বিজ্ঞাপন

শেকড়ের সন্ধানে— শিশুদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংযোগ

April 1, 2021 | 2:59 am

রাজনীন ফারজানা

ঢাকা: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শিশুদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংযোগ সাধনের উদ্দেশ্যে আয়োজিত হয়েছে ‘শেকড়ের সন্ধানে- মার্চ ২০২১’। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানি কমান্ডার কে এম মাহবুবুল আলম, অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত এবং লেখক, কবি ও সাংবাদিক আনিসুল হক। পরবর্তী প্রজন্মের পক্ষ থেকে ছিল নাবিহা ইনায়া আরেফিন, সুহীরা আমায়া মনোয়ার, শিরোপা ইফফাত সায়েফ, নিয়ন্ত আশিক, সৈয়দ রাইয়ান সৌম্য, ফাইয়াজ শরীফ ইসলাম, জায়ান মুয়াস্সার গিয়াস এবং লারিসা ইসলাম। তারা সবাই দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী।

বিজ্ঞাপন

২৫ মার্চ (বৃহস্পতিবার) সুপ্রিমকোর্টের ব্যারিস্টার ইফফাত গিয়াস আরেফীনের সঞ্চালনা ও পরিকল্পনায় অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। এটি ‘শেকড়ের সন্ধানে’র দ্বিতীয় পর্ব। এ অনুষ্ঠান আয়োজন ও সম্প্রচার করেছে ‘১/এ নিউ বেইলী রোড থেকে বলছি’।

অনুষ্ঠানে অতিথিরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিশুদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন। কথোপকথনের মধ্যেই উঠে আসে কে এম মাহবুবুল আলম, আবুল হায়াত ও আনিসুল হকের মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা অভিজ্ঞতা ও মতামত। সঙ্গে ছিল অতিথি শিশুদের নানা রকম পরিবেশনা। দেশাত্মবোধক গান, কবিতা ও গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনও করে তারা।

বিজ্ঞাপন

অতিথিদের প্রশ্নের জবাবে কে এম মাহবুবুল আলম তার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, প্রশিক্ষণ ও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠনের ইতিহাস তুলে ধরেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকে শুরু হওয়া নানাবিধ রাজনৈতিক কার্যক্রমই মূলত তাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। পরবর্তীতে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে তারা যুদ্ধে যোগ দেওয়ার অনুপ্রেরণা পান।

যুদ্ধের পরিকল্পনা বিষয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুল আলম বলেন, যুদ্ধের সময় কোনোকিছুর কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। গুলি করলে সেটি শত্রুর গায়ে লাগবে কিনা তা যেমন নিশ্চিত হওয়া যায় না, তেমনি যেকোনো মুহূর্তে শত্রুর গুলি লাগারও আশঙ্কা থাকে। যুদ্ধের সময় তারা যুদ্ধস্থল রেকি করে আসতেন। বিশ্বস্ত কিছু মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শত্রুপক্ষের অবস্থান দেখে আসতেন। প্রশিক্ষণের সময় তাদের শেখানো হয়েছিল তারা যেন শত্রুপক্ষকে মারতে চেষ্টা করে। আর না পারলে যেন পিছিয়ে আসে, গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে তাদের জীবন বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।

তিনি এসময় শিশুদের সঙ্গে নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলায় একটি যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন। সেখানে মগরা নামে এক নদীর তীরে যুদ্ধ হয়। নদীর এক পাশে শত্রুসেনাদের ঘাঁটি। এপাশে তারা ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। সেখানে তারা ট্রেঞ্চ খুঁড়ে (গর্ত) এক সপ্তাহ অবস্থান করেন। সকাল সাড়ে আটটার দিকে তিনি এলএমজি দিয়ে প্রথম গুলি করেন। সেসময় পাকিস্তানি সেনারা মাত্র ঘুম থেকে উঠেছেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এমন গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর থানা থেকে সেনাসদস্যদের সঙ্গে রাজাকার, আলবদররা বেরিয়ে আসে। সেখানে নদীর তীরে সাত দিন থাকেন তারা। সঙ্গে ছিল না কোনো খাবার। এমন সময় বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি এসে তাদের খাবার দিয়েছিলেন। এভাবে সাত দিন থেকেও তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে নেত্রকোনার মদন থানা থেকে হঠাতে পারেননি। গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী তারা নিরাপদে পিছু হঠেন সেবার।

বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া এক শিশু বরেণ্য অভিনেতা আবুল হায়াতের কাছে জানতে চায়— ২৫ মার্চ রাতে তিনি কোথায় কী অবস্থায় ছিলেন এবং কী করেছিলেন? পরবর্তীতেই বা কী করলেন তিনি? জবাবে আবুল হায়াত বলেন, পাকিস্তান আমলে স্বাধীনতার পক্ষে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি পুরোপুরি জড়িত ছিলেন। পথনাটক এবং মঞ্চনাটকের মাধ্যমে মুক্তির পক্ষে আন্দোলন চালাতেন তারা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তারা সৃজনী শিল্পীগোষ্ঠির ব্যানারে, সৈয়দ হাসান ইমামের নির্দেশনায় একটি পথনাটকের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। নাটকের নাম ছিল, ‘রক্ত দিলাম স্বাধীনতার জন্য’। ২৩ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার কয়েকটি জায়গায় নাটকটি প্রদর্শনের কথা ছিল। কিন্তু তার কিছুদিন আগেই তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন ও এই নাটক থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। সেই ২৩ মার্চই জন্ম হয় তার প্রথম সন্তান বিপাশা হায়াতের। কিন্তু সেদিনই তিনি কোমায় চলে যান ও ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হন। ঢাকা মেডিকেলের পাশেই শহিদ মিনার উড়িয়ে দেওয়া হয়। এসবের কিছুই তিনি জানতে পারেননি। তাই সেসময় দেশে কি হচ্ছে না হচ্ছে তার কিছুই তিনি জানতেন না। পরে জ্ঞান ফিরলে তিনি সব জানতে পারেন। একদিকে তিনি ঢাকা মেডিকেলে, অন্যদিকে তার স্ত্রী সদ্যজাত সন্তান নিয়ে হলি ফ্যামিলিতে। পরে ২৯ মার্চ তার জ্ঞান ফেরার পর তাকে স্ট্রেচারে করে গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। যেয়ে শোনেন তার স্ত্রী সদ্যজাত সন্তানকে কোলে নিয়ে পাঁচ মাইল হেঁটে গ্রামে চলে গিয়েছিলেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব আলমের কাছে এক শিশু জানতে চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের অবস্থা ও যুদ্ধের একটি স্মরণীয় ঘটনা। মাহবুব আলম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কোনো উপায়ই ছিল না। তিনি পরিবার সম্পর্কে কিছু না জানলেও তার পরিবার তার সম্পর্কে খবরাখবর পেত। সেসময় স্বাধীন বাংলা বেতারে তার সম্পর্কে নিয়মিতই খবর দেওয়া হতো। তাকে ডাকা হতো বিচ্ছু আলম। এছাড়াও একটি ঘটনার কথা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সবসময় বলা হতো। সেসময়কার ন্যাশনাল ব্যাংক (বর্তমান সোনালি ব্যাংক) থেকে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কাছে জমা দেন। স্বাধীন বাংলা অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে দশ ট্রাংক মুদ্রা জমা দেন। এভাবেই তার পরিবার জানতো যে তিনি বেঁচে আছেন।

একটি স্মরণীয় ঘটনার কথা বলতে গিয়ে নেত্রকোনার কলমাকান্দা থানার এক যুদ্ধের কথা বলেন মাহবুব আলম। সীমান্তঘেঁষা এই থানাটি সেসময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেখানে বাঙ্কার তৈরি করেছিল। এদিকে এই থানা দখল না করলে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের মহেষখালি থেকে বাংলাদেশে যাতায়াত কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেন, এখানে হামলা চালাবার। কলমাকান্দা থানার প্রায় পুরোটাই পানি দ্বারা পরিবৃত ছিল। মাত্র দুই দিক থেকে ছিল কাঁচা রাস্তা। গভীররাতে তারা ওই থানায় আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী রাত তিনটা থেকে চারটার দিকে তারা রাইফেল কাঁধে সাঁতার কেটে অনেক কষ্ট করে নদী পার হয়ে আসেন।  অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের ছত্রভঙ্গ করে দেন তারা। সেই যুদ্ধে পাকিস্তানিদের পরাজয় হয় ও তারা পিছু হটে।

এক প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রথম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তারপরও অনেক কিছুই স্মৃতিতে গেঁথে আছে তার। যুদ্ধ, মিছিল, বিজয়, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি মনে করতে পারেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। সেসব মূলত সাক্ষাৎকার ও বই পড়া, অন্যের কাছে শোনা অভিজ্ঞতা থেকে লেখা।

বিজ্ঞাপন

আনিসুল হক মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা অবলম্বনে ‘মা’ উপন্যাস লেখেন। শিশুদের তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদের গল্প শোনান। আজাদসহ তার বন্ধুরা কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে যান সেসব কথা তুলে ধরেন ওই উপন্যাসে। তিনি এসময় ‘মা’ বই থেকে তার প্রিয় অংশ পড়ে শোনান।

অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি স্মরণে কয়েক সেকেন্ড নীরবতা পালন করা হয়। এছাড়া ইফাদ নিবেদিত লাইভ এই অনুষ্ঠানে দর্শকদের জন্য ছিল নানা ধরনের কুইজ। কমেন্টে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বিজয়ের উপর করা নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বিজয়ীরা জিতে নেন ইফাদের সৌজন্যে গিফট হ্যাম্পার।

সারাবাংলা/আরএফ/আইই

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন