বিজ্ঞাপন

মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলা নামের দেশ

March 28, 2018 | 2:56 pm

।। ফারুক ওয়াহিদ ।।

বিজ্ঞাপন

“বাংলাদেশ আগুন লাগা শহর আর লক্ষ গ্রাম/ বাংলাদেশ দুর্গময় ক্রুদ্ধ এক ভিয়েতনাম।” –কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের ‘বাংলাদেশ একাত্তরে’ কবিতার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বাংলার সংগ্রামী চেহারা অর্থাৎ ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাটি’ তা ফুটে উঠে। পৃথিবীতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভকারী দেশের সংখ্যা খুবই অল্প। আমরা বাঙালিরা সেই সৌভাগ্যবান জাতি, যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের পর ৯৩ হাজারেরও বেশি হানাদার গণহত্যাকারী নারীধর্ষক কুখ্যাত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে ও প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করানোর মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

স্বাধীনতা বাঙালির অস্তিত্ব, বাঙালির অহঙ্কার। পরাধীনতার শৃঙ্খল চূর্ণবিচুর্ণ করে অশ্রুমাখা, রক্তেভেজা শিশিরস্নাত শ্যামল বাংলামায়ের মাটিতে অকুতভয় মুক্তিযোদ্ধারা ৩০ লক্ষ শহীদের তাজা প্রাণ ও চার লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমহানীর বিনিময়ে এই অর্জন। গাঢ় সবুজের মধ্যে রক্তিম-সূর্য এবং তার মাঝে স্বার্ণালি মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় পতাকা উড়িয়েছিল। অনেক স্বপ্ন, অনেক সাধনা, অনেক রক্ত এবং অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশ। পৃথিবীর সবদেশে সবসময়েই মানুষের প্রিয়তম অনুভূতি, গর্ব ও গরিমার ধন এই প্রিয় স্বাধীনতা।

পলাশীর আম্রকাননে ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। এরপর প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশ শাসনের নিগড়ে বাঁধা ছিল বাংলার স্বাধীনতা। কবি সুকান্তকে ‘অনুভব’ কবিতায় তাই আক্ষেপ করে বলতে হয়েছিল, “এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম,/ অবাক পৃথিবী! সেলাম তোমাকে সেলাম।” সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য, নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, শ্যামল রূপময় প্রকৃতি, অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জনজীবন নিয়ে ওঠা হাজার বছরের চিরশান্তিময় আবহমান বাংলাদেশ ছিল অফুরন্ত সৌন্দর্য ও মাধুর্যের দেশ। কবি অমিয় চক্রবর্তী ‘বাংলাদেশ’ কবিতায় বলেছেন, “সেই বাংলাদেশে ছিল সহস্রের একটি কাহিনী/ কোরানে-পুরাণে-শিল্পে, পালা-পার্বণের ঢাকে ঢাকে/ আউল-বাউল নাচে।”

বিজ্ঞাপন

                                                                                                                                                                  ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকরা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে গেলে সম্পূর্ণ ধর্মীয় উন্মাদনা আর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় এক অদ্ভুত রাষ্ট্র -তথাকথিত পাকিস্তান! এই পাকিস্তানের সমগ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বাঙালিরা। কিন্তু পাকিস্তানিরা কখনোই সংস্কৃতমান বাঙালিদের সুনজরে দেখেনি। বাঙালি জনগোষ্ঠীকে তারা বঞ্চিত করে সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে। এরই ধারাবহিকতায় বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম শুরু হয়। ধাপে ধাপে সে সংগ্রাম এগিয়ে যায় চূড়ান্ত পরিণতির দিকে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট আন্দোলন, ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালি রুখে দাঁড়ায় পাকিস্তানি একনায়কতন্ত্র এবং সামরিক শাসনের অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে।

                                                                                                                                                                              ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান

বিজ্ঞাপন

১৯৭০ সালের শেষভাগে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি বর্বর শাসকরা বাঙালিদের হাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দেওয়াতো দূরের কথা, উল্টো ষড়যন্ত্র শুরু করে বাঙালি জাতিকে চিরতরে স্তব্ধ করার জন্য।

এরই মধ্যে আসে সমগ্র বাংলায় চৈতালি বসন্তে অগ্নিঝরা মার্চ ১৯৭১। ১ মার্চ, ৭১ বসন্তের তপ্ত দুপুরে ১টা পাঁচ মিনিটে রেডিওতে পাকিস্তানি সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিনা মেঘে বজ্রপাতের ন্যায় ঘোষণা করেন- ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের আহ্বান করা অধিবেশন কোনো কারণ ছাড়া অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলো।

ওই এক ঘোষণায় আকস্মিকতায় সারা বাংলায় বিস্ফোরণ ঘটে যায়- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘জয়বাংলা, জয়বাংলা’। স্লোগানে স্লোগানে ফেটে পড়ে বাংলার ছাত্র-শ্রমিকসহ সাড়ে ৭ কোটি মানুষ। এ যেন বারুদে আগুন লাগা মুহূর্তে একটি দেশকে পরিণত করেছিল ক্ষিপ্ত আগ্নেয়গিরিতে। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবনের বটতলায় সংগ্রামী বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ পাকিস্তানি ‘চাঁনতারা মার্কা বেইমান পতাকা’ পুড়িয়ে দিয়ে স্বর্ণালি মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের বাংলাদেশের নতুন পতাকা উড়িয়ে দেয়। কবি হুমায়ুন আজার ভাষায় এ যেন “আর তোমাকে দেখলেই উঁচু দালানের শির থেকে ছিঁড়ে পড়ে চাঁনতারা মার্কা বেইমান পতাকা।”

একাত্তরের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

বিজ্ঞাপন

অগ্নিঝরা ৭ মার্চ ছিল রোববার। রক্তঝরা, অগ্নিঝরা, রোদনভরা বসন্তের উত্তপ্ত ফাল্গুনের অপরূপ অপরাহ্নে ঢাকার রমনার সবুজ প্রান্তর রেসকোর্স ময়দানের জনমহাসমুদ্রে এদিন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টগবগে রক্তে আগুন জ্বলা বজ্র কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” মাত্র ১৯ মিনিটের এই পৃথিবী কাঁপানো বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক জ্বালাময়ী ভাষণ ছিল বাঙালির হাজার বছরের আবেগ, হাজার বছরের স্বপ্নের বাণী, হাজার বছরের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। যা ছিল বাঙালিকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। দীপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্।” এই ঐতিহাসিক ভাষণই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে-নির্দেশে মুক্তিপাগল বাঙালি জাতিকে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।

একাত্তরের অগ্নিগর্ভ ৭ মার্চ ঢাকা ছিল লাখো মানুষের পদচারণায় উত্তপ্ত।  স্লোগানের নগরীতে ‘জয়বাংলা, জয়বাংলা’, ‘বাঁশের লাঠি তৈরি কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, সোনার বাংলা মুক্ত করো’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’- এসব লাখো মানুষের স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল ঢাকা নগরী।

                                                                                                                                                    মুক্তিকামী জাতির রাজপথে আন্দোলন

এরপর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারা বাংলায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হল।  ২৩ মার্চ,৭১ সারাবাংলায় বাংলাদেশের নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয়। তারপর আসে ২৫ মার্চের বিভীষিকাময় কালরাত্রি। এই রাত্রে বাংলার স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের ওপর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে নৃশংস গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বর্বর নরপিশাচ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বিশ্ববাসী স্তম্ভিত হতবাক চিত্তে প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাসের নৃশংসতম বর্বরতা- যা কুখ্যাত চেঙ্গিস খান, হিটলার, হালাকুকেও হার মানিয়েছিল। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ বিস্ময়ে আরো প্রত্যক্ষ করেছিল নিরীহ বাঙালিদের উপর হিংস্র শ্বাপদের ভয়াল থাবার নখরদন্তের বিষাক্ত ছোবল। মানবতাকে পদাঘাত করে ষড়যন্ত্রকারী ভুট্টো, নরপশু ইয়াহিয়া ও কসাই টিক্কাখান ট্যাংক, রকেট ল্যাঞ্চার, মর্টার ও মেশিনগানের বুলেটের আঘাতে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে ধূলিসাৎ করে দিতে চেয়েছিল। এর আগে সেই রাত্রেই হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নং রোডের বাসা থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগের সেই রাতে (রাত ১২ টার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ,৭১) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দেশকে শত্রমুক্ত করতে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন।

২৫ মার্চের বিভীষিকাময় কালরাত্রি

মরুপশু হানাদার বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে বাংলার পবিত্র মাটি থেকে উৎখাত করার জন্য শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।  “এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।”- বাংলার দুরন্ত দুর্বার দেশপ্রেমিক মুক্তিপাগল দামাল ছেলেরা মরণপণ প্রতিজ্ঞা করে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্র বুকে নিয়ে দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে থাকে।

এক কোটি মানুষ ঘরছাড়া হয়ে আশ্রয় নেয় প্রতিবেশি দেশ ভারতে

প্রতিবেশি দেশ ভারতের বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধের সশস্ত্র ট্রেনিং নিয়ে হানাদার বর্বর পাকিস্তানি নরপশুদের বিরুদ্ধে প্রথমে গেরিলা কায়দায় ও পরবর্তীতে সম্মুখ যুদ্ধে বীরবিক্রমে লড়তে থাকে। প্রায় ১ কোটি লোক ঘরছাড়া হয়ে আশ্রয় নেয় বন্ধুপ্রতীম, বিপদের বন্ধু প্রতিবেশি দেশ ভারতে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রবাসী সরকার গঠন করা হয় ১০ এপ্রিল।  আর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরের আম্রকাননে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ নেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। দেশের ভেতরে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দোসর এদেশীয় পদলেহী কুখ্যাত রাজাকার, আলবদর, আলশামস, আলমুজাহিদ বাহিনী এবং তথাকথিত শান্তি কমিটিকে নিয়ে গণহত্যা, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতন শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অল্প শিক্ষিত বুনোদল তথা পাকিস্তানি সৈন্যরা সবসময় বলতো, “মাশরেকি পাকিস্তানমে আদমী নেহী, সেরেফ মিট্টি মাঙ্গতা।” -অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে মানুষ চাই না, শুধু মাটি চাই। এই পোড়ামাটি নীতিকে অনুসরণ করে পাকিস্তানিরা সারা বাংলায় ব্যাপকহারে গণহত্যা শুরু করে।

একাত্তরের গণহত্যা

এদিকে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত সাড়ে সাত কোটি বাঙালি দুর্জয় আক্রোশে হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা দিন দিন বাড়তে থাকে ও দখলদার পাকিস্তানি সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে দেশের নতুন নতুন এলাকা হানাদার মুক্ত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলার মা-বোনেরা বসে ছিল না, নারীরা সুসংগঠিত হয়ে ট্রেনিং নিয়ে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ

৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং ভারতীয় সৈন্য তথা মিত্রবাহিনী যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর দুর্বার আক্রমণের কাছে টিকতে না পেরে যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ৯৩ হাজারেরও বেশি হন্তারক ঘৃণ্য যমদূত কুখ্যাত হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর  বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করে।  আর এর মধ্য দিয়ে বাঙালির বীরত্বপূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক বিজয় সূচিত হয়, অবসান হয় কুখ্যাত পাকিস্তানি জঙ্গী দুঃশাসনের।

১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ

৩০ লক্ষাধিক বাঙালির বুকের তাজা রক্ত এবং ৪ লক্ষাধিক মাবোনের সম্ভ্রম ও প্রাণের বিনিময়ে পূর্ব দিগন্তে উদিত হয় নতুন সম্ভাবনার রক্তিম সূর্য। বিশ্বের মানচিত্রে বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বপ্নের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

কিংবদন্তির কবি শামসুর রাহমান গণহত্যাকারী পাকিস্তানি নরপশু ও এ দেশীয় পদলেহী কুকুরদের অভিশাপ দিয়েছেন এই ভাষায়, “যারা গণহত্যা করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে, আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়ে অধিক/ পশু সেই সব পশুদের।”

মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, “দেশের জন্যে যুদ্ধ করার সেই অবিশ্বাস্য গৌরব সবার জন্যে নয়, সৃষ্টিকর্তা অনেক য্ত্ন করে সৌভাগ্যবান কিছু মানুষকে তার জন্যে বেছে নিয়েছেন। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী কিংবা সাহিত্যিক হবে, ফিল্ড মেডেল বিজয়ী গণিতবিদ হবে, অস্কার বিজয়ী চিত্রপরিচালক হবে, অলিম্পিকে স্বর্ণবিজয়ী দৌড়বিদ হবে, ওয়ার্ল্ডকাপ বিজয়ী ক্রিকেট টিম হবে, এমনকি মহাকাশ বিজয়ী মহাকাশচারী হবে কিন্তু আর কখনওই মুক্তিযোদ্ধা হবে না! এই সম্মানটুকু সৃষ্টিকর্তা যাঁদের জন্যে আলাদা করে রেখেছেন শুধু তারাই তার প্রাপ্য, অন্যেরা নয়।” এরপরও বীর মুক্তিবাহিনী তথা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে কি?

রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা

মিত্রবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট জনাব মুসা সাদিকের একটি লেখার কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি, “পাক হানাদার কবলে বন্দী বঙ্গ জননীর আঁখিজল মুছিয়ে দিতে একাত্তরে যে বীর অরোরা এসেছিলেন এই বঙ্গে, তিনি তো কিছুই চাননি। আজ তিনি নেই! বিশ্বচরাচরে কোথাও তিনি নেই! আজ তাই একাত্তরের বীর প্রসবিনী বঙ্গজননী জলটলমল চেয়ে আছে সেই পথপানে। স্বাধীনতার পতাকা হাতে যে পথ বেয়ে সেই বীর এসেছিলেন বঙ্গে, যে পথ ধরে সে বীর গিয়েছিলেন চলে।  একাত্তরের নির্যাতিতা ভুলুণ্ঠিতা তোমার জননীভগিনিকে মাথার পাগড়ি খুলে পরিয়ে দিয়েছিলেন যে পরদেশী বীর, তার বীরত্ব দিয়ে, বিক্রম দিয়ে সেবা করেছিলেন তোমার বঙ্গ জননীর। বিধাতা প্রেরিত বঙ্গ জননীর বীর সন্তান তিনি। তার গরবে গরবিনী বঙ্গ জননী, গর্বিত বাংলাদেশ। বীর প্রসবিনী বঙ্গ জননীর কোল আলো করে ফিরে ফিরে এসো মহান বীরেরা। তোমাদের বীরত্বে-বিক্রমে জেগে জেগে উঠুক বাংলাদেশ। জয় হোক বঙ্গ জননীর। জয় হোক বাংলার। জয়তু বাংলাদেশ।” একাত্তরে আমাদের দুঃসময়ের বন্ধু মিত্রবাহিনী সম্পর্কে আজ আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে কি?

মুক্তিযুদ্ধ জয়ের এতো বছরে মেঘনা, তিতাস, পদ্মা, যমুনায় অনেক জল গড়িয়েছে। আজ সময় এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করার। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয় ছিল সুখী অভাবমুক্ত, শোষণমুক্ত সমাজ, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের নিশ্চয়তা, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতা- তার কতটুকু আমরা অর্জন করেছি! স্বাধীনতা অর্জন যত কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা তার চেয়ে আরো কঠিন, কিন্ত আমরা কি সেটা অনুধাবন করতে পেরেছি!

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি বাঙালি জাতিকে ভিতরে ভিতরে ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নির্বাসিত করার চেষ্টা করছে। মিথ্যা বলা হয়েছে, মিথ্যার অভিনয় করা হয়েছে, এমন কি বাঙালির রূপকথার প্রবাদপুরুষ বাঙালির অবিসংবাদিত সংগ্রামী নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নাম নিশানা পর্যন্ত মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।  তাই বাংলা সাহিত্যের খ্যাতমান লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাষায় বলতে হয়,

“যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান

ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

দিকে দিকে আজ অশ্রুমালা রক্তগঙ্গা বহমান

তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।”

ইতিহাস বারবার প্রমাণ দিয়েছে, বাঙালি হলো ফিনিক্সপাখির মতো।  তাই নতুন প্রজন্ম ইদানীং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পেরে প্রশ্ন করছে, কাদের দোষে এমন মুখ থুবড়ে পড়েছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস? মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে চেপে রেখেছিল পঁচাত্তর পরবর্তী সরকারগুলো যেহেতু প্রকৃত ইতিহাস বললে গণহত্যাকারী নারী নির্যাতনকারী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলতে হয়, তাতে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। তাই তারা বিষয়গুলো চেপে গিয়ে ‘হানাদার’, ‘শত্রু’ এসব শব্দ ব্যবহার করে যা পাঠ্য পুস্তকেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।  যাতে নতুন প্রজন্ম প্রকৃত হানাদার এবং শত্রুকে চিনতে না পারে। এমন ভাব ছিল যে বাংলাদেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধই হয়নি।

দীর্ঘদিন সারাদেশ মিথ্যার একটা ঘন আবরণে যেন ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটি প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা গেলেও সবাই বিভ্রান্ত হয়নি। তারা আবারো ফিনিক্সপাখির মতো জেগে উঠেছে। দেরিতে হলেও জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছে এবং হচ্ছে। সুকান্তের ‘দিনবদলের পালা’ কবিতার ভাষায় বলতে গেলে, “অনেক নিয়েছ রক্ত, দিয়েছ অনেক অত্যাচার,/ আজ হোক তোমার বিচার।” তাই আজ সময়ে এসেছে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা।

প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পার হয়ে একাত্তরে মৃত্যুঞ্জয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনন্তকাল ধরে প্রবাহিত হবে। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধ অনিঃশেষ ও অন্তহীন- তাই মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চিরজাগরূক থাকে। এই চেতনাকে ধারণ করতে পারলেই আমরা জাতি হিসেবে সমৃদ্ধ হতে পারব এবং বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলে হারানো বাংলাকে আবার ফিরে পাবো।

লেখক: ফারুক ওয়াহিদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা, ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

সারাবাংলা/ এসবি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন