বিজ্ঞাপন

মে দিবসের অরণ্যে রোদন

May 1, 2021 | 8:41 pm

রা’আদ রহমান

বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে নিহত আহমেদ রেজার লাশ ও আহাজারি করতে থাকা তার মা। গত ১৭ এপ্রিল শনিবার বকেয়া বেতন ও ইফতারের ছুটি নিশ্চিত করার দাবীতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের মিছিলে সংঘর্ষ হয়, এতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ৫ জন শ্রমিক। প্রতিমাসের ১০ তারিখের মধ্যে শ্রমিকরা আগের মাসের বেতন চেয়ে আসলেও বেতন পরিশোধে ২০ তারিখেরও বেশি সময় পার হয়ে যাচ্ছিল। প্রকল্পের শ্রমিকরা সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত কাজ করে থাকেন। রোজা শুরু হওয়ার আগ থেকেই শ্রমিকরা ইফতারের জন্য এক ঘণ্টার বিরতি চেয়ে আসছিলেন।

বিজ্ঞাপন

যেহেতু শ্রমিকদের বেশিরভাগই রোজা রাখেন সে কারণে ইফতারের আগে একঘণ্টার ছুটি মূল নয় ঘণ্টা থেকে কেটে রাখার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন শ্রমিকরা। তা সম্ভব না হলে ইফতারের পর কাজ করে পুষিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু চীনা কোম্পানি কোন দাবীই মানছে না বলে অজুহাত দিচ্ছিল বাংলাদেশের সাব কনট্রাক্টর গ্রুপ। এই আন্দোলন চলছিল বেশ অনেকদিন ধরেই, শেষটাও হতে পারতো দাবী মেনে নিয়ে রক্তপাতহীন। তার বদলে পড়েছে ৫টা লাশ।

৩ ঘণ্টা ওভারটাইমসহ ১২ ঘণ্টা কাজ করতে থাকা শ্রমিকদের এই দাবীগুলো অতিরিক্ত কিছু ছিল না, বরং একেবারেই ন্যায্য প্রাপ্য ছিল। পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিক্ষোভ আকারে বেরিয়ে আসার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের দাবীগুলো বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারত, কিন্তু শ্রমিকদের এই ন্যায্য দাবীগুলো কখনই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে দিনের পর দিন। মানে ব্যাপারটা অনেকটা এমন, লেবারের আবার কিসের রোজা আর কিসের ইফতার? এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নাই। এমনকি চীনা কোম্পানির সাথে আলোচনা চলাকালে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠা শ্রমিকদের একটা অংশ যখন সহিংসতার পথে গেল, পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে লাগলো, পুলিশের ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দিল, তখনও টিয়ারশেল, লাঠিচার্জ, একান্ত বাধ্য হয়ে রাবার বুলেট ব্যবহার করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া যেত। স্থানীয় কেউ যদি শ্রমিকদের উস্কে দিয়েও থাকে, পরে সেটা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল। এরা তো খেটে খাওয়া শ্রমিক, তাদের দাবী ন্যায্য, যেটা পূরণ হলে বা না হলেও তারা আবারও কাজে ফিরতে হবে জীবিকা উপার্জনের জন্য। তাদের উদ্দেশ্য তো জানমাল ধ্বংস বা নিজেদের উপার্জনের জায়গা নষ্ট করা নয়। তারা তো ভয়ংকর সন্ত্রাসী বা দাগী আসামীও ছিল না।

কিন্তু না, বেছে নেওয়া হয়েছে সরাসরি গুলির পথ। পুলিশকে কেউ নির্দেশ দিয়েছে শ্রমিকদের উপর সরাসরি গুলি চালাতে। এমনিতেই এস আলম গ্রুপের নিয়োগ দেওয়া চীনা ঠিকাদার কোম্পানির কর্মকর্তারা বাঙালি শ্রমিকদের সঙ্গে কথায় কথায় দুর্ব্যবহার করত। কাজে একটু ত্রুটি পেলে অপমান করত, এমনকি কোনো শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে আহত হলে তার ক্ষতিপূরণও দিত না বলে জানা গেছে। এসব কারণে চীনাদের উপর ক্ষিপ্ত শ্রমিকেরা যাদের কাছে বিচার চাইতে গেছে, ন্যায্য পাওনা চাইতে গেছে, সেই কর্তৃপক্ষই এদের থামাতে সরাসরি গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছে। কী চমৎকার ন্যায় বিচার!

বিজ্ঞাপন

আজ মহান মে দিবস। যে শ্রমিকদের রক্তে-ঘামে আর অমানুষিক পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে আমাদের আলিশান সুন্দর এই সভ্যতা, সেই শ্রমিক যুগে যুগে ঠিক এইভাবে উপেক্ষিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত আর নিহত হয়েছে নিপীড়ন আর নিষ্পেষণে। মহান মে দিবসে হঠাৎ মনে পড়লো এই রেজা আর তার আহাজারি করা মায়ের ছবিটা। ইদ সামনে, নানাবিধ ঘ্যান ঘ্যান করতে করতে অবশেষে হয়তো সে ইদের আগেই বেতন বোনাস পেয়ে যেত অলৌকিকভাবে, এরপর সেখান থেকে মায়ের জন্য, পরিবারের অন্যদের জন্য ইদের কেনাকাটা করত, রেজার মায়ের হয়তো এখন আহাজারির বদলে সন্তানের সাথে ইদ উদযাপনের কথা ছিল।

সবচেয়ে ভয়াবহ পরিহাসটা হচ্ছে শ্রমিকদের বিক্ষোভ সামলানোর আরও উপায়ের দিকে ভ্রুক্ষেপও না করে রেজার মতো দুর্ভাগা আরও ৪ জনের বুকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া এবং এরপর সেই শ্রমিকদের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করার অচিন্তনীয় ক্ষমতাশালী কর্তৃপক্ষের মাননীয়েরা নিশ্চয়ই এই রমজানে রোজা রেখেছেন। প্রতিদিন নিশ্চয়ই ইফতারের আগেই কাজ শেষ করে প্রিয়জনদের সাথে ইফতার করেন। নানাবিধ পুণ্যের কাজ করে সওয়াব কামাই করেন। তাদের হয়তো বেতন-বোনাসের পরোয়া করতে হয় না, কিন্তু তারপরেও তারা প্রিয়জনদের সাথে ঈদ উদযাপন করবেন। অথচ যে শ্রমিকেরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে স্রেফ নিজেদের প্রাপ্য বেতন যথাসময়ে পাবার আর ১২ ঘণ্টার মধ্যে এক ঘণ্টা ইফতারের জন্য ছুটি দেবার দাবীতে গুলি খেয়ে মরে গেল, এক ঘণ্টার ছুটি চাওয়ায় তাদের চিরতরে ছুটি দিয়ে দেওয়া হলো, তারা আর কোথাও নেই।

এমনকি আমার আপনার প্রতিদিনের বিচার চাওয়ার নানাবিধ ইস্যুর তালিকাতেও নাই। খেয়াল করে দেখেছেন? কবে যেন কিভাবে এই শ্রমিকদের লাশগুলোর বিচার চাওয়ার খাতায় তামাদি হয়ে গেছে। ঠিক যেভাবে পৃথিবীজুড়ে শত শত বছর ধরে আরও লাখ লাখ কোটি কোটি শ্রমিক হত্যার বিচারের দাবী অবলীলায় ভুলে গেছি আমরা। আর শ্রমিকদের হাড়মাংসের উপর গড়ে উঠেছে একের পর এক অট্টালিকার সাম্রাজ্য। শ্রমিকদের লাশগুলো কেন যেন কেবলই তামাদি হয়ে যায়, কী অদ্ভুত না?

বিজ্ঞাপন
প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন