বিজ্ঞাপন

মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১৯টি যাত্রাপালা: একটি মূল্যায়ন

March 28, 2018 | 11:43 am

।। তপন বাগচী ।।

যাত্রামঞ্চের জন্যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ১৯টি পালা রচিত ও অভিনীত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যাত্রা লেখা হয়েছে, পেশাদার মঞ্চে অভিনীত হয়েছে। একাত্তর সালের পরেও এ সকল পালা বিভিন্ন যাত্রাদল আসরস্থ করে। পালাকার সত্যপ্রকাশ দত্তের পালা বাদে বাংলাদেশে যে আরও নয়টি পালার পরিচয় পাওয়া যায় তার মধ্যে পালাকার পরিতোষ ব্রহ্মচারী, কবিয়াল বিপিন সরকার এবং অভিনেত্রী জ্যোৎস্না বিশ্বাস রচিত পালা তিনটি মানসম্পন্ন। নগরের শিক্ষিত ও সচেতন নাট্যকারদের হাতে এখনো বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে ইতিহাস-সিদ্ধ নাটক রচিত হয়নি। আব্দুুল গাফফার চৌধুরী রচিত ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকের আগে যাত্রামঞ্চে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু এসেছে ১৯টি যাত্রাপালায়। সংখ্যাবিচারে এটি নিংসন্দেহে গৌরবের ব্যাপার। আবার গুণবিচারের আগে দেখতে পাই, মন্মথ রায়, উৎপল দত্ত, নরেশ চক্রবর্তী, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, মৃণাল কর প্রমুখ খ্যাতিমান থিয়েটার-ব্যক্তিত্ব এবং ব্রজেন্দ্রকুমার দে, সত্যপ্রকাশ দত্ত, পরিতোষ ব্রহ্মচারী- এই শীর্ষস্থানীয় পালাকার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পালা লিখেছেন। এঁরা নাট্য ও যাত্রাজগতের নমস্য।

বিজ্ঞাপন


১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রচিত পালাগুলো হলো মন্মথ রায়, ‘আমি মুজিব নই’, দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুরন্ত পদ্মা’, উৎপল দত্তের ‘জয়বাংলা’, নরেশ চক্রবর্তীর ‘সংগ্রামী মুজিব’, নিরাপদ মন্ডলের ‘মুক্তিফৌজ’, সত্যপ্রকাশ দত্তের ‘বঙ্গবন্ধু মুজিবুর’, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গবন্ধুর ডাক’। এর মধ্যে ‘সাতকোটির মুজিব’ নামে একটি পালার নাম পাওয়া গেছে, তবে তার লেখকের নাম পাওয়া যায়নি। ১৯৭২ সালে অরুণ রায়ের ‘আমি মুজিব বলছি’, ব্রজেন্দ্রকুমার দে-র ‘মুজিবের ডাক’, সাধন চক্রবর্তীর ‘শেখ মুজিব’, মৃণাল করের ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ রচিত ও অভিনীত হয়। মৃণাল কর রচিত, অভিনীত ও নির্দেশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ পালাটি জয়বাংলা সাংস্কৃতি জোটের আয়োজনে ঢাকার মহানগর মুক্তমঞ্চে অভিনীত হয়। ১৯৭৪ সালে পরিতোষ ব্রহ্মচারীর ‘নদীর নাম মধুমতি’ এবং কবিয়াল বিপিন সরকারের ‘মুক্তিসেনা’ পালাদুটি রচিত হয়। ‘নদীর নাম মধুমতি’ তুষার অপেরার মাধ্যমে অভিনীত হয়। নড়াইল জেলার কালনা গ্রামের কবিয়াল বিপিন সরকারের লেখা ‘মুক্তিসেনা’ নামের পালাটি মাগুরার চৈতালী অপেরায় যশের সঙ্গে অভিনীত হয়। কবিয়ালের এই পালাটি তাৎপর্যপূর্ণ।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে বাংলাদেশে যাত্রাগানের দুর্দিন নেমে আসে। রাজনৈতিক অস্থিরতাইর এর প্রধান কারণ। ২০ বছর আর নতুন পালা হয়নি মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। প্রায় বিশ বছর পরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে হলে দিলীপ সরকার রচনা করেন ‘বাংলার বিজয়’ নামের যাত্রাপালা। যাত্রাসম্রাজ্ঞী জ্যোৎস্না বিশ্বাস ১৯৯৬ রচনা করেন ‘রক্তস্নাত একাত্তর’ নামের যাত্রাপালা। পালাটি ঢাকার মঞ্চে ১৭ বার অভিনীত হয়েছে বলে পালাকার জানিয়েছেন। একই বছর আব্দুুস সামাদ নামের এক পালাকার ‘একাত্তরের জল্লাদ’ নামের পালা রচনা করেন। ১৯৯৫ সালে এমএ মজিদ রচিত ‘সোনার বাংলা’ এবং ১৯৯৭ সালে নজরুল ইসলাম সাজু রচিত ‘বাংলার মুক্তি’ পালাদুটিও বিষয়ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ‘সোনার বাংলা’, ‘বাংলার বিজয়’ এবং ‘বাংলার মুক্তি’ যাত্রামঞ্চে অভিনয়ের উপযোগী করেও রচিত হলেও শিল্পমূল্যবিচারের এগুলো মানসম্পন্ন নয়।


বাংলাদেশের যুদ্ধের কাহিনী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে সত্যপ্রকাশ দত্ত রচনা করেন ‘বঙ্গবন্ধু মুজিবুর’ নামের যাত্রাপালা। ১৯৭১ সালে লেখা উৎপল দত্তের ‘জয়বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের সময় লোকনাট্য যাত্রাদল মঞ্চস্থ করে। ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গবন্ধু ডাক’ নামে একটি যাত্রাপালা রচনা করেন। ‘সাত কোটির মুজিব’ পালাটি জনপ্রিয় হয়েছিল, তবে এর রচয়িতার নাম জানা যায়নি। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ পালাটি ১৯৯৬ সালে জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোটের আমন্ত্রণে ইন্দ্রসভা অপেরা ঢাকার মঞ্চে অভিনয় করে আসতে। বঙ্গবন্ধু চরিত্রে অভিনয় করার কথা পালাকার ও নির্দেশক মৃণাল করের। কিন্তু পালাটি শেষপর্যন্ত মঞ্চস্থ হয়নি বলে জানিয়েছেন যাত্রাবিশেষজ্ঞ মিলনকান্তি দে।
আমাদের থিয়েটার তথা নাগরিক নাট্যসমাজ যা পারেনি, যাত্রা তা পেরেছে। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু তো বটেই ‘হিটলার’, ‘লেনিন’, ‘হো-চি মিন’ পালা যাত্রায় এসেছে। এ কারণেই নাট্যগবেষক প্রভাতকুমার গোস্বামী বলেছেন যে, ‘বর্তমানে অর্থাৎ সত্তর দশকে অবশ্য ঐতিহাসিক যাত্রাপালা বিষয়বস্তুর দিক থেকে থিয়েটারের নাটককে পেছনে ফেলে এসেছে বলতেই হয়’।
শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক পালারচনা সাহসের পরিচয়বাহী। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক তাজউদ্দীনের আহমদের চরিত্রও ফুটে উঠেছে নিরাপদ ম-লের ‘মুক্তিফৌজ’ পালায়। আাটটি পালায় এসেছে সরাসরি মুজিবের নাম। তিনটি পালার নামে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি এসছে। মন্মথ রায়ের পালাটি থিয়েটারের জন্যে রচিত হলেও যাত্রামঞ্চে এটি গৃহীত হয়েছিল। পঁচাত্তর সালের পরে শেখ মুজিবের জীবনভিত্তিক পালাগুলো পেশাদার দলে অভিনীত হচ্ছে না। ইতিহাসের এই গৌরবের অধ্যায় নিয়ে এ যাবৎ মোট ১৯টি পালা রচিত ও মঞ্চস্থ হয়েছে। সকল পালা এখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। এর মধ্যে ৮টি পালা রচিত ও মঞ্চস্থ হয়েছে ১৯৭১ সালেই, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে।
মিলনকান্তি দে-র রচিত পালাটিই বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক পালার মধ্যে আপাত-শেষ সংযোজন। এতে বঙ্গবন্ধু কী করে বাঙালি জাতির মহায়নায়ক হয়ে উঠলেন, তারই বীরত্বগাথা রচিত হয়েছে।
দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘দুরন্ত পদ্মা’ পালাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধচলাকালে পালাটি রচিত হয়। ১৫ আগস্ট এর রচনা সম্পন্ন হয় এবং ডিসেম্বর মাসে এটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। ভারতীয় গণ-সংস্কৃতি সংঘ এটি প্রথম মঞ্চে আনে। এই পালাটি ‘সোভিয়েত দেশ নেহেরু পুরস্কার’ লাভ করে। এই পালায় চরিত্র হিসেবে আর্মি মুক্তিযোদ্ধা, যুবলীগ নেতা, ছাত্রলীগ নেতা, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা, বামন্থী শ্রমিক নেতা, গায়ক যোদ্ধা, চিকিৎসক যোদ্ধ, ছাত্রী যোদ্ধা, নার্স যোদ্ধা রয়েছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের বেশ গভীর তথ্য উপস্থান করেছে। বিজয়ের আগে রচিত ও অভিনীত এই পালটি শেষ হয়েছে, সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আরেকটি যাত্রাপালা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। নিরাপদ মন্ডল রচিত এই যাত্রাপালার নাম ‘মুক্তিফৌজ’। পালাকার একে ‘জয়বাংলার ইতিহাস’ নামে আখ্যা দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরের টাউনশিপ গ্যারেজ ময়দানে ১৯৭১ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে (২ আশ্বিন ১৩৭৮) খেয়ালী নাট্যসমাজ এই পালাটি মঞ্চায়ন করে। পালাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় পালাকার বলেছেন, ‘পাকিস্তান সরকারের জঙ্গী মনোভাবের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে এগিয়ে এল বাংলাদেশের তরুণ সমাজ। ‘জয়বাংলা’ ধ্বনিতে বাংলার আকাশ-বাতাস-মাটি মুখর হয়ে উঠল। ইয়াহিয়া খান লেলিয়ে দিল তার সেনাবাহিনী। শুরু হলো বাঙালীর ওপর অমানুষিক অত্যাচার; নেমে এল দেশের বুকে রক্তের বন্যা। তারপর সব ইতিহাস। সে ইতিহাস রচনা হলো বাংলাদেশের তাজা তরুণ রক্তে। সেই রক্তের আখরে লেখা মুক্তিফৌজের অমর কাহিনী আমার অক্ষম লেখনীতে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।’
‘মুক্তিফৌজ’ পালাটি উৎসর্গ করা হয়েছে ‘রক্ত দিয়ে যারা প্রমান করে গেল বাংলাদেশ বীরশূন্য নয়, তাদের পুণ্যস্মৃতি স্মরণে’। খেয়ালী নাট্যসমাজের প্রথম রজনীর অভিনয়ে যাঁরা পুরুষচরিত্রে অংশ নেন, তাঁরা হলেন কুবীরচন্দ্র ঘোষ, নিরাপদ ম-ল, ভারতী কুমার গোস্বামী, সুনীতিকুমার গোস্বামী, গোবিন্দচন্দ্র ঘোষ, তারকচন্দ্র বিশ্বাস, গোপালচন্দ্র ব্যানার্জী, সত্যেনকুমার মিশ্র, তুলসীচন্দ্র ম-ল প্রমুখ। আর নারীচরিত্রে ছিলেন ভারতী রাণী দত্ত, রীনা ব্যানার্জী, সন্ধ্যা রাণী ভট্টাচার্য প্রমুখ। পালা পরিচালনা করেন সুশান্তকুমার চৌধুরী, সংগীত পরিচালনা করেন বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই পালায় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে, তাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধ চলছে। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করছেন আওয়ামী লীগ নেতা তাহেরউদ্দীন। যাত্রার তাহেরউদ্দীন চরিত্র যেন তাজউদ্দীন আহমদের চরিত্র। তাহেরউদ্দীনের (তাজউদ্দীনের) কন্যা সাকিনা এ পালার অন্যতম নারীচরিত্র। পালাটি যখন রচিত হয়, তখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থামেনি। ভারতীয় বাহিনী সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিত। এই অসমাপ্ত যুদ্ধের কাহিনী নিরাপদ মন্ডল এঁকেছেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টার দৃষ্টি দিয়ে। রাজাকার আবদুল খাঁকে খুন করার মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধা রমজানের সংলাপ-‘মৃত্যুর পূর্বে জেনে যাও আবদুল খাঁ; শেখ মুজিবর রহমানের বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত নয়। ভারতবাসীর সাহায্যে বহু বাধা অতিক্রম করে জয়ের গৌরব অর্জন করেছে মুক্তিফৌজ। রমজানের এই সংলাপের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ‘মুক্তিফৌজ’ যাত্রাপালা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর রচিত এই পালা একটি ঐতিহাসিক। ‘দুরন্ত পদ্মা’ এবং ‘মুক্তিফৌজ’-এর দুই পালাকার দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নিরাপদ ম-লের কাছে মুক্তযুদ্ধের পক্ষের প্রতিটি মানুষ কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবেন। মুক্তিযুদ্ধের এই পালাদুটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।

বিজ্ঞাপন

তপন বাগচী: কবি-প্রাবন্ধিক, উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি।

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন