বিজ্ঞাপন

বিএনপি জিয়াউর রহমান হত্যার বিচার কেন চায় না?

May 30, 2021 | 3:20 pm

আর এ শাহরিয়ার

সময়কাল ১৯৮১ সালের ৩০ মে শুক্রবার ভোররাত। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির রাত। ফজরের আজানের কিছু আগে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কিছু সেনা কর্মকর্তার হাতে নিহত হয়েছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আজ সে হত্যাকাণ্ডের ৪০ বছর পূর্ণ হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এই সুদীর্ঘ ৪০ বছরে কি আপনি কোথাও একবারও শুনেছেন বিএনপি জিয়াউর রহমান হত্যার বিচার চায় বা চেয়েছে? ‘জিয়া হত্যার বিচার চাই’— এই শব্দগুলো জিয়াউর রহমানের স্ত্রী; বাংলাদেশের দুইবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, জিয়াউর রহমানের ছেলে তারেক জিয়ার কিংবা বিএনপির কোনো নেতাকর্মীর মুখে কি শুনেছেন? এই স্বাভাবিক কথাটিই কেন শুনি না, এটি কি ভেবেছেন কখনো?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পরেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাঠামো প্রায় ভেঙে পড়েছিলে। তখনকার অনেক সেনা অফিসারের বিশ্বাস ছিল, একটু ঠিকমতো বুদ্ধির খেলা খেলে বন্দুক চালাতে পারলেই ক্ষমতার শিখরে আরোহণ সম্ভব।

একটা ডগ রেস শুরু হয়েছিল যেন। ক্ষমতা দখলের এই লড়াইয়ে চতুরতার সঙ্গে জিয়াউর রহমান জয় পেয়ে যান। সব প্রতিদ্বন্দ্বীদের মেরুদণ্ড ভেঙে মেজর জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন।

বিজ্ঞাপন

১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সময় যে একেবারেই নিস্তরঙ্গ ছিল, তা কিন্তু নয়। জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভ্যুত্থান হয়, যেগুলোতে জিয়াউর রহমানকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। জিয়াউর রহমান সবক’টি অভ্যুত্থান অত্যন্ত শক্ত হাতে দমন করেন এবং প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি সেনা সদস্যকে ফাঁসি বা বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করেন।

ঘটনাচক্রে সেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই নিহত হয়েছিলেন একদল সেনা কর্মকর্তার দ্বারা। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তারিখে একদল সেনা কর্মকর্তা চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা, উদ্দেশ্য আর পরিকল্পনাকারীদের নিয়ে আজও বিভিন্ন প্রশ্ন আছে। আছে নানা অনুসন্ধানের জায়গা।

তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয়টি সম্ভবত এটা যে জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারে কিংবা বিচার চাওয়াতে তার পরিবারের কেউই কখনো আগ্রহী ছিলেন না। বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এতটুকু বোঝা যায়, জিয়াউর রহমানের গঠিত বিএনপি, দলের নেতাকর্মী যারাই আছেন, তারা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক, শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা,  বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা ইত্যাদি নানা আরোপিত উপমা লাগিয়ে মহিমান্বিত করেন। কিন্ত ‍আদতে তাদের কেউই আন্তরিকভাবে জিয়া বা তার মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়।

বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর জিয়াউর রহমান অসংখ্য সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছেন অভ্যুত্থানের অজুহাতে। সেই জিয়াউর রহমান তার বিশ্বস্ত সেনা কর্মকর্তাদের হাতেই চট্টগ্রামে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের দু’দিন পরেই চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা মো. মোকাররম একটি মামলা করেছিলেন ১০ জনের বিরুদ্ধে। প্রধান আসামি মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে ধরে এনে ক্যান্টনমেন্টে বিচারের মুখোমুখি করার আগেই হত্যা করা হয়েছিল। আর অন্যদের সামরিক আদালতের মাধ্যমে ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। যেদিন এই সেনা কর্মকর্তাদের ফাঁসি হবে, তার আগের দিন সে সময়কার ১৫ দলের নেতাদের একটি দল তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তারের সঙ্গে দেখা করে ফাঁসি থামাতে চেষ্টা করেন। কারণ এই মামলার যে ৯ জন আসামি, তারা সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের বীরত্বের বিষয়টি সবার জানা ছিল। ওই ৯ জনের ফাঁসি যেন না হয়, এই আবেদন বিচারপতি সাত্তারের কাছে করেছিল ১৫ দল। কিন্তু  বিচারপতি সাত্তার তাদের আবেদন মঞ্জুর করেননি। পরদিনই বাকি ৯ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল।

৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার প্রায় একবছর পরে ১৯৮২ সালের ১২ জুন তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রুহুল ইসলামের নেতৃত্বে। অন্য দু’জন সদস্য ছিলেন বিচারপতি এ টি এম আফজাল এবং খুলনার সেশন জজ সৈয়দ ফরিদুল ইসলাম। ঠিক হয়েছিল, তারা এটার তদন্ত করবেন যে কারা, কী উদ্দেশ্যে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল এবং হত্যার পেছনের লোকগুলো কারা? অর্থাৎ পরিকল্পনাটা কোথা থেকে হয়েছে, কিভাবে হয়েছে— এই বিষয়গুলো, এই তথ্যগুলো যেন উদঘাটিত হয়।

তিন সদস্যের এই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তদন্ত করে দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন এবং যথাসময়ে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের হাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রতিবেদনটি আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। এ টি এম আফজালকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনারা কি সেই প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছিলেন? এ টি এম আফজাল বলেছিলেন, আমরা যথাসময়ে সেটি জমা দিয়েছি এবং সেটি অনেক পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন। তো সেটি কি প্রকাশিত হয়েছে? এ টি এম আফজাল বলেছিলেন, না, প্রকাশিত হয়নি। এই অপ্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে অনেকেই গবেষণা করেছেন— কী ছিল এই তদন্ত প্রতিবেদনে বা কী থাকতে পারে? যেহেতু এটি প্রকাশিত হয়নি, তাই এটি নিয়ে অনেকেই গবেষণা করেছেন, অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। গবেষণার ফলাফলে তারা যেটা জানিয়েছেন সেটা হলো— যে তদন্ত প্রতিবেদনে জিয়া হত্যার পেছনে জিয়া পরিবারের লোকজন এবং জিয়ার ঘনিষ্ঠ লোকজনের নাম অর্ন্তভুক্ত ছিল। সে কারণেই এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়নি।

পরবতী সময়ে একানব্বই সালে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি যখন ক্ষমতাসীন হয়, তখন বিএনপি সরকারের জিয়া হত্যার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটিকে স্থগিত ঘোষণা করে। এটি সবার মনে প্রশ্ন তৈরি করে, জিয়াউর রহমান বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, বিএনপি সরকার দেশ চালাচ্ছে, ক্ষমতায় আছে, তারা সেই বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হত্যা মামলাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে স্থগিত করল! নিশ্চয়ই গবেষকরা যে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন যে তার পরিবারের লোকজন বা তার ঘনিষ্ঠজনেরা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত আছেন, কোথাও না কোথাও কথাটির মধ্যে সত্যতা আছে।

বিজ্ঞাপন

পরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতাসীন হলে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালের ২৬ নভেম্বর এই মামলাটির ওপর থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়। তার মানে মামলাটি চলতে আর কোনো অসুবিধা থাকার কথা না।

নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে মামলাটি চালু হয়েছিল, এই মামলার সাক্ষী ছিল ৩৬ জন। সাক্ষীদের মধ্যে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া ছিলেন এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীও ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে অর্থাৎ আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামলে এই মামলার সাক্ষী যারা ছিলেন, তারা আদালতে সাক্ষী দেওয়ার তারিখগুলোতেও উপস্থিত হননি এবং প্রায় ১৬৮ বার সাক্ষীদের গাফিলতির কারণে মামলার সাক্ষী নেওয়ার তারিখ পিছিয়েছে। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে নাটকীয়ভাবে আবারও মামলাটি খারিজ করায়।

এখানে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্নটি হচ্ছে— জিয়াউর রহমান একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যে রাজনৈতিক দলের অসংখ্য নেতাকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী এখনো বর্তমান আছেন। তার স্ত্রী দুই দুইবার ক্ষমতায় ছিলেন, ছেলে তারেক জিয়াও ছিলেন ক্ষমতার কাছাকাছি। তারা এই হত্যাকাণ্ড বিচারের মামলাটিকে কেন হিমাগারে পাঠিয়ে দিলেন? কেন তারা জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচারের বিষয়টি নিজেদের থেকে উত্থাপন করলেন না আজ পর্যন্ত? এই বিষয়টি আসলে খুবই রহস্যজনক। কারণ তারা নিজেরা বিচারের দাবি তোলা তো দূরের কথা, বিচারের জন্যে আওয়ামী লীগ সরকার মামলার ওপর থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নিল, কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেই মামলটিকে খারিজ করিয়ে নিল।

জিয়াউর রহমানকে বিএনপি বা দলটির সমর্থকরা প্রায়ই স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক কিংবা ভাঙা সুটকেসের মালিক ছিলেন, তার কোনো সম্পদ ছিল না— এইসব কথা বলে বলে গুণকীর্তনই করেন। কিন্তু কেউই জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচারের বিষয়টি মুখে তোলেন না। তার দলের কোনো লোকজন, তার পরিবারের লোকজন, তার আত্মীয়স্বজন বা তার ঘনিষ্ঠজন— কেউই চান না জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচার হোক।

আমার বাবা জিয়া হত্যার বিচার চাই— এটি কখনো শুনেছেন কি তারেক জিয়ার মুখে? কিংবা স্বামীহারা দুইবারের প্রধানমন্ত্রী  খালেদা জিয়ার মুখে স্বামী হত্যার বিচার চাওয়ার কথা শুনেছেন? কিংবা নিদেনপক্ষে এই বিষয়ে একটি পদক্ষেপের কথা কি মনে করতে পারেন? বিএনপির কোনো নেতাকর্মীর মুখে কি শুনেছেন যে আমাদের নেতা জিয়াউর রহমান হত্যার বিচার চাই?

বরং যে মামলাটি আওয়ামী লীগের আমলে পুনরায় চালু করা হয়েছিল, সে মামলাটিকেও হিমাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে বিএনপি। মামলাটির কার্যক্রম শেষ করে দিয়েছে। বিএপি যতই বলুক যে তারা জিয়াউর রহমানের আদর্শের অনুসারী, জিয়াউর রহমানের নামে কোনো সমালোচনা শুনলে তাদের রক্ত গরম হয়ে যায়, কিন্তু এগুলো যে লোক দেখানো তা যে কেউই বলবে।

আপনারাও একটু বিবেচনা করে দেখবেন। এখানে একেবারে মামলার তারিখ এবং ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ করলাম, জানালাম আপনাদের। এখন আপনারাই নিজেদের বিবেক খাটিয়ে, বিশ্লেষণ করে দেখবেন, গবেষকরা যে বলেছিলেন বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে জিয়া হত্যার পেছনে তার পরিবারের লোকজন, ঘনিষ্ঠলোকজন জড়িত ছিল— এটি সত্য হওয়া সম্ভব কি না?

লেখক: শিক্ষক ও আইনজীবী

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন