বিজ্ঞাপন

মাঠপর্যায়ে আমলারা মার খাচ্ছেন কেন?

April 9, 2021 | 8:12 pm

মোস্তফা কামাল

দেশের কোথাও ৮ এপ্রিল তৃণমূলের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নাজেহাল বা বিব্রত হওয়ার খবর নেই গণমাধ্যমে। কেন? বৃহস্পতি তুঙ্গে বলে? এদিন তাদের বেশিরভাগই কর্মস্থলে ছিলেন না। ঢাকার সাভারে এসেছেন ৭১তম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স সমাপনী অনুষ্ঠানে। সেখানে ভার্চুয়ালি প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন। তৃণমূলে মানুষকে করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধি মানায় বাধ্য করতে তাদের নির্দেশনামূলক পরামর্শ দেন। ৭১তম এই বুনিয়াদি কোর্সে এবার কেউ ফেল করেননি। ৩০৭ জন কর্মকর্তার সকলকেই কৃতকার্য করা হয়েছে। তাদের ২২৮ জন পুরুষ এবং ৭৯ জন নারী।

বিজ্ঞাপন

প্রশিক্ষণে তো কামিয়াবি হলেন। ফিল্ডে মাঠে-ঘাটে কেন কামিয়াবি না হয়ে মার খাচ্ছেন? তা-ও ছ্যাঁচা মার। কী এমন অপরাধ তাদের? প্রশিক্ষণটির মাত্র ক’দিন আগে ফরিদপুরের সালথার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা- ইউএনও এবং সহকারী কমিশনার ভূমি- কেন নাজেহাল হন। সরকারের আরোপিত আইন-বিধিনিষেধগুলো এই কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন বা প্রয়োগ হয়। এছাড়া, ২৬-২৮ মার্চ ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এক ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই জেলা প্রশাসকের বাসভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, থানা, ফাঁড়ি, ভূমি কার্যালয়সহ ৩১টি সরকারি ও আধা সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এসব ঘটনা কি বিশ্লেষণের বিষয় নয়? দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাঝেমধ্যেই তৃণমূলের কর্মকর্তারা মার খাচ্ছেন। সরকারি দফতর ও স্থাপনায় হামলা হচ্ছে। এসব খবরের কিছু প্রকাশ পাচ্ছে। কিছু মিটমাট হয়ে যাচ্ছে। মারের যন্ত্রণা তো চলে যাচ্ছে না। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতার সময় বিভিন্ন জায়গায় ফাঁড়ি ও থানা আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে। এতে পুলিশের নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই বেশি সতর্ক থাকতে হচ্ছে।

মাঠ পর্যায়ে রাজনীতিকদের সঙ্গে পার্টনারশিপে দলাদলি, অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদাচরণের অভিযোগ আছে আমলাদের কারো কারো বিরুদ্ধে। কেন্দ্রের চেয়ে মাঠ প্রশাসনে অফিসারদের সীমাবদ্ধতা বেশি। আবার আয়েশ-আরাম, শান-মানও বেশি। মাঠ প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার ক্ষমতার সীমানা দুর্দমনীয়। এমপি বা জেলা মন্ত্রীরও তাদের জমাখরচ দিয়ে চলতে হয়। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরাও তাদের তোয়াজ করে চলেন। ক্ষতিগ্রস্তরা রাজনীতিকদের সঙ্গে পেরে ওঠেন না। বাগে পেলে তারা সওয়ার হন আমলাদের ওপর। কখনো কখনো সেয়ানা নেতাকর্মীরা মারের তোড়টা আমলাদের দিকে পাঠিয়ে দেন সূক্ষ্ম কারসাজিতে। তাই বলে যারা সৎ, কর্মঠ, দায়িত্ববান-তারাও সেফ থাকছেন? মোটেই না। পদে-পদে তারাও হেনস্থা হন। নানামুখী সমস্যায় পড়েন। উভয়সংকটে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আজকের এ অবস্থা।

জামালপুরের সাবেক ডিসি আহমেদ কবীরের খাট কাহিনী, কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীনের সাংবাদিক পেটানো, তার অধীন তিন ম্যাজিস্ট্রেট নাজিম উদ্দিন, রিন্টু বিকাশ চাকমা বা এস এম রাহাতুল ইসলামের কী হয়েছিল ক’জন জানে? নাটোরের সাবেক ডিসি গোলামুর রহমানের তার অধীনস্থ নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে যৌন হয়রানি, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের সাবেক ইউএনও আসিফ বিন ইকরামের বিভিন্ন পাথরকোয়ারি থেকে নিয়মিত মোটা অংকের ঘুষের অভিযোগের ফয়সালাই বা জানে ক’জন? মাঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বেশিরভাগই হয় উড়ো চিঠির মাধ্যমে। সেগুলো আমল পায় না। হয় গায়েব, নয় সেন্সর করে ফেলা হয়। ঘটনাচক্রে আমল পেলেও তদন্ত-পুনঃতদন্তের ঘোরপ্যাঁচে পড়ে হারিয়ে যায়। কদাচিৎ শাস্তি হলেও সেটা বদলি পর্যন্তই সার। সেই বদলির কারণও প্রকাশ পায় না। বলে দেওয়া হয়, বদলি চাকরিরই অংশ।

বিজ্ঞাপন

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট ইউএনও ওয়াহিদা খানমের বেদম মার খাওয়ার পর ক’দিন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। আশপাশে তখন আরও নানা কথাও এসেছিল। শেষে তা আর বেশিদূর এগুয়নি। ইউএনওদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ইউএনওদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য একজন পুলিশ গানম্যান এবং বাসভবনের নিরাপত্তায় পুলিশ হাউজ গার্ড দিতে চেয়েছিল। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে একজন প্লাটুন কমান্ডারসহ ১০ জনের আনসার সদস্য দেওয়ার। এ নিয়ে ক’দিন ফাইল চালাচালি হয়। পরে সব তামাদির মতো হয়ে যায়।

ইউএনও এবং এসি ল্যান্ডের ওপর হামলার ঘটনায় মাঠ প্রশাসনের আমলাদের নিরাপত্তার বিষয়টি আবার তাজা হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের ফেসবুক গ্রুপে সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন। পোস্টে তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকারি দফতরে হামলার ঘটনায় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ইউএনও এবং এসি ল্যান্ডদের সতর্ক হতে বলেছেন। যথাসময়ে পুলিশের সহায়তা না পাওয়ার কথাও এসেছে তার লেখায়। সরকারি দফতরে সাম্প্রতিক হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা কেবল কর্মকর্তা নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে উদ্বেগ শেয়ার করছেন। তাদের নিরাপত্তার ঝুঁকি কেবল রাজনৈতিক? মানুষ তাদের প্রতিপক্ষ ভাবছে কেন? এসবের পেছনে আরও কিছু রয়েছে কি-না, দ্রুত ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। রাতের অন্ধকারে সরকারি বাসভবনের একেবারে বেডরুমে ঢুকে ঘোড়াঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার ঘটনার পর আশপাশে আরও নানা ঘটনা সামনে চলে এসেছিল, সেগুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিও বিবেচনার দাবি রাখে।

এ পরিস্থিতি বাংলাদেশে আগে কখনো ছিল না। করোনা পরিস্থিতিতে মাঠ প্রশাসনের সবার প্রতি বার্তা দেওয়া হয়েছে, তারা যেন নিজের সুরক্ষা বজায় রেখে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে সারা দেশে পৌনে পাঁচশ ইউএনও রয়েছেন। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি উপজেলায় সহকারী কমিশনারও (ভূমি) আছেন। বর্তমানে মাঠ প্রশাসনে তাদের কাজের পরিধি বেশি। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় মাঠপর্যায়ে কাজগুলো করতে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। কারণ, মফস্বলে হাটবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে মানুষের বেশ উপস্থিতি থাকছে। আবার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় ত্রাণের চাহিদা বাড়ছে। মোটকথা পরিস্থিতিটা একেবারেই ভিন্ন। বাস্তবতাও আলাদা। প্রশাসনে এখন ভিন্নমতের লোক নেই বললেই চলে। এরপরও ভাঁজভুজে দু-চারজন যারা আছেন তারাও চাকরি রক্ষার খাতিরে বাহ্যত সরকারি দলের সমর্থক বনে গেছেন। সরকারের আনুকূল্যে অপ্রত্যাশিত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে দলটির অনুরক্ত হয়ে পড়েছেন। এই একমুখীতার আহ্লাদে মাঠ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তার আত্মপ্রচারের নেশা রয়েছে। রুটিন কাজ করে তারা তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করেন।

বিজ্ঞাপন

একজন সরকারি কর্মচারীর আচরণ ও জীবনধারা কেমন হবে, তা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এ সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। কিন্তু সেটা এখন না মানলেও চলে। সরকার থেকে মাঝেমধ্যে সেটা মনে করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বেশিরভাগই তা তেমন আমলে নেন না। ছ্যাঁচা মাইর দিতে দিতে তারাও যে সময়ের ব্যবধানে সেই মারে পড়তে শুরু করেছেন অপ্রিয় হলেও এটাই বাস্তবতা। সরকারি ভাষায় অবশ্য ছ্যাঁচা মাইর, চিপা মাইর লেখার কোন বিষয়-আসয় নেই।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট, বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন