বিজ্ঞাপন

‘জীবন ও শিল্পের এমন শুদ্ধতম মিলন কালেভদ্রে ঘটে’

April 11, 2021 | 2:43 pm

এন্টারটেইনমেন্ট করেসপনডেন্ট

রবীন্দ্রনাথের গানে আজন্ম নিবেদিত এক শিল্পীর নাম মিতা হক। রবীন্দ্রনাথের গানই ছিল যার জীবনের একমাত্র ব্রত। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অমিয় ধারায় নিজেকে সিক্ত করার পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মাঝেও ছড়িয়ে দিয়েছেন তার সঙ্গীত লব্ধ জ্ঞান। নিরলস চেষ্টা ও অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে আকড়ে ধরে সঙ্গীত সাধনায় নিমগ্ন উজ্জ্বলতম এই নক্ষত্র হারিয়ে গেলেন চিরতরে।

বিজ্ঞাপন

রোববার (১১ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ৩১ মার্চ করোনায় আক্রান্ত হন মিতা হক। এরপর করোনা নেগেটিভ হলে বাসায় ফেরেন। গতকাল শনিবার কিডনি ডায়লাইসিসের সময় তার প্রেসার ফল করে। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা জানান, তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। পরে তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়।

সঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০২০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন মিতা হক

সঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০২০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন মিতা হক

মিতা হকের জন্ম ১৯৬২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায়। সঙ্গীতপ্রেমী পরিবারে বড় হওয়ায় গানের জন্য আলাদা কোনো স্কুল বা একাডেমিতে ভর্তি হননি। তার চাচা দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক ও রবীন্দ্র গবেষক ওয়াহিদুল হক। প্রথমে চাচা ওয়াহিদুল হক এবং পরে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান ও সনজিদা খাতুনের কাছে বাড়িতেই গান শেখেন তিনি। মাত্র ১১ বছর বয়সে বার্লিনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শিশু উৎসবে অংশ নেন তিনি। ১৯৭৬ সাল থেকে তিনি তবলা বাদক মোহাম্মদ হোসেন খানের কাছে সঙ্গীত শেখা শুরু করেন। ১৯৭৭ সাল থেকে নিয়মিত তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে সঙ্গীত পরিবেশনা করেন। মিতা হক ছিলেন বাংলাদেশ টিভি ও বেতারের সর্বোচ্চ গ্রেডের তালিকাভুক্ত শিল্পী।

এককভাবে মুক্তি পাওয়া ২৫টি অ্যালবাম আছে তার। এর মধ্যে ১৪টি ভারত থেকে ও ১১টি বাংলাদেশ থেকে। তার প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম ‘আমার মন মানে না’ প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। সঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১৬ সালে শিল্পকলা পদক এবং ২০২০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।

বিজ্ঞাপন

সুরের এই মহান সাধক ‘সুরতীর্থ’ নামে একটি সঙ্গীত প্রশিক্ষণ দল গঠন করেন, যেখানে তিনি পরিচালক ও প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপালন করতেন। পাশাপাশি ছায়ানটের রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের প্রধান হিসেবে গান শিখিয়েছেন বহুদিন ধরে। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদে প্রথমে সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তী সময়ে সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

ব্যক্তিগত জীবনে মিতা হক অকাল প্রয়াত স্বনামধন্য অভিনেতা-পরিচালক নাট্যজন খালেদ খানকে বিয়ে করেন। তাদের একমাত্র সন্তানের নাম ফারহিন খান জয়িতা। উল্লেখ্য, জয়িতাও একজন সম্ভাবনাময় সংগীত শিল্পী হিসেবে আমাদের সংগীত ভূবনে বিশেষ দৃষ্টি কেড়েছেন।

বিজ্ঞাপন

বাঙালি সংস্কৃতির শুদ্ধতায় নিমগ্ন এই শিল্পী অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে শুধু ধারণ ও লালনই করেননি, নিরন্তর সচেষ্ট ছিলেন তার বিকাশেও। শিল্প-সংস্কৃতির নানান ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে মিতা হক অকাল প্রয়াত স্বনামধন্য অভিনেতা-পরিচালক নাট্যজন খালেদ খানকে বিয়ে করেন

ব্যক্তিগত জীবনে মিতা হক অকাল প্রয়াত স্বনামধন্য অভিনেতা-পরিচালক নাট্যজন খালেদ খানকে বিয়ে করেন

দীর্ঘ পাঁচ বছর কিডনি রোগেও ভুগছিলেন এই শিল্পী। নিয়মিত ডায়ালাইসিস চলছিল। কিন্তু এবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মানসিক ও শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েন। শত চেষ্টাতেও আর ফেরানো গেলো না তাকে।

এমন একজন গুণী শিল্পীর অকাল প্রয়াণে শোকাচ্ছন্ন দেশের সংস্কৃতি অঙ্গন। দুঃখ ভারাক্রান্ত কন্ঠে শোক জানিয়েছেন প্রথিতযশা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। মিতা হকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘তার এভাবে চলে যাওয়াটা খুবই দুঃখজনক। আমাদের পথচলাটা একসঙ্গে, আর হঠাৎ করেই সেটা থেমে গেল? মেনে নিতে পারছি না। আর যাওয়াটা এমন একটা সময়ে শেষ দেখা পাওয়ারও সুযোগ নেই। প্রার্থনা করি, এভাবে যেন আর কাউকে না হারাই।’

শিল্পী মিতা হকের মৃত্যুতে গভীর শোক ও হতাশা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ লিখেছেন, ‘আহা! অমন পরিশীলিত সুরেলা কন্ঠের দেখা মেলা ভার। আর মিলবে কি না জানি না। জীবন ও শিল্পের এমন শুদ্ধতম মিলন কালে ভদ্রে ঘটে। আনন্দের মাঝেই জীবন উথলিয়া ওঠে একথা মিতাকে দেখলেই মনে হতো।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও লেখেন, “দুঃখকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে জীবনের আনন্দে শিশুর মত করতালি দিতো মিতা। এইতো মাত্র সাতদিন আগে হাসপাতাল থেকে ফোনে চিৎকার করে বলে- বাচ্চুভাই, আমারতো এইখানে ভাল্লাগেনা, ভাল্লাগেনা, ভাল্লাগেনা। আমারে বাসায় নিয়ে যায় না কেন। তার দু’তিনদিন পর কন্যা জয়ীতা ও সন্তানসম শাহীন ওদের করোনামুক্ত মাকে কেরাণীগঞ্জের বাসায় নিয়ে যায়। কিন্তু পরশু হঠাৎই শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে আবারও হাসপাতাল। আর আজ প্রত্যুষে আমার কন্যা এশা ও পুত্রবৎ সাকি হাসপাতাল থেকে ফিরে জানালো ‘মিতামা’ মারা গেছে। আমি নির্বাক। নিস্তব্ধতায় নিমজ্জিত হই। ভাবি মিতার মত জীবনকে ভালেবাসতে আমি কাউকে দেখিনি। এমনভাবে কাউকে জীবন উদযাপন করতে দেখিনি। শত কষ্ট-দু:খের মাঝে কলকলিয়ে এভাবে হাসতেও দেখিনি কাউকে… চোখের জলে চৈত্রের ভোরের আকাশটাকে ধূসর দেখতে থাকি। ভাবী ওই ধূসরে মিলিয়ে গেলে মানুষ আর কখনো ফিরে আসে না…

‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী… আমি অবাক হয়ে শুনি কেবল শুনি…’
বিদায় প্রিয় মিতা হক।”

সারাবাংলা/এএসজি/এএম

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন