বিজ্ঞাপন

মজিদ মাহমুদ ও  মাহফুজামঙ্গল

April 16, 2021 | 1:30 am

শিশির মল্লিক

কবি মজিদ মাহমুদ শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনের পরিচিত মুখ। কবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণাগ্রন্থ, উপন্যাস, অনুবাদ ও গল্পগ্রন্থ মিলে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কম নয়। ৩৫ বৎসরের সাহিত্যচর্চায় তার বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫০ এর কাছাকাছি। ‘মাহফুজামঙ্গল’ এর প্রকাশ ১৯৮৯ সালে অর্থাৎ আমাদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তখন সামরিক শাসনের বুটের তলায়। উত্তাল একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে কবির মানসপট কীভাবে আন্দোলিত হচ্ছিল তা পর্যবেক্ষণ আমাদের কৌতূহলী করে বৈকি! নিচের পঙক্তির দিকে তাকায়-

বিজ্ঞাপন

‘তোমার নামে কোরবানি আমার সন্তান

যূপকাঠে মাথা রেখে কাঁপবে না নব্য ইসমাইল।

মাহফুজা তোমার শরীর আমার তছবির দানা

বিজ্ঞাপন

আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায়।’

(কবিতা: এবাদত)

দেশমাতৃকার নামে আত্মোৎসর্গ বা সন্তানের বলিদানে পিতা যেমন দ্বিধাহীন সন্তানও নির্ভীক। যে দেশমাতৃকাকে তিনি তছবির দানার সাথে তুলনা করছেন। (মাহফুজাকে এখানে আমরা স্বদেশ ভেবে নিতে পারি) যার স্পর্শ, সান্নিধ্য আর প্রার্থনায় কবি তার একাগ্রতা ও পবিত্রভাবের কথা ব্যক্ত করেছেন। ’৯০ এর দশককে ক্ষমতাশীন দলগুলো স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলে। আমরা জানি, এদেশ শুধু নয় ভারতীয় উপমহাদেশে পুরো জনগোষ্ঠীর সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রামের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। সেই জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কি করে সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা আশ্রিত বা পালিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে হাত বদল হয় তার ইতিহাস কে না জানে। অথচ ইতিহাসের মহানায়ক হয়ে দাঁড়ায় সেইসব বিশ্বাসঘাতক রাজনৈতিক নেতৃত্বই। প্রকারান্তরে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস দীর্ঘতর হতে থাকে। পাকিস্তানী শাসনের পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয় কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রামের শেষ হয় না। নব্য শাসক শ্রেণি হিসেবে এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা অংশ ক্ষমতাসীন হয়। শ্রেণি উত্তরণ ঘটে তাদের। তারাই পরবর্তীতে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোশকতায় ব্যাপক ধন-সম্পদের মালিক হয়। এরাই হয়ে উঠে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদের নতুন প্রতিনিধি। এই শ্রেণিগুলোর সমন্বিত উদ্যোগে দমন করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ের গণঅসন্তোষ বা গণসংগ্রামগুলো। এ সংগ্রামগুলোর কোনটিকে বলা হয় সামরিক শাসন বিরোধী সংগ্রাম, কখনো বলা হচ্ছে স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম। ’৯০ এর দশককে বলা হচ্ছে স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম। ক্ষমতায় যিনিই থাক না কেন ক্ষমতা ক্ষমতাশালী জনগোষ্ঠীর হাতেই। জনসাধারণের হাতে আসেনি। অতএব জনগণের গণতান্ত্রিক ক্ষমতার জন্য সংগ্রাম আজো নিষ্পত্তি হয়নি। ভবিষ্যতে হবে কি না জানি না। গণতন্ত্র একটি স্বাপ্নিক উপাখ্যান হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিজ্ঞাপন

’৯০ এর দশক এবং তৎপরবর্তী কবিতায়ও কবি মজিদ মাহমুদ আমাদের সমাজবাস্তবতার নানা টানাপোড়েন, সংগ্রাম সাহস ও উদ্দীপনার ছবি এঁকেছেন। নিজের সততার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছেন। আশ্বস্থ করেছেন, যুদ্ধের ইতি টানেননি, সন্ধি করেছেন। বলছেন-

‘অনেক হয়েছে লড়াই এবার সন্ধির পালা

ক্লান্ত সৈনিকেরা অনন্ত ঘুমের কোলে নিয়েছে আশ্রয়

দূরাগামী অশ্বে সোয়ার হয়ে যারা এসেছিল প্রান্তরে

বিজ্ঞাপন

কিংবা অগ্রগামী পদাতিকের বেশে

তারা আজ কেউ নেই যুদ্ধের ময়দানে…

… তুমি একাকি দাঁড়িয়ে আছ বিধ্বস্ত সমর প্রান্তরে

আমিও আজ হৃতসর্বস্ব ভিক্ষুকের বেশে

অথচ তুমি ছিলে মহারানি ভিক্টোরিয়া

আর আমি মহীশাসুরের টিপু সুলতান

তবু কেউ আজ পরাস্ত নই- সন্ধি তো যুদ্ধের নিয়ম।

এখানে কবি আপাত সন্ধি করছেন শত্রুর সাথে। দুজনের কেউই পরাস্ত হয়নি। এবং এই সন্ধি যে আপেক্ষিক তারও ইঙ্গিত আছে। মাহফুজা এখানে স্বদেশ। যে স্বদেশ একসময় বৃটিশ রাজের অধীন ছিল মহারানী ভিক্টোরিয়া তার উপমা হিসেবে এসেছে। আর তার বিপরীত লড়াইয়ে প্রেমিক টিপু সুলতানকে তিনি ইতিহাসের নায়ক হিসেবে তুলে এনেছেন। সরল কিন্তু অর্থপূর্ণ এবং ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত দুটো চরিত্রকে তিনি কবিতা নির্মাণে চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন।

স্বদেশ, প্রকৃতি, কিংবা প্রিয়ার প্রতীক হিসেবে কাব্যলক্ষ্মী মাহফুজার কাছে কবির আর্তি, অনুযোগ, ক্ষোভ, হতাশা, দ্রোহের হুঙ্কার কখনো কখনো আত্মনিবেদন- একজন সত্যিকার মানবিক অভিব্যক্তির প্রতিমূর্তি হিসেবে কবি মজিদ মাহমুদ আমাদের ভেতরে নাড়া দেন।

মাহফুজামঙ্গল কাব্যসংকলনটি আমার কাছে আইডিয়ালিস্ট ঘরানার মনে হয়েছে। প্রতিটি কবিতার ভাব ও বিষয় একটি নির্দিষ্ট বিষয়কেন্দ্রিক এগিয়েছে।

‘মাহফুজামঙ্গল’ ‘এক’ এ কবি বলছেন-

‘আমি আজ নামগোত্রহীন অখ্যাত যুবক

ক্ষুধা ও অজন্মার ভয়ে মানুষের অনুগ্রহ করেছি ধার।

এ অসহায়ত্বের সাথে সাথে তিনি পরের পঙক্তিতে মুক্তির কারণ সম্পর্কে জ্ঞাত করছেন –

‘আমি জানি না কী করে মুক্তি পেতে পারি এই ক্লেদাক্ত জীবন

আজ রাতে এক সৌম্যমান কান্তিমান বৃদ্ধ বলে গেল এসে

তোমাকে জানতে হবে পৃথিবীতে জীবন্ত লোক কীভাবে আসে

সেই ইতিহাসে লেখা আছে তোমার মুক্তির সঠিক কারণ।

‘মাহফুজামঙ্গল’ ‘দুই’ এ বারো মাসের অপ্রাপ্তির যে বর্ণনা আমরা পাই তার কাব্যিক মাধুর্য্য যা পাঠককে পুনর্বার পাঠে আগ্রহী করে। মাহফুজামঙ্গল ‘তিন’ এ প্রিয়ার কৃপাগ্রাহী প্রেমিক হৃদয়ের আকুতি চমৎকারভাবে চিত্রিত করেছেন।

‘যদি কোনকালে ফিরাও মুখ আমার বিপরীত

তেজষ্ক্রীয় হয়ে যাবে পৃথিবীর মাটি আর ঘাস

জীবনের শূন্যস্থান ধরে রবে অসম্ভব শীত।

কবি তার প্রেমিকাকে মুখ না ফেরানোর যেসব শর্ত দিচ্ছেন তা রক্ষা না হলে যে হুঙ্কার দিচ্ছেন তা কতটা বিধ্বংসী হতে পারে তা কল্পনা করাও পাঠক মাত্রেই কঠিন। এখানে বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যা জানা থাকতে হবে পাঠক মাত্রেই নতুবা এ উপমা উপলব্ধি করা বা চিত্রকল্পনা করা কঠিনই বৈকি!

‘মাহফুজামঙ্গল’ ‘চার’ এ বলছেন-

‘মাহফুজা তুমি আছ বলেই ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে আমার

না হলে আমি হতাম পৃথিবীর সবচেয়ে যৌক্তিক নাস্তিক।’

কবি নিজের প্রেমকে ঈশ্বরের আগে স্থান দিয়েছেন। অলীক ঈশ্বরের চেয়ে জীবন্ত মাহফুজা তার কছে অনেক বেশি মহার্ঘ।

‘মাহফুজামঙ্গল’ ‘পাঁচ’ এ কবি মাহফুজার প্রতি টানকে মধ্যাকর্ষণ শক্তির বাঁধনের মতো ভাবছেন যার টানে তিনি তার বুকেই পতিত হন। বিচ্ছিন্ন হন না কোনকিছুতেই। মাহফুজামঙ্গল ‘ছয়’ এ কবি জীবন জবান সবকিছুর কারণ এবং তিনি মাহফুজার ভার বহনে আশ্বস্ত করছেন।

‘সাত’ এ কবির প্রিয়তমা প্রতি উপেক্ষা অরক্ষিতাবস্থা তার শরীরের মাংসের কেনাবেচা, শিয়াল ও শকুনের ভোগ হয়ে ওঠাকে কোনভাবে মানতে পারেন না। তিনি আবার বলছেন-

আমার মতো যদি শতকোটি মানুষের প্রণাম তোমার পায়ে

নামলে হয়তো বা পেতে পারি ক্ষমা।

এ মাহফুজা কাব্যলক্ষ্মী দেশ, ভূগোল, প্রেমিকা যে দৃষ্টিতে দেখি না কেন এ তিন ছাড়া কি কবি কিংবা পাঠক কে বাঁচতে পারে? বা বাঁচতে চান? এ সত্যটিকে কবি পাঠকের মাঝে অলক্ষ্য থেকে লক্ষ্যে আনার প্রয়াস পেয়েছেন। ভাবনাটি নতুন নয়। অর্থাৎ বিষয়বস্তু চিরায়ত। তাহলে আলোচনা আসতে পারে তার উপস্থাপন ঢঙ ও শিল্পরস আনয়নের পারদর্শিতা তিনি কতটা সফলভাবে কিংবা অভিনবত্ব আনতে পেরেছেন? আমরা ষাটের দশকের কবি আল মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ সোনালী কাবিন’র কথা জানি। সে ক্ষেত্রে সোনালী কাবিন এর ঢঙ বা অভিনবত্ব আর ‘মাহফুজামঙ্গল’ এর ঢঙ বা অভিনবত্ব কতটুকু নতুনত্বের দাবিদার?

দুটো সময়ই বলতে গেলে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট। একটি যুগসন্ধিক্ষণে সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন অন্যটিতে তথাকথিত গণতন্ত্র। এ দুটোর সবলতা আর দুর্বলতা এ প্রেক্ষাপটের সাথে অলঙ্গনীয়।

‘মাহফুজামঙ্গল’ যেহেতু একটি দীর্ঘ সময় ধরে লেখা কবিতার সংকলন সেহেতু লেখার সাথে কবির গভীর জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতার ঋদ্ধতার প্রতিফলন লক্ষ্যণীয়। বিশেষ করে যুদ্ধমঙ্গল অংশের সাতটি কবিতা চমৎকারভাবে আমাদের সমাজ ও রাজনৈতিক পঠভ‚মিকে চিত্রায়িত করতে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন শিল্পরস ও মানকে সমুন্নত রেখেই। যুদ্ধমঙ্গল ২ এর কয়েকটি লাইন উল্লেখ না করে পারছি না যার ভিতর আমাদের সমাজবাস্তবতা কতটা গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে তিনি দেখেন এবং শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করেন তার প্রমাণ রয়েছে। যেমন-

‘মাহফুজা আমরা যাতে যুদ্ধ থেকে না পালাই, সে জন্য আমাদের পশ্চাতে নিয়োজিত প্রশিক্ষিত কুকুরবাহিনী। আমাদের সামনে শত্রুর তরবারি; পিছনে ততোধিক নিষ্ঠুর সম্রাট বাহিনী। মাহফুজা, কথা হলো, কে আমাকে যুদ্ধে নামিয়েছে?’

এ প্রশ্নটি এখন আমাদের সকল নাগরিকের। যে কঠিন জীবনসংগ্রাম আমরা করতে বাধ্য হই তা কার জন্যে?

যুদ্ধমঙ্গল ৪ এ বলছেন- ‘… যুদ্ধ ছাড়া যদি না থাকে রাষ্ট্র-তাতে ক্ষতি কি! তুমি কী বলবে যুদ্ধ ও রাষ্ট্র সমার্থক? তাহলে আমি বলি দুটিরই অবসান হোক তবে।’

যত মহাপুরুষই যুদ্ধের বিরোধিতা করুক বা শান্তির কথা প্রচার করুক না কেন যুদ্ধ ছাড়া যে তার রাজ্য বা রাষ্ট্র থাকে না। সম্রাট অশোকের প্রসঙ্গটি উপমা হিসেবে এনে তিনি তার রাজত্ব করাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। কবি বিশ্বাস করেন যুদ্ধই বাস্তবতা। সমাজে যতদিন শ্রেণি আছে, শ্রেণি সংগ্রামও থাকবে। অতএব রাষ্ট্রও বহাল তবিয়তে থাকবে। যদি এটিই ইতিহাস কিংবা বিজ্ঞান হয় তবে দু’টোরই অবসান তিনি কামনা করেছেন। তার এ চাওয়া মার্কসবাদী সাম্য চেতনার প্রতি ইঙ্গিত করে বৈকি!

পরের কবিতা ‘যুদ্ধমঙ্গল’- ৫- এ তিনি আরো বলছেন – ‘তবু বলি মাহফুজা, যুদ্ধ ছাড়া আর আমাদের আছে কী বাকি।’ আবার পরের পংক্তিগুলোতে অস্ত্র নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই, যুদ্ধ জয়ে সেসবের জমাদান যা বর্তমান রাষ্ট্রের রক্ষিদের কব্জায় তা বিবৃত করছেন, আবার বলছেন- ‘একমাত্র গ্রেনেড বিধ্বংসী প্রাণ ছাড়া কার্যত আমাদের আর কোনো অস্ত্র নেই।’

সমরাস্ত্র না থাকলেও মানবিক শক্তির বিধ্বংসী ক্ষমতা যে কোন পারমাণবিক শক্তিকে ধ্বংস করতে পারে তার প্রতি ইঙ্গিত করছেন।

সারাবাংলা/আরএফ/একেএম

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন