বিজ্ঞাপন

কোন দেশ কবে স্বীকৃতি দিয়েছিল বাংলাদেশকে

March 26, 2021 | 9:05 pm

রাজনীন ফারজানা

যুদ্ধ কিংবা সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী প্রতিটি দেশের প্রয়োজন হয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এভাবেই নয়মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জন করার পর বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন স্বাধীন দেশ ও সংগঠনের স্বীকৃতি। একদিকে যেমন চলে রণাঙ্গনের যুদ্ধ অন্যদিকে তেমনি চলছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ ও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ে কূটনৈতিক যোগাযোগ।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দান করে ভুটান। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এক মাইলফলক। এদিন সকালে ভুটানের তৎকালীন রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়ে তারবার্তা দেন। সেখানে রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক  বলেন, বিদেশি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের মহান এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম অদূর ভবিষ্যতে সাফল্য লাভ করবে। ভুটানের জনগণ এবং তার প্রত্যাশা, সৃষ্টিকর্তা বর্তমান বিপদ থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করবেন, যেন তিনি দেশের পুনর্গঠন এবং উন্নয়নের মহান কর্তব্যে দেশ ও দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারেন।

এরপরই স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশের আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু ভারত। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোটি বাঙালিকে আশ্রয় দেওয়া, অস্ত্র ও সর্বত সহযোগিতা দানের পাশাপাশি তারা ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

ভারতের স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ তে বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা আসে। ভারতের পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপন করে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহ এবং সেই সংগ্রামের সাফল্য এটা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট করে তুলেছে যে তথাকথিত মাতৃরাষ্ট্র পাকিস্তান বাংলাদেশের মানুষকে স্বীয় নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনতে সম্পূর্ণ অসমর্থ। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বিশাল বাধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। তার বক্তব্য শেষ না হতেই ভারতের সংসদ সদস্যরা হর্ষধ্বনি আর ‘জয় বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে মুখর করে তোলেন।

বিজ্ঞাপন

ভারতের স্বীকৃতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। এ স্বীকৃতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তান’ যুদ্ধের পরিচিতি থেকে মুক্তি দেয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে পাকিস্তান। এ স্বীকৃতির ফলে মুক্তিযুদ্ধের গতি আরও বেগবান হয়। রণযুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধেও পরাজিত হতে থাকে পাকিস্তান।

১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের আগে ২৬ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আর তারই প্রেক্ষিতে ভুটান আর ভারতের এই স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত করে।

এরপর অবশ্য আর ১৯৭১ সালে কারও স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি। পরে ধীরে ধীরে চার বছর ধরে প্রায় ১৫০ দেশ বাংলাদেশকে দেয় রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ব্রিটেন থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপরই তিনি হাত দেন সদ্য স্বাধীন দেশ পরিচালনায়। ব্যাপক কূটনৈতিক যোগাযোগের ফলে একে একে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে স্বীকৃতি আসতে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশের।

বিজ্ঞাপন

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় যেসব দেশ
স্বাধীনতা অর্জনের দ্বিতীয় বছরে এশিয়ার বাইরে থেকে স্বীকৃতি আসতে থাকে। এবছর ৮৭ দেশ স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানায়।

জানুয়ারি ১৯৭২
এশিয়ার বাইরে প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি স্বীকৃতি দেয় পূর্ব-জার্মানি। ১১ জানুয়ারি আরও জানায় মঙ্গোলিয়া। ১২ জানুয়ারি পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া। ১৩ জানুয়ারি মিয়ানমার। ১৬ জানুয়ারি নেপাল। ২০ জানুয়ারি বার্বাডোস।  ২২ জানুয়ারি  যুগোশ্লাভিয়া (সার্বিয়া)। ২৪ জানুয়ারি টোঙ্গা ও চেকোস্লোভাকিয়া (চেকপ্রজাতন্ত্র) বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। রাশিয়াসহ বাকি সোভিয়েত ব্লকও ২৪ জানুয়ারি তারিখেই স্বীকৃতি দেয়। একে একে ২৪ জানুয়ারি স্বীকৃতি দেয়। এরপর ২৬ জানুয়ারি সাইপ্রাস, ৩১ জানুয়ারি হাঙ্গেরি, অস্ট্রেলিয়া, ফিজি, নিউজিল্যান্ড।

ফেব্রুয়ারি ১৯৭২
১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি দেয় সেনেগাল। প্রথম পশ্চিমা দেশ হিসেবে গ্রেট ব্রিটেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। একই দিন স্বীকৃতি দেয় পশ্চিম জার্মানি, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, আইসল্যান্ড। এইদিন ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। এরপর ৮ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রিয়া ও পশ্চিম সামোয়া (সামোয়া), ৯ ফেব্রুয়ারি কিউবা, ১০ ফেব্রুয়ারি জাপান, ১১ ফেব্রুয়ারি লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও আয়ারল্যান্ড বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পরদিন ১২ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি দেয় ইতালি, ১৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্স ও কানাডা, ১৬ ফেব্রুয়ারি দেয় সিঙ্গাপুর, ২০ ফেব্রুয়ারি দেয় মরিশাস, ২৪ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইন। মুসলিম দেশের মধ্যে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ২৯ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি জানায় মালাওয়ি (মালাবি)।

মার্চ ১৯৭২
২ মার্চ গাম্বিয়া, ৪ মার্চ শ্রীলঙ্কা, সোয়াজিল্যান্ড ১০ মার্চ, গ্রিস ১১ মার্চ, সুইজারল্যান্ড ১৩ মার্চ, লোসোনা ২১ মার্চ, বতসোয়ানা ২৩ মার্চ, জ্যামাইকা ২৫ মার্চ, তাইওয়ান ২৮ মার্চ স্বীকৃতি দেয়।

বিজ্ঞাপন

এপ্রিল ১৯৭২
বাংলাদেশকে ৪ এপ্রিল স্বীকৃতি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।  এরপর গ্যাবন ৬ এপ্রিল, মালাগাছি (মাদাগাস্কার) ১৪ এপ্রিল,  সিয়েরা লিওন ২১ এপ্রিল, লাওস ২৫ এপ্রিল, লাইবেরিয়া  ২৬ এপ্রিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানায়।

মে ১৯৭২
২ মে কোস্টারিকা, ভেনেজুয়েলা, কলম্বিয়া স্বীকৃতি জানায়। এরপর মেক্সিকো ১১ মে, স্পেন ও দক্ষিণ কোরিয়া ১২ মে, ব্রাজিল ১৫ মে, আর্জেন্টিনা ২৫ মে, হাইতি ২৬ মে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

জুন ১৯৭২
১ জুন চিলি স্বীকৃতি জানায়। এরপর ইকুয়েডর ৬ জুন, জাম্বিয়া ২১ জুন, রুমানিয়া ২৮ জুন বাংলাদেশকে স্বীকার করে নেয়।

জুলাই ১৯৭২
প্রথম আরব দেশ হিসেবে ইরাক ৮ জুলাই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তারপর তানজানিয়া ১২ জুলাই, মাল্টা ও ডোমিনিকান রিপাবলিক ১৯ জুলাই, গুয়াতেমালা ২২ জুলাই, ইয়েমেন ৩১ জুলাই স্বীকৃতি জানায়।

আগস্ট ১৯৭২
১ আগস্ট পেরু, বলিভিয়া ২ আগস্ট, উগান্ডা ১৬ আগস্ট, পানামা ও উরুগুয়ে ২৪ আগস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

সেপ্টেম্বর ১৯৭২
আপার ভোল্টা (বারকিনা ফাসো) ১৯ সেপ্টেম্বর, প্যারাগুয়ে ২১ সেপ্টেম্বর, ভ্যাটিক্যান সিটি ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানায়।

অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর ১৯৭২
হন্ডুরাস ১৯ অক্টোবর, উত্তর ভিয়েতনাম ও ইথিওপিয়া ২৫ নভেম্বর এবং ঘানা ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় যেসব দেশ
স্বাধীনতা অর্জনের তৃতীয় বছর অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে মোট ১৮ দেশ স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানায়। ১৮ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তান, ২৮ মার্চ লেবানন, ১৩ জুলাই মরক্কো, ১৬ জুলাই আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মৌরিতানিয়া, ৩১ জুলাই দক্ষিণ ভিয়েতনাম, ২৩ আগস্ট আইভরি কোস্ট, জায়ারে (গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র) ৮ সেপ্টেম্বর, মিসর ও সিরিয়া ১৫ সেপ্টেম্বর, নাইজার ২৪ সেপ্টেম্বর, গিনিবিসাউ ৩০ সেপ্টেম্বর, ক্যামেরুন ৬ অক্টোবর, গিনি ১০ অক্টোবর, জর্ডান ১৬ অক্টোবর, ডাহোমি (বেনিন) ২২ অক্টোবর, কুয়েত ৪ নভেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় যেসব দেশ
১৯৭৪ সালে মোট ৭ টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এমাসেরই ২২ তারিখ স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান যাদের কাছ থেকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি আমরা। পাকিস্তান ছাড়াও ২২ ফেব্রুয়ারি ইরান ও তুরস্ক, নাইজেরিয়া ২৭ ফেব্রুয়ারি, কাতার ৪ মার্চ, সংযুক্ত আরব আমিরাত ১০ মার্চ, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র ২১ মার্চ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় যেসব দেশ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার আগ পর্যন্ত ১০৪ দেশ (সৌদি আরব ও চীন ছাড়া) বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। অবশেষে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৫-এ সৌদি আরব ও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। সৌদি আরব স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট। সুদান দেয় ১৬ আগস্ট, ওমান দেয় ১৭ আগস্ট। চীন স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট।

সারাবাংলা/আরএফ/

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন