বিজ্ঞাপন

বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায় এক ‘রহস্যময়ী’

April 6, 2021 | 4:15 pm

এন্টারটেইনমেন্ট ডেস্ক

‘মহানায়িকা’- এই নামটি নিলেই আপামর বাঙালির হৃদয়ে ভেসে ওঠে তার সেই মুখশ্রী। ষাটের দশকের সেই মায়াভরা চাহনি, গ্ল্যামার, লাস্যময়ীর অভিনয়ে আজও ডুবে রয়েছে ভক্তরা। তাকে নিয়ে আজও বাঙালির সেনসেশন অটুট। তার বাকা ঠোঁটের হাসি দেখলে আজও যেন হৃদপন্দনটা একটু হলেও বেড়ে যায়। বছর আসবে, বছর যাবে— কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্রের সেই ‘মহানায়িকা’ কিংবদন্তী অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন থেকে যাবে বাঙালি মননে, বাঙালির হৃদয়ে। আজ (৬ এপ্রিল) এই মহানায়িকার ৯০তম জন্মদিন।

বিজ্ঞাপন

১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল করুণাময় ও ইন্দিরা দাশগুপ্তের জমজমাট সংসারে যোগ হলো আরেকটি ছোট্ট সদস্য, মেজো মেয়ে কৃষ্ণা। গায়ের রঙ একটু চাপা বলে প্রথমে মেয়ের নাম রাখা হলো কৃষ্ণা, কিন্তু কে জানতো একদিন এই নামকে ছাড়িয়ে সে আরো নামের পর্দা চড়িয়ে সে নিজের সীমানাটুকুও অতিক্রম করবে? হয়ে উঠবেন বাঙ্গালির স্বপ্নের ‘সুচিত্রা সেন’।

‘কৃষ্ণা’ নামটি দিয়েছিলেন পিতামহ জগবন্ধু দাশগুপ্ত, কিন্তু বাবা করুণাময় সাধ করে মেয়ের আরেকটি নাম রাখলেন, ‘রমা’। ‘কৃষ্ণা’ নামের পর্দা ফেলে দিয়ে ‘রমা’ নামেই ক্রমশ বড় হলো মেয়েটি। এরই মধ্যে ভারতের পাটনা থেকে বদলি হয়ে বাংলাদেশের পাবনায় চলে এসেছেন করুণাময় দাশগুপ্ত এবং পাবনাতেই কাটে সুচিত্রার শৈশব-কৈশোর।

বিজ্ঞাপন

ক্লাস নাইন-এ পড়ার সময় দু’টি ক্লাসের মাঝখানে ডেস্কের উপর বসে গল্প করতে-করতে বন্ধুদের একদিন হঠাৎ বলে ফেলেছিলেন ‘আমি এমন নাম করব যে, পৃথিবী চিরকাল আমায় মনে রাখবে।’ সেই রমা যখন সত্যি নাম করে ফেললেন সিনেমায়, হয়ে উঠলেন সুচিত্রা, উমাদেবী— তার দিদি একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘তুই সিনেমায় নামলি, অভিনয়ের কী জানিস?’ নিজের দিদির কাছে সবচেয়ে সহজ ছিলেন সুচিত্রা, অকপটও, বলেছিলেন ‘না দিদি, পয়সার খুব দরকার, সিনেমা করতেই হবে। চেষ্টা করে দেখি, কতটা পারি।’ কতটা পেরেছিলেন তা বোধহয় শুধু আদিগন্ত বাঙালীই জানেন— সাদাকালো চলচ্চিত্রে তিনি চিরন্তন বর্ণময়ী। তার চলন-বলনের নিজস্ব স্টাইল যেন ক্রমেই অনুকরণীয় হয়ে উঠেছিলো সেকালের যুবতীদের কাছে। তার শাড়ি পরা বা চুল বাঁধার কেতা ছিলো পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কলকাতা, ঢাকার বাঙ্গালি সমাজে আভিজাত্য এবং ফ্যাশনসচেতনতার প্রতীক।

পাবনা শহরের মহাখালী পাঠশালার পাঠ শেষ করে, তিনি পাবনা গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পাক-ভারত বিভাজনের সময় এদের পুরো পরিবার পাবনা ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। এই সময় ঢাকার বিশিষ্ট শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পরিবারও কলকাতায় আশ্রয় নেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় রমা তথা সুচিত্রা সেনের এবং স্বামীর পদবী অনুসারে ‘রমা দাশগুপ্ত’ বদলে তার নাম হয় ‘রমা সেন’। মূলত বিলেত ফেরত দিবানাথ সেনকে সংসারী করার জন্যই, রমার সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন তার একমাত্র কন্যা মুনমুন সেন।

বিজ্ঞাপন

দিবানাথের মামা বিমল রায় ছিলেন সেকালের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা। বিমল রায় তাকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তার শ্বশুরকুলের অন্যান্য সবাইকে প্রস্তাব দেন। পরে তার শ্বশুর এবং স্বামীর রাজি হলে তিনি চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা রাখেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ‘শেষ কোথায়’ ছবির মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ছবিটি মুক্তি পায় নি। কিছুদিন অভিনয়ের পর অর্থাভাবে তা বন্ধ হয়ে গেলো ছবিটি। কখনোই মুক্তি পেলো না।

প্রথমে নেপথ্য গায়িকা হবার জন্যই গেলেন স্টুডিওতে, কিন্তু এই রূপসীকে পর্দার পেছনে রাখার মতো ভুল করেননি রুপোলি পর্দার লোকেরা! ‘শেষ কোথায়’ ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সুকুমার দাশগুপ্তর ‘সাত নম্বর কয়েদী’ সিনেমা থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত হলেন রমা। তবে, এই ছবিতে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ ঘটলো তার। ‘রমা’ নামটি পাল্টে রাখা হয় ‘সুচিত্রা’। সেই সাথে স্বামীর পদবী অনুসারে তার পুরো নাম হয় ‘সুচিত্রা সেন’। সুকুমার দাশগুপ্তর সহকারী নীতীশ রায় তার এই নাম দিলেন। ‘রমা’র নবজন্ম ঘটলো ‘সুচিত্রা’ হয়ে, সিনেমার রূপোলি পর্দায়।

সুচিত্রা সেনের নাম শুনলেই সাথে সাথে আরেকটি নাম স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠে। উত্তম কুমার আর সুচিত্রা সেনের পর্দার রসায়ন কার না মন কেড়েছে! ১৯৫৪ সালের ২৬শে জুন থেকে শুরু করে বহু সিনেমায় একসাথে আবির্ভূত হলেও, ১৯৫৪ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর পরিচালক অগ্রদূতের ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমাটিতেই তাদের জুটি প্রথম সাফল্য পায়। টানা ১৫ সপ্তাহ হলে চলেছিলো এই সিনেমা। ইতিহাস সৃষ্টি করা এই সিনেমা উত্তম-সুচিত্রা জুটিতে সিনেমা জগতে প্রতিষ্ঠা দেয়ার পেছনে এই ছবিটিই প্রথম মাইলফলক স্থাপন করেছে।

বিজ্ঞাপন
‘সাগরিকা’ ছবিতে উত্তম-সুচিত্রা

‘সাগরিকা’ ছবিতে উত্তম-সুচিত্রা

রূপোলি পর্দার পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনেও খুব কাছের ছিলেন তারা। উত্তম কুমারের মৃত্যু সুচিত্রার মনোজগতে এক আলোড়ন তুলেছিলো। ১৯৮০ সালের ২৪শে জুলাই হঠাৎ মারা গেলেন উত্তম কুমার। গভীর রাতে শহর যখন নীরব, সবাই যখন প্রিয় মহানায়ককে শেষ বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে, তখন নিভৃতে দেখা করতে গেলেন সুচিত্রা। ভবানীপুরে উত্তম কুমারের পৈতৃক বাড়িতে গিয়ে ছবিতে মালা পরিয়ে শেষ সাক্ষাৎটুকু করলেন। কেউ কেউ উত্তমের মৃত্যুকেও সুচিত্রার অন্তরালের কারণ বলে দাবি করেন। কিন্তু তিনি পুরোপুরি লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়েছেন তার দীক্ষাগুরুর মৃত্যুর পর।

তার অভিনীত বাংলা সিনেমা ৫২টি আর হিন্দিতে করেছেন মোট ৭টি সিনেমা। বাঙ্গালি চরিত্রের পাশাপাশি হিন্দি চলচ্চিত্রের পর্দাও কাঁপিয়েছেন তিনি। দর্শকরা তার সাথে ‘খোলি হাওয়ামে ডোলে, আজ মেরা মন বোলে, দিলকি বাহার লেকে আয়েগা সাওয়ারিয়া’ গানের সুরেও মেতেছেন। হিন্দি চলচ্চিত্রে তার ক্যারিয়ার সম্পর্কে বলতে গেলে সামনে আসে দু’টি নাম- ‘দেবদাস’ ও ‘আন্ধি’। অনেক নায়িকার স্বপ্নের চরিত্র ‘পার্বতী’ হয়ে দিলীপ কুমারের বিপরীতে তার মুগ্ধতাভরা অভিনয়ের প্রতিভা দেখিয়েছিলেন সুচিত্রা। আর তার অভিনয় ক্যারিয়ারের শেষ দিকে আসে ‘আন্ধি’, পরিচালনায় গুলজার। অনেকে মনে করেন ইন্দিরা গান্ধীকে মাথায় রেখে রাজনীতিবিদের চরিত্রটি সাজানো হয়েছিলো। এই চরিত্র বাস্তবায়নে বলিউডের কাউকে না নিয়ে বাংলার সুচিত্রা সেনকেই প্রথম পছন্দ বলে মনে হয় গুলজারের। এ ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন সঞ্জীব কুমার।

‘আন্ধি’ ছবিতে সুচিত্রা ও সঞ্জীব কুমার

‘আন্ধি’ ছবিতে সুচিত্রা ও সঞ্জীব কুমার

১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন ‘সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস’ জয় করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে।

২০০৫ সালে তাকে ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরষ্কার’ দেবার কথা উঠলেও তিনি এই পুরষ্কার গ্রহণ করতে আরো একবার পেছনে ফেলে আসা ঐ চাকচিক্যের দুনিয়ায় পা ফেলতে চাননি। তিনি পুরষ্কারটি ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন এবং স্পষ্টতই পুরষ্কারটি তিনি আর পাননি।

নিজের শর্তে পথ চলতেন, অভিনয় করতেন এই বহুল আলোচিত অভিনেত্রী। শোনা যায়, সত্যজিত রায় একবার সুচিত্রাকে তার ‘দেবী চৌধুরানী’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন, কিন্তু তারিখের সাথে মিলছিলো না বলে সুচিত্রা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। অদ্ভুত ব্যাপার, ১৯৭৪ সালে দীনেন গুপ্তের পরিচালনায় এই ‘দেবী চৌধুরানী’ সিনেমায়ই প্রফুল্লমুখীর চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ঠিক এভাবেই রাজ কাপুরের ‘আর কে ফিল্মস’ এর ব্যানারে কাজ করার প্রস্তাবও সুচিত্রা কখনো গ্রহণ করেননি। তিনি কোথায় অভিনয় করবেন, কোন ব্যানারে তার নাম আসবে, তা শুধু তিনিই নির্ধারণ করতেন। তার সময়ের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নিতেন তিনি। জানা যায়, ‘সপ্তপদী’ সিনেমাটিতে সুচিত্রা সেনের পারিশ্রমিক ছিলো দু’লক্ষ টাকা, যা সেসময়ের যেকোনো অভিনেতার চাইতে বেশি।

যখন ১৯৫৩-’৭৮ পর্যন্ত দর্শকের চোখে স্বপ্নে-স্বপ্নে ফেরার পর স্বেচ্ছাবসর নিয়ে চলে গেলেন অন্তরালে, কেউই প্রায় জানতে পারল না কারণটা। কেবল তার ছায়াসঙ্গী মহম্মদ হাসান জামান ছাড়া, যিনি ছিলেন তার মেকআপ আর্টিস্ট, হয়ে উঠেছিলেন খুব কাছের মানুষ। একদিন জামান খুব মনখারাপ ক’রে বাড়ি ফিরে স্ত্রী জামিলাকে বললেন, সুচিত্রা আর অভিনয় করবেন না, আর না-করার যে কারণটি জানিয়েছেন, সেটি শুনে চমকে ওঠার মতো। শত অনুরোধেও জামান কিন্তু কারণটি বলেননি জামিলাকে, ‘ও ঈশ্বরের দিব্যি দিয়ে বলেছিল, ওকে যেন এই বিষয়ে কোনও প্রশ্ন না করি’।

২০১৩ সালে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর আবার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেন সুচিত্রা। এবং ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতীয় সময় সকাল ৮টা ২৫ মিনিট নাগাদ কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সুচিত্রা সেনের মৃত্যু হয়।

বাঁকা ঠোঁটের হাসিতে যে কত তরুণের হৃদস্পন্দন বাড়িয়েছেন সুচিত্রা, তা এতো দিন পরও বাঙ্গালির মুখে মুখে ফেরে। সুচিত্রা ঘাড় ঘুরে তাকালে সময়ও কি একটু করে থমকে যেতো না? যেতো। পর্দায় সুচিত্রার চোখ টলমল করে উঠলে জল গড়াতো পর্দার এপারে। তার মুগ্ধতাকে আকণ্ঠ গ্রহণ করেছে দর্শকসমাজ। সুচিত্রা এক চিরসবুজ প্রেয়সী, যার বয়স ঐ পর্দার ছবিতেই আজো স্থির হয়ে আছেন।

তথ্য ও ছবি: ইন্টারনেট

সারাবাংলা/এএসজি

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন