বিজ্ঞাপন

মৃত্যুঞ্জয়ী সাহসী শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. আবদুল আলীম

March 31, 2021 | 3:20 pm

রা’আদ রহমান

“এই দিবসটিতে কথা বলা আসলে খুব কষ্টকর, আজ আমরা যখন এখানে বসে আছি, ১৯৭১ সালের এই দিনে একটি কাদালেপা মাইক্রোবাস আমাদের বাসাগুলোতে ঘুরছে, দেশের সর্বোচ্চ মেধার অধিকারী কিছু মানুষ, তাদের চোখে গামছা গিয়ে বেঁধে হাত বেঁধে টেনেহিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। পেছনে পড়ে থাকছে তাদের স্ত্রী, ছোট ছোট সন্তান। একটা সুন্দর সোনার বাংলা দেখবো বলে আমরা কিন্তু আমাদের এই ত্যাগ হাসিমুখে মেনে নিয়েছি। আমাদের বাবারা মাথা উঁচু করে চলে গেছেন, আমাদের মায়েরা রয়ে গেছেন, তারা কিন্তু কোনো অভিযোগ ছাড়াই, অনুযোগ ছাড়া চোখের জল গোপন করে দীর্ঘ ৪৫ বছর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। আমি আমার বাবার খুব আদরের মেয়ে ছিলাম। আমার ঠিক এক বছরের বড় একটা বোন আছে। আমি যেহেতু ঠিক এক বছর পরেই হয়ে গিয়েছিলাম, আমার মা আমার বোনটাকে ঠিক সময় দিতে পারতেন না। আমার বোনটা একটু অসুস্থও ছিল। মা’র অজান্তে আমি বাবার বুকের উপর গিয়ে পরে থাকতাম। এতো ব্যস্ত একজন ডাক্তার, রাতের বেলা ফিরে এসে ওইটুকু মেয়েকে নিয়ে বুকের মধ্যে করে ঘুমোতেন। পাশ হতে পারতেন না, কাত হতে পারতেন না। আমার এই বাবাটাকে ধরে নিয়ে যাবে ১৫ ডিসেম্বর বিকেলবেলা, ধরে নিয়ে গিয়ে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে তাদের রাখা হত, এই অংশটা চিন্তা করতে চাই না। ওখানে কী করা হত সেটাও ভাবতে চাই না। শুধু এটুকু বলি, ১৮ তারিখে আমার বাবার লাশটা যখন আমরা পাই, বুকটা ঝাঁজরা ছিল গুলিতে, তার কপালে বেয়নেট চার্জ করা ছিল। আপনাদের কাছে যখন আসি, অনেক আবেগতাড়িত হয়ে যাই, হতে চাই না, কিন্তু হয়ে যাই, কারণ আপনাদের দিকে যখন তাকাই, আমার সবসময় মনে হয়, আপনারা কি বোঝেন কিনা যে আমাদের বাবারা হাসিমুখে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছিল এই আত্মবিশ্বাসে যে আপনাদের হাতে দেশটা দিয়ে গেলে দেশটা ভালো থাকবে”।

বিজ্ঞাপন

গত কয়েক বছর আগে বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির তৈরি এক ট্রিবিউটের কল্যাণে শহিদ বুদ্ধিজীবী ডাক্তার এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরীর কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরীর এই কথাগুলো বেশ নাড়া দিয়ে গেছে সবাইকে। ২০১৬ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অসম্ভব আবেগস্পর্শী এই কথাগুলো বলেন ডা. নুজহাত চৌধুরী। অনেকেই প্রচণ্ডভাবে আপ্লুত হয়েছেন তার কথাগুলোতে, অনেককেই ছুঁয়ে গেছে কথাগুলো।

ডা. আলীম ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলার অন্যতম সেরা চক্ষুবিশেষজ্ঞ। তার পুরো নাম ছিল ডা. আবুল ফয়েজ মোহাম্মদ আব্দুল আলীম চৌধুরী। জন্ম বাংলা ১৩৩৫ সালের ৩ বৈশাখ, ইংরেজি ১৯২৮ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার চট্টগ্রাম থানার খয়েরপুর গ্রামে। জেলা স্কুল পরিদর্শক আব্দুল হেকিম চৌধুরী ও সৈয়দা ইয়াকুতুন্নেছার তৃতীয় সন্তান তিনি। ১৯৪৫ সালে কিশোরগঞ্জ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৮ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএসসি পাস করা আলীম ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৬১ সালে রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিসিয়ান’স অব লন্ডন এবং রয়্যাল কলেজ অফ সার্জন’স অব ইংল্যান্ড থেকে ডি.ও শেষ করেছিলেন।

ভাবতে অবাক লাগে সেই পাকিস্তানি আমলে, যখন ২৪ বছরের শোষণ আর বঞ্চনার নাগপাশে নিষ্পেষিত করে যাওয়া পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের পায়ের তলে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করতো, যখন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের কোথাও সুযোগ দিত না পাকিস্তানিরা, তখন কতটা অসামান্য প্রতিভাবান হলে একটা মানুষ সে সময়ের সর্বোচ্চ মানদণ্ড বিলেত থেকে ডাক্তারিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

চাইলেই তিনি পারতেন বর্তমান সময়ের মতো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিতেই সন্তুষ্ট থেকে “আই হেইট পলিটিকস” স্লোগান আউড়ে পাকিস্তানিদের অধীনতা মেনে নিয়ে স্বাধিকার নিয়ে বিন্দুমাত্র কনসার্নড না হয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে আরামে জীবন কাটিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ, যার জীবনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল শ্রেণীহীন শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা এবং জাতীয় মুক্তির জন্য আন্দোলন করে যাওয়া। ছাত্রজীবনে ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি নিয়েছিলেন এবং একটা সময় তিনি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ও ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকার সাব-এডিটর ছিলেন। এরপর তিনি ‘যাত্রিক’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন।

এ ছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার লেখায় শ্রেণীহীন শোষণ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার কথাসহ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কথা প্রকাশ পেয়েছে। ছাত্রাবস্থায় তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন এবং কারাবরণও করেছেন। ১৯৫৪, ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন (ভিপি)। ১৯৫৮ সালে সেই সময়কার সরকারের বিরোধিতার কারার কারণে দেশ ছেড়ে লন্ডনে চলে যান। বিদেশে থেকেও ডা. আবদুল আলীম দেশের জন্য কাজ করেছেন। ১৯৬২ সালে লন্ডনে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ছিলেন এর আহবায়ক ও প্রতিষ্ঠিতা সম্পাদক। লন্ডনে থাকা অবস্থায় ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ভাষণে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের স্বৈরাচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

সবচেয়ে অসাধারণ ছিল তার পেশাগত জীবনে অসামান্য নীতি ও আদর্শ বজায় রাখা। আমাদের ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থার আজীবন বিরোধিতা করে গেছেন এই মানুষটা। সমাজের শোষণ, বঞ্চনা, দুর্নীতি, অন্যায় ও অত্যাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরোধিতা করেছেন আজীবন এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমালোচনা করেছেন সবার সামনেই। ডাক্তাররাও যেন এই দুর্নীতির প্রশ্রয় না দেন সেজন্য তিনি ডাক্তারদের ‘নন প্র্যাকটিসিং জব’ করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলন করেছেন। এজন্যে তাকে অনেক সহকর্মীর কাছে বিরাগভাজনও হতে হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী মুটে, মজুর, দারোয়ান, শ্রমিক জেলে এবং দরিদ্র রোগীর কাছ টাকা-পয়সা কখনো নেননি। বরং তাদের চোখে ছোটবড় অপারেশন করতেন বিনা পারিশ্রমিকে। তিনি বলতেন, ‘ওদের ভাতই জোটে না, তার ওপর আবার ১৬ টাকা ভিজিট! ১৯৭০ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের ত্রয়োদশ পুনর্মিলনী উৎসবে সাবেক সভাপতি হিসেবে প্রদত্ত ভাষণ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এই শহিদ বুদ্ধিজীবী চিকিৎসকের আদর্শনিষ্ঠ জীবন লক্ষ্যের পরিচয়টি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি শুধু সমস্যাগুলো তুলে ধরেছি এবং সমাধান সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছি। তরুণ বন্ধুরা যদি সমস্যাগুলো বুঝবার চেষ্টা করেন এবং সমাধান সম্পর্কে চিন্তা করেন, তা হলেই আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হবে। সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলের। আমি বিশ্বাস করি সমাজ পরিবর্তনের যে জোয়ার এসেছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অজস্র নতুন প্রাণ একে ত্বরান্বিত করবে। আজকের এই উৎসবমুখর দিনে, আসুন আমরা দুঃস্থ মানবতার সেবার আত্মোৎসর্গ করি ও সংকল্প গ্রহণ করি যে, আমরা এমন একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা কায়েম করবো, যা প্রতিটি নাগরিকের জন্য সুচিকিৎসার নিশ্চয়তা এনে দেবে। আমরা ছাত্রজীবনে দুস্থ মানবতার সেবা করার যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, গণমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবায়নের মাধ্যমে যে স্বপ্ন সার্থক হোক’।

অনেকের হয়তো মনে হচ্ছে, আরে এমন ডায়লগ তো অনেকেই দেয়, কাজের সময় আর কয়জনকে পাওয়া যায়। ডা. আবদুল আলীম ঠিক এখানেই স্পষ্ট করে গিয়েছিলেন বাকিদের সঙ্গে তার পার্থক্য! একাত্তরে যখন নিরীহ নিরপরাধ বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি বর্বরেরা ঝাঁপিয়ে পড়লো, নির্বিচারে শুরু হলো গণহত্যা, সেই ভয়ংকর দুঃসময়ে শত্রুর নাকের ডগায় অসম দুঃসাহসী ডা. আলীম জীবনটা হাতে নিয়ে শুরু করেছিলেন তার যুদ্ধ। কারফিউ উঠে গেলে আলীমের যুদ্ধ শুরু হতো। গাড়ির বনেট ভর্তি করে ওষুধ সংগ্রহ করতেন বিভিন্ন ফার্মেসি আর ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে। এগুলো আবার মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটিতে পৌঁছে দিয়ে আসতেন তিনি।

এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করার জন্য একটি গোপন হাসপাতাল ছিল। সেখানে গিয়ে ডা. আলীম, ডা. ফজলে রাব্বি এবং এদের মতো আরও অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তারেরা নিজের এবং তাদের পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। সুস্থ করে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিয়েছেন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে। ডা. আলীমের মৃত্যুর পর একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেছিল, “আলীম ভাইয়ের দেয়া আমার চোখের ব্যান্ডজটি এখানও আছে। কিন্তু আলীম ভাই নেই। আলীম ভাইকে কোথায় হারালাম?”

সারাটা জীবন যে মানুষটা আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে এসেছেন, তিনি যে পরম শত্রুকেও তার বিপদে সাহায্য করতে ছুটে যাবেন, তাতে আর বিস্ময়ের কি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জুলাই মাসের শেষ দিকে বৃষ্টিমুখর এক সন্ধ্যায় ডা. আবদুল আলীমের পাশের বাসার মতিন নামে এক ভদ্রলোক মৌলানা আবদুল মান্নান নামের একজনকে তার পরিবারসহ নিয়ে আসেন। নিজেকে অসহায় হিসেবে পরিচয় দেওয়া আবদুল মান্নান আলীমের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, আর খুব স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধের সময় বিবেচনায় আলীম আশ্রয় দেন মৌলানা মান্নানকে। বাসার নিচতলায় খালি জায়গায় স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে বাস করতে শুরু করে মান্নান। নিয়তির কি অদ্ভুত বিধান! আলীম ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না এই মৌলানা আবদুল মান্নান আসলে জামায়াতের আলবদর জল্লাদদের গুপ্তচর।

বিজ্ঞাপন

শেষ পর্যন্ত এই মান্নানের রেকি করে দেওয়া তথ্যেই আল-বদর বাহিনী জানতে পারে আলীমের গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার ঘটনা। ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটায় মৌলানা মান্নানের দেওয়া তথ্যে বাসা থেকে আলীমকে ‘হ্যান্ডস আপ’ করা অবস্থায় বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদরের হায়েনাগুলো। ডা. রাব্বিকেও নেওয়া হয়েছিল ওই একই দিনে বিকেল সাড়ে চারটায়। সারারাত নির্যাতনের পর ভোররাতে মেরে ফেলা হয় অসামান্য মানবদরদী ডা. আলীমকে। চিরকালের মতো নিভিয়ে দেওয়া হয় তার প্রাণের প্রদীপ। এর তিন দিন পর ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে ডা. আবদুল আলীমের ক্ষত-বিক্ষত লাশটির সন্ধান পাওয়া যায়। বুকটা ঝাঁজরা ছিল অনেকগুলো গুলিতে, সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন।

সারাবাংলা/আইই

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন