বিজ্ঞাপন

হেফাজতের তাণ্ডব ও কথিত অসাম্প্রদায়িক নেতৃত্ব!

April 17, 2021 | 4:57 pm

রাজন ভট্টাচার্য

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম উদাহরণ বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল। অতিথি পরায়ন হিসেবে সুনাম আছে এসব এলাকার মানুষের। বিপদে আপদে একে অপরের পাশে থাকা, সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের একসঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব উদযাপন রীতিতে পরিণত হয়েছে এখানে। বোরো মৌসুমে একজনের গরু আরেকজন ধার নিয়ে হালচাষ থেকে শুরু করে গাড়ি দিয়ে বাড়িতে ধান আনার কাজ পর্যন্ত করেন। সংস্কৃতিসমৃদ্ধ শান্তি আর সম্প্রীতির এই জনপদ এখন হটাৎ করে উত্তপ্ত!

বিজ্ঞাপন

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাশাপাশি সুনামগঞ্জের শাল্লা আর ধর্মপাশা উপজেলায় হেফাজত ইসলামের সমর্থকদের সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা দেশবাসীসহ গোটা বিশ্বের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। আমার কাছে মনে হয় এটি সুপরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে জানান দিতে চেয়েছে তাদের শেকড় এখন তৃনমূল পর্যন্ত! সময় বলছে বিষয়টিতে আর সাধারণ দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই।

সবচেয়ে বড় কথা হল গত ১২ বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে’কটি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে সবকটিতে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন কোন না কোনভাবে জড়িত ছিল। এতে ব্যাপকভাবে রাজনীতিক ফায়দা লুটেছে জামায়াত, বিএনপি সহ কথিত হেফাজতিরা।

কোন ঘটনায় নেপথ্যে থেকে মূল খল নায়কের চরিত্রে কাজ করেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। কোথাও প্রকাশ্যে হামলায় জড়িত ছিল আওয়ামী লীগের লোকজন। এটিকে দলের দোষ বলছি না। তবে আসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ স্থানীয় নেতৃত্ব নির্বাচন করতে ভুল করেছে। অনেক সময় টাকা খেয়ে যার তার হাতে দলের নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার অভিযোগ শোনা গেছে। এভাবে আওয়ামী লীগ সেজে মৌলবাদী মানসিকতা নিয়ে দলে ভিড়েছে কথিত চেতনাধারী মানুষ। যার দায় দল কখনই এড়াতে পারে না। পারবেও না। এজন্য আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযান জরুরি।

বিজ্ঞাপন

এই অপকর্মের ফলাফল হল দেশের যেকোন এলাকায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় দলের লোকজনের নাম আগে আসছে। এজন্য আসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ আলোকিত মানুষ, বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগের প্রতি নাখোশ হচ্ছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু না বলে নীরব ভূমিকা পালন করছেন তারা। কেউবা নিজেকে গুটিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। দিন শেষে ক্ষতিটা হচ্ছে আওয়ামী লীগের। এটা কখনোই সাধারণ মানুষ কামনা করেনি। যেমন চায়নি হেফাজততে লাই নিয়ে ঘাড়ে ওঠানো।

সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দুদের গ্রামে হামলায় ‘মূল আসামি’ শহীদুল ইসলাম স্বাধীন ওরফে স্বাধীন মেম্বারকে ঘটনার কয়েকদিন পর পুলিশ গ্রেফতার করে। তিনি স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। গত ১৭ মার্চ হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের সমালোচনা করে পোস্ট দেয়ার জেরে সুনামগঞ্জের শাল্লার হিন্দুদের ৬০-৭০টি বাড়িঘর ভাঙচুর করে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। দেশের অন্যান্য জেলার মতো এখানেও পবিত্র স্থান মসজিদের মাইক ব্যবহার করে হামলার জন্য গ্রামবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। পবিত্র স্থানের মাইককে কাজে লাগিয়ে মহা অপবিত্রের কাজটি করেছে হেফাজতের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি। হামলায় নেতৃত্বদাতা হিসাবে স্বাধীন মেম্বারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে আসে। জলমহালকে কেন্দ্র করে স্থানীয় হিন্দুদের সঙ্গে তার বিরোধ চলছিল। হেফাজত ইস্যু কাজে লাগিয়ে এই মেম্বার ঘটনার প্রতিশোধ নিয়েছেন।

ঘটনার পর হবিবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুলের করা মামলায় ৮০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত পরিচয় আরও ১০০ জনকে আসামি করা হয়। যাদের মধ্যে পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করলেও সাম্প্রদায়িক মানুষগুলোর মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা হয়ত কোন কিছুতেই আর পূরণ করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সামাজিক ঐক্য, একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, সম্পর্কেও টানাপোড়েন সৃষ্টি হবে আজীবনের জন্য। নির্যাতিত মানুষ যেসব হামলাকারীদের চিনেছেন তারা কোনদিনও একবারের জন্যও মন থেকে সেই তাণ্ডবের স্মৃতি সরাতে পারবেন না। সেই ভয়ঙ্কর চেনা মুখগুলো কোন দিনও স্মৃতি থেকে মুছে যাবার নয়। এই কষ্টে হয়ত অনেকে এলাকা ছেড়ে শহরে যাবেন। কেউ হয়ত দেশ ছাড়বেন। হয়ত পথ চলায় আবারও হামলাকারীদের সঙ্গে দেখা হবে…। তারা বীরপর্দে ঘুরে বেড়াবেন। ফের হামলার হুমকি দেবেন!

বিজ্ঞাপন

সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলায় এরকম আরেকটি ঘটনা ঘটলো। জানা গেছে, উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রামের বাসিন্দা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের উপ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আফজাল খান হেফাজতের তাণ্ডব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। এই পোস্টকে ঘিরে ছয় এপ্রিল মঙ্গলবার বিকেলে নিজ এলাকায় তিনি লাঞ্ছিত ও অবরুদ্ধ হন। জয়শ্রী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম আলমের ছেলে আল মুজাহিদসহ স্থানীয়রা তাকে লাঞ্ছিত করেন এবং আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। আবুল হাশেম আলম সেখানে নিজে উপস্থিত থেকে কোনো প্রতিকার না করে ছেলেকে সমর্থন করেন। এক পর্যায়ে আফজাল খানকে পুলিশ গ্রেফতার করে। যদিও শেষ পর্যন্ত এ ঘটনায় হাশেমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

এর আগে নাসিরনগর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লী, ভোলার বোরহান উদ্দিনসহ বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনায় আওয়ামী লীগের লোকজনও কোন না কোনভাবে জড়িত ছিল। সময় বলছে, সঠিক নেতৃত্ব ঠিক করে দলের তৃণমূল যেমন গোছানো জরুরি, তেমনি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কোন অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। দলে ঘাপটি মেরে থাকা অপশক্তিকে চিহ্নিত করে বের করতে না পারলে সামনের দিনগুলো আওয়ামী লীগ ভাল কাজ করলেও জনমত হারাবে। যার খেসারত দিতে হবে গোটা জাতিকে। আবারো দেখতে হবে হেফাজতি তাণ্ডব।

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই/আরএফ

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন