বিজ্ঞাপন

লু হাওয়ায় কৃষকের মাথায় হাত!

April 11, 2021 | 2:02 pm

রাজন ভট্টাচার্য

প্রতি তিন বছর পর একবার হাওর অঞ্চলের ফসল নষ্ট নয়। ২০১৭ সালে দেশে হাওর অধ্যুষিত সাত জেলার ফসল অকাল বন্যায় তলিয়ে যায়। এরপর ২০২০ সাল পর্যন্ত পরপর তিনবার সোনালী ফসল ঘরে তুলতে পেরেছেন কৃষকরা। ভাটি বাংলার একবার উৎপাদন হওয়া ফসলের প্রধান শত্রু অকাল বন্যা, ঝড়-অতিবৃষ্টি-শিলা। অর্থাৎ প্রকৃতির উপর নির্ভর করে এ অঞ্চলের মূল অর্থনীতি ধান। এবারের ফসলে প্রকৃতির থাবা অনেকটাই ভিন্ন। ‘লু’ হাওয়া। গরম বাতাসে পুড়ে গেছে ধান। চোখের সামনে নিমিষেই সবুজ প্রান্তর বিবর্ণ রঙে রূপ নিয়েছে। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে এত ভয়াবহ হয়নি। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জসহ হাওরের কমবেশি সবকটি জেলাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি বিভাগের হিসাবে ২০ ভাগের বেশি ধান নষ্ট হয়েছে। মাথায় হাত পড়েছে কৃষকের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এরকম হয়েছে। অতি তাপমাত্রাই ফসল নষ্টের মূল কারণ। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এ ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ফসলকে কিভাবে রক্ষা করা যেতে পারে এটাই মূল ভাবনার জায়গা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা দিন দিন আরও বাড়তে পারে। কিন্তু ফসল যদি এভাবে নষ্ট হয় তবে দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে। খাদ্য সংকটের ঝুঁকিতে এখন গোটা বিশ্ব। যেসব দেশে বেশি ধানের ফলন হয় সেসব দেশ এখন চাল রফতানি করতে চায় না। করোনা গোটা বিশ্ব পরিস্থিতিকে বদলে দিয়েছে। সবাই এখন নিজেদের বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এই জায়গা থেকে গরম বাতাসে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টিকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

বিজ্ঞাপন

কিছুদিন পরেই হাওরের মানুষের বছরের একমাত্র খোরাক বোরো ধানে সোনালি রঙ ধরতে শুরু করত। ইতিমধ্যে কিছু কিছু এলাকায় টুকটাক ধান কাঁটাও শুরু হয়েছে। ঘরে কষ্টের ফসল তোলার প্রস্তুতির ঠিক আগ মুহূর্তে ধান নষ্ট হওয়ায় কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যে কৃষি সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তারা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে সরকারিভাবে সহায়তা করার আশ্বস্ত করেছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, গত চার এপ্রিল রোববার দেশের অন্যান্য জেলার মতো হাওর অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যায় কালবৈশাখী ও গরম বাতাস (লু হাওয়া)। এতে ফ্লাওয়ারিং স্টেজে থাকা বিআর-২৯ জাতের ধানের ছড়া ফেটে ভেতরের সাদা তরল দুধ শুকিয়ে গেছে। সাদা বিবর্ণ হয়ে পড়েছে ধানের গাছ। এখন ধানের শীষে কোনো ধান দেখা যায় না।

হাওরের কৃষকরা আরও বলেন, তিন বছর আগে বন্যায় আমাদের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই আকস্মিক ঝড়ে আমাদের বছরের একমাত্র বোরো ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দুই চোখে এখন অন্ধকার দেখছি।

বিজ্ঞাপন

কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ছাইফুল আলম বলেন, জেলায় সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয়েছে করিমগঞ্জ, তাগড়াইল ও ইটনা উপজেলায়। ধান পরাগায়ণ পর্যায়ে ৩০ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রায় ধানের পূর্ণতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঝড়ের সময় ৩৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় প্রচণ্ড বেগে বাতাস বয়ে যাওয়ায় জেলার ১৩টি উপজেলায় ২৫ হাজার ৮৯৫ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। মদন, খালিয়াজুড়ি, মোহনগঞ্জ সহ নেত্রকোণার ছয়টি উপজেলার প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে।

এবার প্রায় অর্ধ লাখ হেক্টরের বেশি জমির ফসল কোনো না কোনোভাবে এ ‘হিট শকের’ মুখে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। এতে ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকা হতে পারে। কৃষিতে এক যুগের মধ্যে এমন বড় ধরনের ‘হিট শক’ ঘটেনি বলে জানান কৃষি বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর গণমাধ্যমকে বলেন, মার্চের শেষ সপ্তাহে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল। এখন ধানের জন্য ক্রিটিক্যাল টেম্পারেচার ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর উপরে যদি তাপমাত্রা উঠে এবং এসময় যদি ফুল ফোটে সেগুলো শুকিয়ে যেতে পারে। ফুল ফোটার সময় ১-২ ঘণ্টা এ তাপমাত্রা বিরাজ করলে মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

ব্রি-এর মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগ) ড. মুন্নুজান খানম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ২০০৭ সালের পরে এ ধরনের হিট শক আর ঘটেনি। তাপপ্রবাহের মধ্যে কালবৈশাখীও থাকে। কিন্তু যখনই তাপপ্রবাহ হয় এবং সে সময় বৃষ্টি থাকে না তখনই ধানের জন্য তা হিট শক ঘটে। অর্থাৎ বৃষ্টিহীন তাপপ্রবাহের সময় ধানের ফুল এলে তা শুকিয়ে যায়।

ব্রি মহাপরিচালক জানান, এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজার হেক্টর জমি এফেক্টেড হয়েছে। এটা বিভিন্ন লেভেলে। কোনো কোনো জমি ৮০ ভাগ পর্যন্ত, কোনো জমি ৫-১০ ভাগ; আবার পাশে ভালোও রয়েছে। যেখানে ফ্লাওয়ারিং পর্যায়ে ছিল না, সেখানে খুবই সুন্দর রয়েছে, যেখানে ফ্লাওয়ারিং ছিল সেটাতে ৭০-৮০ ভাগ ক্ষতি হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের শীর্ষ ব্যক্তিরা ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে তীব্র তাপদাহের এমন পরিস্থিতিতে ‘হিট শক’ থেকে ধানের ফুল বাঁচাতে জমিতে পানি ধরে রাখা এবং পরবর্তীতে পাতাপোড়া থেকে রক্ষায় বিশেষ স্প্রে ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

ব্রি-এর মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবীর বলেন, এ মুহূর্তে জমিতে অন্তত ২-৩ ইঞ্চি পানি রাখার জন্য বলছি। যাতে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও পানি থাকলে তা কুলিং সিস্টেম হিসেবে কাজ করবে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে যদি তাপমাত্রা রাখা যায়, তাহলে এ সমস্যা হবে না।

বিজ্ঞাপন

যেখানে ঝড় হয়েছে, সেখানে পাতাপোড়া রোগ হতে পারে বলে সতর্ক করে তিনি বলেন, সেখানে ৬০ গ্রাম এমওপি সার, ৬০ গ্রাম থিওভিট ও ২০ গ্রাম জিংক ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে বিকালে ৫ শতক জমিতে স্প্রে করতে হবে।

গত সাত এপ্রিল নেত্রকোনার বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে কৃষি সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম বলেছেন, কৃষকদের পাশে থাকবে সরকার। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আর্থিক সহযোগিতা করার কথাও জানান তিনি।

শেষ কথা হলো দেশের কৃষককে যে কোনো মূল্যে বাঁচাতে হবে। কৃষক বাঁচলে কৃষি উৎপাদন হবে। আর উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য সব রকম দুর্যোগ মোকাবেলা করে যেন ফসল ঘরে তোলা যায় সে ধরণের প্রযুক্তির বিকল্প নেই। এজন্য চাই নতুন নতুন গবেষণা আর দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি। লু হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা যেন দ্রুত সময়ে সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পান তা নিশ্চিত করা জরুরি। তা না হলে অনেক কৃষক ধার দেনা করে ফসল উৎপাদনে নামেন। অনেকে এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নেন। যারা এভাবে অর্থ সংগ্রহ করেছেন তারা আরও বেশি ক্ষতির মুখে পরবেন। দেনা মিটিয়ে কৃষক যেন ভালোভাবে বাঁচতে পারে সরকার সে চেষ্টাই করবে এমন প্রত্যাশা সবার। তাহলে আগামীতে এই কৃষকরা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে আবারো বোরো উৎপাদনে মাঠে নামবেন। জয় হোক কৃষি আর কৃষকের।

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন