে ছিল, সেটা তুলে ছুটে যায়। পাশের বাড়ির উঠানে তিনটা ছেলে দাঁড়ানো। একজন লাঠি দিয়ে বেড়ায় বাড়ি মারছে, ঘরের ভেতরে মা মেয়ের চিৎকার। ননদের বাড়ি বেড়াতে এসে এদের বাড়িতে আগেও দুয়েকবার এসেছে সে। লোকটা মারা গেছে বছর তিনেক আগে। মেয়েটা খুব সুন্দর দেখতে। কালকে রাতেই গল্প করেছে ননদ, মেয়েটা এবার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করেছে। এলাকার বখাটেদের নজর তার ওপরে। যে ছেলেটা টিনের বেড়ায় বাড়ি মারছিল তার মাথায় কষে এক বাড়ি বসালো মামুনের মা। এরা লাগাতার এসব করে কেউ দেখতে আসে না। আজ এক বাড়ি খেয়েই পেল ভয়, দৌড়ে পালালো। ততক্ষণে মামুনের ফুপা-ফুপুও এসে দাঁড়িয়েছে উঠানে। তাদের ডাকে দরজা খুলে বাইরে এল মা-মেয়ে। ভয়ে মুখ সাদা। হঠাৎ মেয়েটা ছুটে এসে লুটিয়ে পড়ল মামুনের মায়ের বুকে। আবেগে হোক উত্তেজনায় হোক সে বলে বসল, এ মাইয়ার দায়িত্ব আমি লিল্যাম।

পরেরদিন সেতারা বানুকে নিয়ে বাড়ি ফেরে তারা।

আজব বেগম মনের কথা মুখে আনে, দাদা, মিয়াডোক তো এই গাঁয়ে রাহা যাবি লয়। তুমি অক লিয়্যা যাও!

অর দুই কুড়ি দুই অইচে? জুয়াড়ি কিব্যা হইরা পাড় দিবি ও!

বিজ্ঞাপন

এই রকম অবাস্তব প্রস্তাব শোনার পরে নাতী যে এমন একটা সমস্যার কথা বলতে পারে মাথায় ছিল না আজব বেগমের। তার শুধু মাথায় ছিল, সে রাজি হবে না। কী কী বলে তাকে রাজি করাবে সেটা সে আগেই ভেবে রেখেছিল। কিন্তু জুয়াড়ি পার হবার কথা যে মামুন বলতে পারে একদম ভাবেনি।

ও তো আর আমাগারে গাঁয়ের কেউ লয়!

হ্যাঁ, তাও বটে পিয়াসা মদির গাঁয়ের মানুষই শুধু এটা মানে। সেতারা তো অন্য গাঁয়ের মানুষ। কিন্তু বিয়ে না করে সেতারাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে পারে মামুন? আর বিয়ে হয়ে গেলেইতো সে পিয়াসা মদিরের মানুষ হয়ে যাবে!

আজব বেগম বলল, হোন দাদা, আমি তোক ম্যালা ভরসা করি। তুই অক লিয়া যা। সামনের বচ্চর অর আঠারো অবি, তারবাদে বিয়া করিস। আর অর দুই কুড়ি দুই অলি পারে বাড়িত আনিস!

সেতারা বানু ঢাকায় থাকতে এসে প্রথম আপত্তি করল চাল নিয়ে। ঢাকার চালের ভাতে স্বাদ নেই। মামুন মৃদু আপত্তি জানিয়ে বলল, আরে ঢাকায় কি ধানের খেত আছে? গ্রাম থেকেইতো চাল আসে। ভাতের আবার স্বাদ-বিস্বাদ কী? স্বাদ নেই দেখেইতো ভাত খেতে এত কিছু লাগে।

সেতারা বলে যে আমাদের গাঁয়ে ভাত খেতে এত কিছু লাগেনা, একফোঁটা সরিষার তেল আর দুইটা আলু সেদ্ধ হলেই দুই থাল ভাত খাওয়া যায়!

এবার মামুন তাকে জিরো ফিগার তত্ত্ব শেখায়, বেশি বেশি ভাত খেলে পেট ফুলে যাবে, শাড়ি পরলে বিশ্রি লাগবে! এবার আরো মারাত্মক কথা বলল সেতারা, পানি খেতে পারছে না সে। চিনি মিশিয়ে পানি খাচ্ছে!

মামুন বলল, চিনিতেও ফিগার নষ্ট হয়!

আরেক আজব বেগম জুটেছে তার কপালে ভাবে মামুন। আসার সময় মা বলেছে, সেতারা লেখাপড়ায় ভালো। বই খাতা কিনে দিলে ঘরে বসেই কলেজ পাশ করতে পারবে সে। আইয়ের এক সেট বই আর খাতা কলম কিনে আনে সে। ঢাকা কলেজের সামনে থেকে কেনা একটা চকিতে তার বিছানা। আবার ঢাকা কলেজের সামনে যায় সে, সেতারার জন্য চেয়ার টেবিল কিনে আনে।

আজব বেগমকে ফোন করলে ভাব ভালোবাসার খবর নেয় সে। কিসের ভাব ভালোবাসা! সেতারা নিজের মত থাকে। লেখাপড়া করে। কাজ শেষে ফিরে কোনোদিন দেখে রান্না করেছে সেতারা, কোনোদিন দেখে করেনি। সেদিন নিজেই রান্না করে অথবা খাবার কিনে আনে। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পরে মামুন। সেতারা পড়ে অনেক রাত পর্যন্ত। তারপর মামুনের ঘরে বা রান্নাঘরের মেঝেতে বিছানা করে ঘুমিয়ে পড়ে।

দিন পনেরো পরে একদিন সেতারার কাছে জানতে চায়, তার ভাব ভালোবাসা পয়দা হচ্ছে কিনা? সেতারা চুপ। সে কি মামুনকে বিয়ে করবে? এবার সেতারা কথা বলে এবং যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই বলে। বলে যে সে এসেছে নিরাপত্তার জন্য, যে পিরাপত্তা দেয় তাকে কি বিয়ে করা যায়?

সেতারার জন্য বাড়ি যেতে পারছে নে সে। দম বন্ধ লাগলে দাদীকে ফোন করে। আজব বেগম আজব বুদ্ধি দেয়। একটো চুমা খাও দাদা! এ বুড়িরে নিয়ে আর পাড়া যায় না! চুমা খাও দাদা! ইচ্ছা করে বুড়িরে তুলে আছাড় মারে। মা ভয়ে ছেলের সঙ্গে কথা বলে না, শ্বাশুড়ির কাছেও খোঁজ নিতে পারে না। সারাক্ষণ ছটফট করে। ঢাকায় দুইজনে কী করে, তাদের ভাব-ভালোবাসা হলো কিনা জানার জন্য অস্থির লাগে। মাঝে মাঝে শাশুড়ির কাছে বসে থাকে চুপ করে। জানতে চায়, সে কি ভুল করে ফেলেছে? ছেলের উপর অবিচার করেছে? তারপর একদিন কানতে কানতে বলেই ফেলে, মা আপনে কয়দিন নাতীর কাছে থেকে আসেন। আপনের ছাওয়াল আপনেক ঢাকা দিয়া আসুক! ছোটবেলা থেকে দাদীর কাছে ছেলেকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থেকেছে সে।

মামুনের বাবা আজব বেগমকে নিয়ে ঢাকায় রওনা হয়। পথে বেরিয়ে আজব বেগম খুশি হয়ে ওঠে। তার প্রায় সাড়ে তিন কুড়ির জীবনে এটাই সবচেয়ে দীর্ঘ যাত্রা। বাবা ছেলেকে নিয়ে এতটা ভাবেনি। তার পুরুষের মাথা বলেছে, যুবক যুবতী দুইজন কাছাকাছি থাকলে ভাবতো হবেই। কিন্তু এই দুই নারী, মা আর দাদী বুঝেছে কাছাকাছি থাকাই যথেষ্ট নয়।

আজব বেগম বাসায় পা দেওয়া মাত্র মামুনের মনে হল, তার জীবনের সব জটিলতার অবসান ঘটেছে। খেয়ে দেয়ে সুস্থির হয়ে আজব বেগম সেতারাকে নিয়ে বসে। মামুন চলে যায় কাজে, বাবা এদিক সেদিক ঘুরতে যায়। ধর্ষণের বর্ণনা দিয়ে সেতারাকে একটা স্টেটমেন্ট লিখতে বলে আজব বেগম। কাগজ কলম এগিয়ে দিয়ে বুকের সাথে লেপ্টে ধরে সেতারাকে। চারমাসের অন্তস্বত্তা সেতারা স্টেটমেন্ট লিখে দেয়। সেটা নিয়ে পরেরদিন মামুনের বাবা ফিরে যায় পিয়াসা মদিরে।

দাদীর কথামত আরেকটা চকি কিনে এনে, দুই চকি জোড়া দিয়ে বিছানা বড় করে। মাঝখানে শুয়ে আজব বেগম দুইজনের গায়ে দুইহাত রেখে ঘুমায় রাতে। দুই মাস পরে মামুনের বাবা আসে মাকে নিতে। আর তিন ধর্ষণকারীর গ্রেফতারের খবর দিতে। আজব বেগম চলে যাওয়ার পর একটু একটু সহজ হয় সেতারা। দাদীর বড় করে যাওয়া বিছানায় কাল্পনিক দাদীকে মাঝখানে রেখে ঘুমায় তারা। নিজের ভেতরে অদ্ভুত এক আলোড়ন টের পায় মামুন। যেন সে সেতারার প্রেমিক হতে চায় না, স্বামী হতে চায় না, তাকে ছুঁতে চায় না, আদর করতে চায় না। কেবল পাশে থাকতে চায়। আর বাচ্চাটার জন্য তার মনের ঘৃনা মুছে দিতে চায়। শুয়ে শুয়ে দুজন গল্প করে। আসলে মামুনই বলে, সেতারা শোনে কি শোনে না বোঝা যায় না। মেয়ে হলে তার নাম রাখতে চায়, মিষ্টি। একটু যেন হাসে সেতারা।

হঠাৎ প্রশ্ন করে মামুন, আমাক অর বাপ -? চমকে উঠে বসে সেতারা, তার বাচ্চার বাবা হতে দেবে কিনা, এই প্রশ্ন করেছে সে!

পাথরের মুখ সেতারার, বাচ্চাটা মরে যাক চায় সে!

মামুনের মুখে যেন আজব বেগম কথা বলে ওঠে, না! ধরো, অক আমরা কুড়াইয়া পাইছি। দাদীর কাছ থেকে পাওয়া সব ভালোবাসা সে শিশুটিকে দিতে চায়।

তিন মাস পরে এক বর্ষার রাতে মামুনকে ঘুম থেকে তোলে সেতারা। এক সিএনজিওয়ালার ফোন নম্বর রেখেছিল, ফোন দিল তাকে। নিয়ে গেল হাসপাতালে। ভোররাতে ছেলে হলো সেতারার।

আজব বেগম ফোনে বলে, অক লিয়া বাড়িত আয় দাদা। এক মাস বয়সের ছেলে নিয়ে পিয়াসা মদিরে রওনা দেয় মামুন আর সেতারা।

মামুন ঢাকা থেকে রওনা দেওয়ার পরই তার বাড়ির লোকেরা খবর পায়, জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছে তিন ধর্ষক। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাবা-চাচারা। আর ভাইয়েরা জুয়াড়িতে নৌকা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। তাদের ইঞ্জিনহীন নৌকা যখন মাঝ জুয়াড়িতে, তখন জুয়ারিকে চাবুক মারতে মারতে একটা ইঞ্জিনের নৌকা ধেয়ে আসে।  শ্লোগানও শোনা যায়, যদিও বোঝা যায় না। ইঞ্জিনের শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে ঝনঝনিয়ে বাজে সেই শ্লোগান। দুই মিনিটের জন্য ইঞ্জিন থামিয়ে মামুনদের নৌকা থেকে সেতারাকে তুলে নেয় তারা। যাওয়ার সময় গুলি করে নৌকার তলিতে। ইঞ্জিন চালু হয় ফের, সেতারার চিৎকার আর শোনা যায় না। পানিতে ভরে যায় মামুনদের নৌকা। বাইশ পেরোনো সবাই সাঁতরে পাড়ে ওঠে। কেবল মামুনের এক হাতে জড়ানো ছোট্ট শরীরটা আর নড়ে না। মামুন তাকে পিয়াসা মদিরের মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল হাসপাতালের খাতায়। জুয়াড়ি তাই তাকে বাড়ি ফিরতে দেয় না!

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন